ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

লসএঞ্জেলসের সোনালি দিনগুলো

প্রকাশিত: ১২:৩৪, ৩০ আগস্ট ২০১৯

লসএঞ্জেলসের সোনালি দিনগুলো

আমেরিকার পঞ্চাশটি অঙ্গরাজ্যের মধ্যে ক্যালিফোর্নিয়া অন্যতম একটি অঙ্গরাজ্য। আবহাওয়ার দিক থেকে চমৎকার একটি স্টেট। শীতকালে তীব্র শীত নয়, আবার গরমকালে অত্যধিক গরম নয়, খুবই সুন্দর আবহাওয়াÑ না শীত না গরম অর্থাৎ নাতিশীতোষ্ণ। আমাদের দেশের বসন্তকালের মতো। শীতকালে মাঝে মাঝে বৃষ্টি হয়। বৃষ্টিতে চলাফেরা করার জন্য ওই সময়টাতে রাস্তা-ঘাটে-দোকানে প্রচুর রং-বেরঙের ছাতা বিক্রি হয়। শীতকালে নিউইয়র্কের মতো ওভারকোট বা ভারি কোন শীতবস্ত্র ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না। গরমের সময়ে দিনের বেলায় কিছুটা গরম থাকলেও রাতের বেলায় শীত শীত অনুভূত হয়। ঘুমানোর সময় একটি পাতলা কম্বল অথবা নিদেনপক্ষে একটি চাদর হলেই চলে। ওদেশে হিউমিডিটি কম বিধায় শীত বা গরমের সময়ে ঘাম হয় না। ফলে একটি শার্ট বেশ কয়েকদিন পরা যায়। ঘরের বাইরে যাওয়ার আগে টিভিতে ওয়েদার ফোরকাস্টিং দেখেই পোশাকÑপরিচ্ছেদ ব্যাপারে প্রস্তুতি নিয়ে বের হতে হয়। ঘন ঘন আবহাওয়া পরিবর্তন হয়। অর্থাৎ ওখানকার ওয়েদার ষোড়শী তরুণীর মনের মতো আনপ্রেডিকটেবল। ফলে সঙ্গে সর্বদাই জ্যাকেট থাকা প্রয়োজন। ওদেশের থ্রিÑডব্লিউ যে কোন মুহূর্তে চেঞ্জ হতে পারে। প্রথম ডব্লিউÑওয়েদার যা ঘন ঘন পরিবর্তন হয়। দ্বিতীয় ডব্লিউÑওয়ার্ক বা চাকরি সকালে আছে বিকেলে নেই অর্থাৎ সকালে হায়ার করা হয়েছিল বিকেলে ফায়ার হয়ে গেছে। তৃতীয় ডব্লিউ ওয়াইফ। ওয়াইফদের ক্ষেত্রেও এমন ঘটনা প্রায়ই লক্ষ্য করা যায়। আজকে আছে কালকে নাও থাকতে পারে। প্রায় দেড়শ’ বছরের পুরাতন শহর হলেও লসএঞ্জেলসের রাস্তা দিয়ে হাঁটলে মনে হয় বাড়িঘর এবং রাস্তাগুলো কয়েকদিন আগে তৈরি হয়েছে। সুউচ্চ পাহাড় সমৃদ্ধ হলিউডনগরী লসএঞ্জেলসের মনোরম শোভা নয়নমন জুড়িয়ে দেয়। পর্যটকের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান হলো লসএঞ্জেলস সিটি। এখানে রয়েছে বিশ্বের নামী-দামী ফিল্মস্টারদের তীর্থস্থান হলিউড। উঁচু পাহাড়ের পাদদেশে বিরাট জায়গাজুড়ে রয়েছে ইউনিভার্সাল স্টুডিও। ফিল্ম তৈরির বিশাল কারখানা। উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে আরটিফিসিয়াল ভাবে তৈরি করা হয়েছে ইনডোরÑআউটডোর শূটিংয়ের সুব্যবস্থা। চিত্তবিনোদনের জন্য এক পূর্বক আর্কষণীয় জায়গা। প্রতিদিন প্রচুর পর্যটকের সমাগম হয়। সারাদিন ঘুরে ঘুরে দেখেও শেষ করা যায় না ইউনিভার্সাল স্টুডিওর সমস্ত আইটেম। শেষ করার একটাই মাত্র উপায় সিলেকটিভ বেসিসে বেশি আকর্ষণীয় আইটেমগুলো দেখা যা ব্রোশিউর পড়ে বুঝে নিতে হয়। পাহাড়সমৃদ্ধ লসএঞ্জেলস শহরের পাহাড়গুলো যেন কোথাও কোথাও বিলীন হয়ে গেছে। উঁচু উঁচু পাহাড় মাঝখান দিয়ে