ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

শাহ বুলবুল

চে গুয়েভারার প্রথম প্রেম চিচিনা ফেরেরা

প্রকাশিত: ১২:৩৫, ৩০ আগস্ট ২০১৯

চে গুয়েভারার প্রথম প্রেম চিচিনা ফেরেরা

একটা সর্বহারা জীবন। যখন তার চারপাশ ঘিরে থাকে সাঁজোয়া বাহিনীর আগ্রসন। যিনি বিপ্লবের দাবানল ছিটিয়ে গেছেন সিয়েরামায়েস্ত্রা হয়ে বলিভিয়ার গহীন জঙ্গলে। মেক্সিকোর বিষণœ জেল থেকে লা হিুগুয়েরা গ্রামের কুয়েব্রাডা পর্বত; সর্বত্রই বিপ্লবের পোড়া গন্ধ। এসবের বাইরে গল্পটা একেবারেই অন্যরকম। তিনি একজন কবি, মৃত প্রণয়ের হলদে প্রেমিক। চিচিনা। মেয়েটির পুরো নামÑমারিয়া দেল কারমেন চিচিনা ফেরেরা। আর্নেস্তো গুয়েভারা তখন করদোবার ডিন ফিউনেস ন্যাশনাল স্কুলের ছাত্র। প্রেম আর কষ্টের শুরুটা সেই স্কুল জীবন থেকেই। চিচিনাদের বাড়িও করদোবাতে। চিচিনার বাবা দন হোরাচিও ফেরেরা করদোবা শহরের একজন ধনাঢ্য ব্যক্তি। স্পেনিশ গৃহযুদ্ধের সময় লিঞ্চ সেরানা পরিবার বসবাস করতেন আলটাগ্রাসিয়াতে। এটা স্পেনের সীমান্তবর্তী হওয়ায় অনেক স্পেনবাসী যুদ্ধের নিষ্ঠুরতা থেকে বাঁচতে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আলটাগ্রাসিয়াতে এসে আশ্রয় নেন। স্পেন থেকে যেসব পরিবার রিফিউজি হয়ে আলটাগ্রাসিয়াতে আসে তাদের অনেকের সঙ্গে আর্নেস্তোদের সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল। সীমান্ত পেরিয়ে আলটাগ্রাসিয়াতে আসা একজন ছিলেন ডা. গনজালেজ আগুইলারি। স্পেনিশ গৃহযুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে তিনি পুরো পরিবার নিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে আলটাগ্রাসিয়াতে আসেন এবং আর্নেস্তোদের পাশেই বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করতেন। ১৯৪২ সালের শেষের দিকে লিঞ্চ সেরানা পরিবার আলটাগ্রাসিয়া থেকে করদোবা শহরের চিলি স্ট্রিটের ২৮৮ নম্বর বাড়িটি ভাড়া নেন। এখানেও ডাঃ গনজালেজ আগুইলারি পরিবার ছিল আর্নেস্তোদের প্রতিবেশী এবং আলটাগ্রাসিয়ার মতোই দুই পরিবারের সম্পর্ক অটুট ছিল। আর্নেস্তোদের মতোই চিচিনাদের সঙ্গেও ডাঃ গনজালেজ আগুইলারি পরিবারের সুসম্পর্ক ছিল। আর্নেস্তো তখন করদোবার ডিন ফিউনেস ন্যাশনাল স্কুলের ছাত্র। এ সময় ডাঃ গনজালেজ আগুইলারির মেয়ে কারমেনের বিয়েতে চে গুয়েভারার সঙ্গে চিচিনার প্রথম দেখা। অপূর্ব সুন্দরী চিচিনা পুরো বিয়ে বাড়িতে চোখ না ফেরানোর মতো একেবারেই আলাদা। আর্নেস্তো প্রথম দেখাতেই চিচিনাকে ভালবাসেন। চের বন্ধু এবং চিচিনার চাচাত ভাই-বোনরা ছিল পরস্পরের সহপাঠী। সুন্দরী তরুণী চিচিনাও আর্নেস্তোকে মনপ্রাণ জুড়ে অনুভব