ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বই ॥ সমসাময়িক কালের বিবেকের নাড়া

প্রকাশিত: ১২:৩৫, ৩০ আগস্ট ২০১৯

বই ॥ সমসাময়িক কালের বিবেকের নাড়া

রূপবৈচিত্র্যের মাঝে নিহিত থাকে ব্যক্তি, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বার্তাসমূহ যা পাঠকের কাছে দিকনির্দেশনা হিসেবে আসে। আর এ সৌন্দর্যও বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সৌন্দর্য প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘তা মোটামুটি এমন ‘শর্তহীন সুন্দর যা কিনা আনন্দ দেয়’। তবে ‘শর্তহীন সুন্দরও কখনও কখনও শর্তযুক্ত সুন্দরে প্রতীয়মান হতে পারে। শিল্প সুন্দর ও অনুরূপ অনুষঙ্গকে সাঙ্গীকরণের মধ্য দিয়ে প্রস্ফুটিত হয়। যে শিল্পবোধ সমাজ-রাষ্ট্রজীবন থেকে দূরগামী এবং প্রয়োজনীয় চেতনাবাহী নয় তা কেবলই সুন্দর বলে আখ্যা পেয়েও পতিত হয়ে পড়ে রয়েছে কারণ এর বোধ কোনভাবেই অনুভব করবার মতো স্ফূর্তচেতনা মানুষের নেই।’ এ ‘শর্তহীন’ ও ‘শর্তযুক্ত’ সৌন্দর্যের ফেরিওয়ালা একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকের কবি ফজলুল হক তুহিন। তার ‘ফেরা না ফেরা’, ‘তুমি প্রতিদ্বন্দ্বী’, ‘সরাও তোমার বিজ্ঞাপন’, ‘বিহঙ্গ পিঞ্জর’, ‘বাজাও আপন সুর’, ‘সুন্দরের সপ্তপদী’, ‘দীর্ঘ দুপুরের দাগ’ ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থে ‘শর্তহীন’ ও ‘শর্তযুক্ত’ সৌন্দর্যের বর্ণনা এমনভাবে দিয়েছেন যার মাধ্যমে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের রূপ বৈচিত্র্যের সংযোগ করে চলেছে। তার দু’দশকের এমন প্রয়াসের মাঝে ২০১৯ সালে একুশের বই মেলায় প্রকাশিত হলো উজানে উৎস কাব্য গ্রন্থটি। এ গ্রন্থে আটত্রিশটি কবিতা রয়েছে। প্রতিটি কবিতা বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্য-পুরাণাশ্রিত রূপক ব্যবহার করে বর্তমান সময়ে নৈতিকতা বিবর্জিত আগামী দিনের ভয়ঙ্কর বাংলাদেশের অবস্থা তুলে ধরেছেন। ‘লালবাগ কেল্লায় একটি বিকেল’ কবিতায় বক্তা শেষ বিকেলে ‘নিশ্চুপ’, ‘নিশ্চল’ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে মোগল শাসনামলে বাংলার সুবেদার শায়েস্তা খাঁর ‘কীর্তি’র স্বাক্ষরযুক্ত লালবাগের কেল্লার প্রতিটি দেয়ালে ন্যায়বিচার ও জনকল্যাণমূলক কাজকে স্মরণ করে বিষণœ হয়ে যান। তার এ বিষণœ হবার কারণ ‘তুমি বেদনার বারুদ জ্বালিয়ে আমাকে পুড়িয়ে/ সন্ধ্যার আঁধারে ধীরে ধীরে অদৃশ্য নীরব হয়ে গেলে/ পরীবিবি, তুমি চলে গেলে অস্তগামী সূর্যের আবীরে/ তবে চেতনার সরোবরে বন্ধু হয়ে বারবার এসো ফিরে।’ যত সামনে এগিয়ে যাওয়া যায় ততই সমাজের নির্মম নিষ্ঠুরতার দৃশ্য তত করুণ আকারে কবির কাছে ধরা পড়েছে। তীব্র হয়েছে তার ঘৃণা প্রকাশের মাত্রা। ‘প্রতিদিন একটি দৃশ্যের মাঝে’ কবিতায় তার আর্তচিৎকারে প্রকম্পিত পাঠক হৃদয়। সমাজের অসহায় মানুষের করুণ বেদনা দেখে তিনি বললেন, ‘এ কোন শিকারি/মায়ের বুকের ধন কেড়ে নেয় জান্তব উল্লাসে/কোথায় সে স্বৈরাচারী/ পিতার কোমল কাঁধে সন্তানের লাশ চাপিয়ে দেয় সানন্দে/কোন সে নিঠুর হন্তারক/ সম্পন্ন নারীর গায়ে শিউলির শুভ্রতা ও রক্তের ছাপ এঁকে দেয় অকারণে/আর সন্তানের জন্য শতাব্দী সমান আঁধার রাতের শোষক/প্রাণের সংসার হয়ে ওঠে বেদনার আরণ্যক।’ অথবা ‘দানবের দাঁত’ কবিতায় তিনি যখন বললেন, ‘পৃথিবীর মাটি থেকে মানুষের মাঝে/দানবের পদধ্বনি শোনা যায় রাতে’, ‘রাজত্ব’ কবিতায় ‘ক্ষমতার তীর, তলোয়ার, বোমা, গুলি, ক্ষেপণাস্ত্র/জাগিয়ে রেখেছে হিংসা, লোভ, কাম, কাক্সক্ষার আগুন/অথচ গহন রাতে ডাক পাড়ে কান্নার ডাহুক/জীবনের জাদুঘরে কালের লিখন আঁকে সুখ-দুখ।’ তখন সমাজের প্রতিটি স্তরের যে ক্ষয় তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ‘উজানে উৎস’ কবিতাটি এ গ্রন্থের শেষ কবিতা। এ কবিতাটি পূর্ববর্তী সব কবিতার একটি নির্যাস বলেই প্রতীয়মান। এখানে সমকালীন সব বিষয়গুলো প্রতীক ও রূপকের মাধ্যমে সংক্ষিপ্তভাবে তুলে এনে বললেন, ‘দাঁড়ের কষ্ট পালের প্রেরণা নেই এই পথে, নেই কোন দায়।’ ফজলুল হক তুহিনের উজানে উৎস কাব্য গ্রন্থে সমকালীন বাংলাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার যে চিত্র উঠে এসেছে তা উপলব্ধি করে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদী হওয়ার যে স্বপ্ন দেখিয়েছেন তার পূর্ণবাস্তবায়ন জনজাগরণের মাধ্যমে ঘটুক এটাই যেন মূল প্রতিপাদ্য বিষয়।
×