কেটে সুন্দর চওড়া ও মসৃণ রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। শহরের অন্যতম অভিজাত এলাকা ‘বেভারলি হিলস’Ñ পৃথিবীর নামী-দামী ফিল্মস্টারদের বসবাস। নিকটেই ‘রোডিও ড্রাইভ’ নামক স্ট্রিটের দুই পাশে রয়েছে সুসজ্জিত দোকানপাট, সেখানকার জিনিসপত্র ও পোশাকÑপরিচ্ছদ সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে। নামী-দামী ফিল্মস্টার ও সচ্ছল ব্যক্তিরাই এসব দোকানে কেনাকাটা করে থাকেন। বিশাল উঁচু পাহাড়ের পাদদেশ ধরে প্রশান্ত মহাসাগরের তীর ঘেঁষে প্রশস্ত মসৃণ রাস্তায় প্যাসিফিক কোস্ট হাইওয়েতে লং ড্রাইভের আনন্দ অতুলনীয়। একপাশে সাগরের উত্তাল গর্জন, অপরপাশে উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় সুশৃঙ্খলভাবে তৈরিকৃত সাজানো সাদা রঙের বাড়িঘর যা ছবির মতো মনে হয়। সাগরপাড়ে উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় এসব বাড়িঘরে উঁচুস্তরের লোকদেরই বসবাস। লসএঞ্জেলস শহরের পশ্চিমে ওয়েস্ট এলের সান্টামনিকা ও মালিবু বিচসংলগ্ন প্যাসিফিক কোস্ট হাইওয়ে ধরে ভেনচুরা ও সান্টাবারবারার দিকে যাওয়ার সময়ই মনোরম দৃশ্যাবলী দৃষ্টিগোচর হয়। ক্যালিফোর্নিয়া স্টেটে লসএঞ্জেলসের মতো আরও প্রায় চারশ’ পঞ্চাশটি সিটি রয়েছে। প্রবাসী বাংলাদেশীরা ছড়িয়েÑছিটিয়ে বিভিন্ন শহরে বসবাস করে। ক্যালিফোর্নিয়া স্টেটেরই অন্যতম আরও দুটো শহর সানফ্রানসিসকো এবং সানডিয়াগোতে ইদানীং উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাংলাদেশীরা বসবাস করছেন। লসএঞ্জেলস, সানডিয়াগো, সানফ্রানসিসকো এসব শহরে নিউয়র্কের মতো সহজলভ্য ট্রান্সপোর্ট সুবিধা বিশেষ করে সাবওয়ে ট্রেন নেই। অপরদিকে লিভিং স্ট্যান্ডার্ডও হাই। কাজেই এসব শহরে সচ্ছল লোকেরাই বেশি বসবাস করে। প্রায় সবারই একাধিক নিজস্ব ট্রান্সপোর্ট রয়েছে। চমৎকার ওয়েদার বিধায় আমেরিকার অন্যান্য স্টেট থেকে বসবাসের লক্ষ্যে অনেকেই ক্যালিফোর্নিয়া স্টেটের দিকে মুভ করে থাকে। পৃথিবীর প্রায় একÑতৃতীয়াংশ গাড়িই আমেরিকাতে ব্যবহৃত হয়, তন্মধ্যে আবার বেশিরভাগই ক্যালিফোর্নিয়া স্টেটে। ক্যালিফোর্নিয়াকে বলা হয় আমেরিকার ‘গোল্ডেন স্টেট’ যা প্রাকৃতিক দৃশ্য ও আবহাওয়ার দিক থেকে সবচেয়ে সুন্দর স্টেট। আবার আর্থকোয়াক জোনের স্টেটও ক্যালিফোর্নিয়া। পরিষ্কারÑপরিচ্ছন্ন ঝকঝকে ছবির মতো শহর সুন্দরী হলিউড নগরী লসএঞ্জেলসকেই বেশি করে ‘আর্থকোয়াক জোন’ এর শহর হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। মাঝে মাঝেই এই শহরে বড় রকমের ভূকিম্প হয়। ভূমিকম্পের ফলে শহরের বেশকিছু এলাকার বাড়িঘর ধসে ক্ষতি সাধিত হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে ভূমিকম্পকে খুব ভয় পাই। সোনালি এক্সচেঞ্জ লসএঞ্জেলেস শাখায় কর্মরত থাকাকালীন সময় আমি পরপর কয়েকবার মাঝারি ও বড় ধরনের ভূমিকম্পের সম্মুখীন