করেন। চিচিনা লক্ষ্য করতেন আর্নেস্তোর পড়াশোনা, দর্শন, চিন্তা-চেতনা সব কিছু মিলে আর ক’জন সহপাঠী ছেলের মধ্যে অনন্য। মূলত আর্নেস্তোর ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ চিচিনা অনেক ধনাঢ্য পরিবারের মেয়ে হয়েও একবাক্যে মনের ঘরে একজন করে নিয়েছিলেন। শৈশব থেকেই আর্নেস্তো একটু ভবঘুরে ও বাউন্ডেলে প্রকৃতির ছিলেন। পরিপাটি হয়ে চলা বা ঠিক মতো গোসল করা এগুলো তার স্বভাবে ছিল না বরং নিজের মতো করে চলাফেরায় ছিলেন একেবারেই স্বাধীন। একে তো সামাজিক ব্যাধান অন্যদিকে আর্নেস্তোর অগোছালো চলাফেরার কারণে চিচিনার ধনাঢ্য বাবা দন হোরাচিও ফেরেরা এবং পরিবারের অনেকেই চিচিনার সঙ্গে আর্নেস্তোর বন্ধুত্ব একেবারেই মেনে নিতে পারেননি। তথাপি চিচিনার চাচি, চাচাত ভাই ডোলোরেস মায়ানো মার্টিনসহ ফেরারা পরিবারের অনেকেই আর্নেস্তো ও চিচিনার প্রেমকে মান্য করতেন। বাড়ির পরিবেশ অনুকূলে না থাকায় চিচিনা প্রায় আর্নেস্তোর সঙ্গে দূরে কোথাও একান্তে দেখা করতেন। রিগ্যাতোসো ছিলেন আর্নেস্তোর এক দরিদ্র বন্ধু; সে করদোবার রাস্তায় মিষ্টি ফেরি করে বিক্রি করতেন। ফেরিওয়ালা রিগ্যাতোসো স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, একদিন আর্নেস্তো তার ধনাঢ্য প্রেমিকা চিচিনাকে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছেন এমন সময় রাস্তায় আমার সঙ্গে দেখা হলে আর্নেস্তো পূর্বের মতোই আমাকে জড়িয়ে ধরেন এবং বন্ধু পরিচয় দিয়ে কথা বলেন। চিচিনা দূরে দাঁড়িয়ে থাকলেও আর্নেস্তোর আচরণে আমি মুগ্ধ ছিলাম কারণ ধনাঢ্য প্রেমিকার সঙ্গে থেকেও আর্নেস্তো আমাকে বন্ধু বলে জড়িয়ে ধরতে ভুল করেননি। আর্নেস্তো গুয়েভারা লিঞ্চ এবং সেলিয়া দে লা সেরানা ছেলের বান্ধবী চিচিনার মায়াবী মুখ আর কমনীয়তার প্রশংসা করত। পরিবারের সবাই চিচিনার মতো একটি মেয়ে আর্নেস্তোর জীবনসঙ্গী হিসেবে কামনা করলেও সামাজিক ব্যবধানের কারণে তা অসম্ভব বলে মনে করতেন। আর্নেস্তো নিয়মিত চিচিনা ফেরারদের বাড়িতে যেত। করদোবাতে চিচিনাদের বাড়ি দে কেস্টল ফেরেরায় আসতেন সমাজের ধনাঢ্য অভিজাত মানুষজন। সমাজের সুবিধাভোগী এসব মানুষের সঙ্গে আর্নেস্তোর পোশাকÑআশাক কিছুই সামঞ্জস্য ছিল না। পুরনো জামাÑকাপড় গায় ছন্নছাড়া আর্নেস্তোকে চিচিনার বিলাসী বাবা-মা কখনও মেনে নিতে পারেনি। তথাপি বাবা মায়ের বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে আর্নেস্তো নিয়মিত চিচিনার সঙ্গে দেখা করত। মায়ের অসুস্থতার কারণে ১৯৪৭ সালে আর্নেস্তো গুয়েভারা লিঞ্চ সন্তানাদিসহ করদোবা ছেড়ে বুয়েন্স আয়ার্সের ২১৮০ নম্বর বাড়িতে চলে আসে। অর্থাৎ আর্নেস্তোর কাছ থেকে ৭০০ কিলোমিটার দূরে প্রেয়সী চিচিনা। তথাপি সুযোগ পেলেই প্রদেশ পেরিয়ে ছুটে যেতেন সুদূর করদোবা। অপেক্ষার প্রহর গুণে চিচিনাও প্রিয় মানুষের আশায় থাকতেন। আর্নেস্তো যেমন চিচিনাকে চাইতেন, চিচিনাও মনেপ্রাণে আর্নেস্তোকে ভাবতেন। চিচিনা কামনা করতেন আর্নেস্তো পড়াশোনা শেষ করে ডাক্তারি পেশায় মনোনিবেশ করবেন যাতে তাদের সম্পর্কটা বিয়ের পিঁড়ি থেকে সংসার পর্যন্ত গড়ায়। সব কিছু স্বপ্নের মতোই ছিল কিন্তু অমোঘ সময়ের হাতছানি আর ঐক্যবদ্ধ মানুষের মানচিত্র হাতে তিনি একদিন ঘর ছাড়লেন। বন্ধু আলবার্তো গ্রানাদোকে সঙ্গে নিয়ে আর্নেস্তোর গন্তব্য তখন সমগ্র দক্ষিণ আমেরিকা। ১৯৫১ সালের ২৯ ডিসেম্বর থেকে আট মাসে মোটরসাইকেল লা পোদেরোসায় চড়ে চষে বেড়ান আর্জেন্টিনা, চিলি, পেরু, ইকুয়েডর, কলম্বিয়া, ভেনিজুয়েলা, পানামা এবং মিয়ামি হয়ে পুনরায় আর্জেন্টিনার বুয়েন্স আয়ার্স। ডাক্তার বন্ধু আলবার্তো গ্রানাদোর সঙ্গে মোটরসাইকেল অভিযানের শুরুতে মারদেল প্লাতার উত্তরে ভিইয়া হেসেল থেকে ১৯৫২ সালের ১৩ জানুয়ারি আর্নেস্তো মিরামার আসেন। সৈকত শহর মিরামারের রিসোর্টে বাবা মায়ের সাথে অবসর যাপন করছিল চিচিনা। হাতগুলো হাতের তালুতে মিশিয়ে অজানা পথের বেদুঈন সুখকে বিদায় দিলেন। চিচিনা তার হাতের ব্রেসলেট খুলে স্মৃতিস্বরূপ আর্নেস্তোকে দেন। আপতদৃষ্টিতে চিচিনা আর্নেস্তোর প্রেম এখানেই শেষ হলেও বাস্তবে তা কখনই থেমে ছিল না। অ্যামাজনের গহীন অরণ্য, ব্যস্ত বন্দর অথবা তুমুল বর্ষণের রাতে চিলির গ্রামাঞ্চল সর্বত্র ওই একটা মুখ মনের সরণিতে সুখ ঢেলে গেছে। ইতোমধ্যে আর্নেস্তো নাউয়েল উয়াপি পাড়ি দিয়ে ১৯৫২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি এসে পৌঁছেন রিও নেগ্রো প্রদেশের সান কার্লোস দে বারিলোচে। এ মাসের ১৩ তারিখ আর্জেন্টিনার মাটিতে শেষ দিন পার করে ছুটতে শুরু করবেন চিলির দিকে। বারিলোচ ছাড়ার আগেই আর্নেস্তো চিচিনার এনগেজমেন্টের খবর পায়। সেদিন থেকে আর্নেস্তোর জীবনে চিচিনা গভীর রাতে দূরবর্তী স্বপ্ন আর এক টুকরো ¯িœগ্ধ চুমুর নাম। নেকোচোয়া থেকে কারাকাস। আলবার্তো গ্রানাদো আর আর্নেস্তো গুয়েভারা দু’জন চেনা পথিকের অচেনা পথ আর বৃষ্টিভেজা নিঝুম রাতের ব্যক্তিগত অনুষঙ্গ ছিল সুন্দরী চিচিনা। মিরামারের দেখাই ছিল আর্নেস্তোর সঙ্গে চিচিনার শেষ দেখা। চিলি সীমান্ত পেরুনোর আগেই বারিলোচের চিঠি আর্নেস্তোর চিন্তায় বিচ্ছেদের পেরেক ঠুকে যায়। মেদানোস থেকে দূরের গ্রাম। তুমুল বৃষ্টির রাতে আশ্রিত দু’জন ভবঘুরে অভিযাত্রী। ক্লান্ত আর্নেস্তো তার ডায়েরিতে লেখেনÑ আমার ক্লান্ত চোখ ঘুমাতে চায় না। আমার