হই যা আমার জীবনে স্মরণীয় ঘটনা হয়ে আছে। প্রথম ঘটনাটি ঘটে ১৯৯৮ সালের অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে যা আমার মনকে সবচেয়ে বেশি নাড়া দেয় ও আতঙ্কগ্রস্ত করে। আমার অফিস লসএঞ্জেলেসস্থ ডাউন টাউনের (অফিসপাড়া) কাছেই ৩২০০ উইলশায়ার ব্লুবার্ড অর্থাৎ উইলশায়ার ও ভারমন্টের ক্রস স্ট্রিটে অবস্থিত। মাত্র দুই মাস হয়েছে লসএঞ্জেলসস্থ সোনালি একচেঞ্জে যোগদান করেছি। বিদেশÑবিভূঁইয়ে এই প্রথম। তদুপরি বিশাল বড় শহর লসএঞ্জেলস একেবারেই অচেনা অপরিচিত। সবই মুগ্ধ চোখে অবাক হয়ে দেখি এবং মনে মনে বাংলাদেশের সঙ্গে তুলনা করি। এ যেন স্বর্গরাজ্য, স্বপ্নের দেশ। অন্যদিকে মনের অবস্থা ভাল নেই। স্ত্রী চাকরিজীবী, সোনালী ব্যাংক প্রধান কার্য়ালয়ে কর্মরত। একমাত্র কন্যা তখন ভিকারুননিসা নূন স্কুলের ছাত্রী। ওদের সংক্ষিপ্ত ছুটি। লসএঞ্জেলস শহরের কেন্দ্রস্থলে ফিফথ ও সিক্সথ স্ট্রিটের মাঝে নিউহ্যামশায়ারে নেয়া আমার নতুন ভাড়া করা বাসা ঝটপট গুছিয়ে দিয়ে স্ত্রী ঢাকায় ফিরে চাকরিতে যোগদান করেছে। কাজেই নিঃসঙ্গতা ও একাকিত্ব আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। তিনতলায় খোলা বারান্দার সঙ্গে আমার এপার্টমেন্ট। সুন্দর সকালের সোনালি রোদ মাত্র রুমে প্রবেশ করেছে। মুগ্ধ হয়ে দেখেছিলাম সুন্দর ছবির মতো শহরটিকে। হঠাৎ করে রুমটা ভীষণভাবে কেঁপে উঠল। থরথর করে কাঁপতে লাগল আমার চেয়ার টেবিলও। প্রথমে ভাবলাম আমার মনের ভুল। তারপরই বাইরে হৈচৈ শুনে নিজেও দৌড়ে বাইরে এলাম। দেখি অনেকেই দৌড়ে এসে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়েছেন। ততক্ষণে কম্পন থেমে গেছে। ভূমিকম্পের সময় লিফটে চড়া বারণ। ভয়ে কাঁপছিলাম। ঘরে ফিরে প্রথমেই লসএঞ্জেলস শহর থেকে প্রায় পঞ্চাশ মাইল দূরে অবস্থিত অন্য আরেকটি শহর ওয়েস্ট কভিনাতে স্থায়ীভাবে বসবাসরত আমার স্ত্রীর বড় বোন রানী আপাকে ফোন করে বিস্তারিত জানলাম। ওনারা কিছুই টের পাননি। রানী আপা ওদেশে চল্লিশ বছর যাবত আছেন। ভূমিকম্প সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। অভ্যস্ততার জন্য তিনি বিষয়টিকে অত গুরুত্বের সঙ্গে নিলেন না। সাহস দিলেন এবং জানালেন লসএঞ্জেলস ভূমিকম্প জোন বিধায় এটি স্বাভাবিক ব্যাপারে হয়ে দাঁড়িয়েছে, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ভবিষ্যতে ভূমিকম্পের সময়ে কি কি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে সে ব্যাপারে কিছু উপদেশÑপরামর্শ দিলেন। ভূমিকম্প সম্পর্কে বিভিন্ন লোকের নিকট থেকে আরও অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে মনকে শক্ত করলাম। বিশেষ করে আমার পরম বন্ধু অত্যন্ত শক্ত মনের মানুষ অবসরপ্রাপ্ত গ্রুপ ক্যাপ্টেন কুদ্দুস কাছাকাছি থাকাতে তার সহযোগিতায় ও পরামর্শে সমস্ত ভয় দুশ্চিন্তা কেটে গেল। কিন্তু মনে মনে ভাবি-
×