চারপাশে দুটো সবুজ বিন্দু তারা সেই পৃথিবীর প্রতিনিধি যাকে আমি মৃত বলে জানি। বিপ্লবী আর্নেস্তো চে গুয়েভারাকে নিয়ে নিয়ে একটি অর্থবহ সিনেমা নির্মিত হয় ২০০৪ সালে। ‘দ্য মোটরসাইকেল ডায়েরিজ’ শিরোনামে ছবিটি নির্মাণ করেন ব্রাজিলিয়ান পরিচালক ওয়াল্টার মোরিরা সলস। স্পেনিশ এবং কেচুয়া ভাষায় নির্মিত ছবিটি ২০০৪ সালের ১৫ জানুয়ারি একযোগে বিশ্বের সাতটি দেশে মুক্তি পায়। ছবিতে আর্জেন্টিনায় আর্নেস্তোর পারিবারিক জীবন, প্রেম, দক্ষিণ আমেরিকা ভ্রমণ সবকিছু উঠে এসেছে অকৃত্রিমভাবে। দ্য মোটরসাইকেল ডায়েরিজ ছবিতে চের ভবঘুরে জীবনের অংশ হিসেবে চিত্রায়িত হয়েছে তেমুকো, আতাকামা মরুভূমি, চুকিকামাতা, কুজকো, মাচুপিচু, লিমা, সান পাবলো কুষ্ঠকলোনী, কারাকাস, মিরামার ইত্যাদি স্থান। মূলত এই ছবিতেই আর্নেস্তো এবং চিচিনার প্রেম সেলুলয়েডের ভাষায় বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরা হয়েছে। ছবিতে আর্নেস্তোর চরিত্রে অভিনয় করেছেন মেক্সিকান অভিনেতা গায়েল গার্সিয়া বার্নেল এবং আর্নেস্তোর প্রেয়সি চিচিনা চরিত্রে অভিনয় করেছেন আর্জেন্টিনার নায়িকা ও গীতিকার মিয়া মায়েস্ত্রো। চে গুয়েভারার মৃত্যুর ৩০ বছরেরও বেশি সময় পর ১৯৯৭ সালে যুক্তরাজ্য থেকে প্রকাশিত বই ‘কম্পানেরো : দ্য লাইফ অ্যান্ড ডেথ অব চে গুয়েভারা।’ মেক্সিকান লেখক জর্জ কাস্টেনা গুটম্যানের লেখা বইটিতে আর্নেস্তোর শৈশব থেকে সমগ্র জীবনের জানা-অজানা সব দিকই স্থান পেয়েছে। বইটির দ্বিতীয় অধ্যায়ের র্শিরোনাম হলোÑ মেডিকেল স্কুল, পেরন এবং চিচিনা। এ অধ্যায়ে বহুবছর পর চিচিনার মুখে তাদের হারানো প্রেমের স্বীকারোক্তি তুলে ধরা হয়েছে। চে গুয়েভারার মৃত্যুর বহু বছর পর চিচিনা ১৯৯৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সাংবাদিক ডলোরেস মোয়ানো মার্টিনকে একটি সাক্ষাতকার প্রদান করে। সাক্ষাতকারে চিচিনা চের সঙ্গে তার প্রথম প্রণয় সম্পর্কে কথা বলেন। ১৯৯৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ‘দ্য লাইফ এ্যান্ড ডেথ অব চে গুয়েভারা’ বইয়ের লেখক জর্জ জি কাস্টানিডার সঙ্গে সাংবাদিক ডলোরেস মোয়ানো মার্টিনের কথা হয় ওয়াশিংটন ডিসিতে। এ সময় তিনি লেখককে চিচিনার সঙ্গে সাক্ষাতকারের তথ্য প্রদান করেন। কম্পানেরো : দ্য লাইফ এ্যান্ড ডেথ অব চে গুয়েভারা’ বইয়ের তথ্য মতে, একদিন আর্নেস্তো প্রেমিকা চিচিনাকে বলেছিলÑ আমি নিশ্চিত আমি তোমাকে ভালবাসি, আমি এও জানি তোমাকে আমি খুব ভালবাসি কিন্তু আমি আমার ভেতরের স্বাধীনতাকে ত্যাগ করতে পারব না। এই নিজস্বতা পৃথিবীর সকল মানুষের জন্য জরুরী যা তোমাকে আমি আগেও বলেছি।
×