ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

নজরুলের চেতনায় নারী

প্রকাশিত: ১২:২৯, ৩০ আগস্ট ২০১৯

নজরুলের চেতনায় নারী

বাংলার সাহিত্য গগনে বিদ্রোহী কবি নজরুলের আবির্ভাব সমকালীন ব্যবস্থার এক জোরালো প্রতিবাদ। অতি বাল্যকাল থেকে গৃহহীন, পিতা হারানো নজরুল জন্মদাত্রী মায়ের সান্নিধ্যকেও সেভাবে নিজের করে নিতে পারেননি। মাতা জাহেদা খাতুনের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েনে ¯েœহ বাৎসল্যের বন্ধন কখনই দৃঢ় হয়নি। বরং মাতৃ¯েœহ থেকে বিচ্ছন্ন নজরুল অন্যত্র মায়ের অভাব পূরণে সচেষ্ট ছিলেন। মা বিরজাসন্দুরী কিংবা শাশুড়ি মাতার কাছে মাতৃ¯েœহের অন্বেষা নজরুলের ছন্নছাড়া জীবনের এক অনবদ্য মিলনগ্রন্থি। তা ছাড়া মিসেস, এম রহমানের সঙ্গে কবি নজরুলের যে মমত্ববোধের বাঁধন ছিল তাও সন্তান বাৎসল্যের সঙ্গে মাতৃ¯েœহের তীব্র আকাক্সক্ষার এক অপরিমেয় শৌর্য। সমকালীন সমাজ ছিল ধর্মের নিগড়ে বাধা এক অচলায়তন ব্যবস্থাই নয় মানুষের সঙ্গে মানুষের ফারাক ছিল পর্বত সমান। আবার এমন সব জগদ্দল পাথরের মধ্যেও দৃষ্টিকটুভাবে যা দৃশ্যমান তা হলো নারী-পুরুষের এক অসম দূরত্ব। সমাজের মৌলিক চাহিদা মেটানোর জন্য নারীদের কোন ধরনের অধিকার কিংবা স্বাধীনতাই ছিল না। তৎকালীন আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক উত্তপ্ত বলয়ের সঙ্গে সন্নিবেশিত হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রলয়ঙ্করী দামামা। এমন এক বেসামাল অস্থির পরিস্থিতিতে নজরুলের শৈশব-কৈশোর পার হয়। সঙ্গত কারণে তৈরি হয়েছেন উন্মত্ত, বিক্ষব্ধ পরিবেশের প্রতি এক বিপ্লবী চেতনা নিয়ে। মাত্র ১৮ বছর বয়সে ছড়িয়ে পড়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধের হাওয়ায় ভারতবর্ষ কেঁপে উঠলে সেই লড়াইয়ে নিজেকে উৎসর্গ করা। সংঘাতপূর্ণ জীবনের পরিক্রমা বিপ্লবী মনস্তত্বে মোড় নিতে সময় নিল না। বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দিয়ে করাচী চলে যাওয়া জীবন সমুদ্রের পালে ভিন্ন মাত্রার হাওয়া লাগানো। সশস্ত্র যুদ্ধের উন্মাদনায় যখন সৈনিক রূপে নিজেকে আত্মপ্রকাশ করলেন সেই মাত্রায় সৃষ্টিশীল উদ্যোমও তাকে তাড়িত করতে থাকে। ফলে সৃজন দ্যেতনায় করাচী বসেই লিখে ফেললেন তাঁর প্রথম গদ্য কল্পনা ‘বাউন্ডেলের আত্মকাহিনী’। কলকাতার ‘সওগাত’ পত্রিকায় প্রকাশিত এই গল্প সারা বাংলায় আলোড়ন তোলে। এখানে মানবিক মূল্যবোধ, দেশপ্রেম এবং বিদ্রোহের যে ভাবসম্পদ গড়ে ওঠে তাতে নজরুল স্বাতন্ত্রিক বৈশিষ্ট্যে অনন্য হয়ে ওঠেন। সমাজ সচেতন নজরুল নিজস্ব দায়বদ্ধতায় অপেক্ষকৃত পিছিয়ে পড়া নারী জাতিকে যেভাবে তার সাহিত্যের নিভৃত আঙিনায় অভাবনীয় করে তোলেন তাও সময়কালীন প্রতিবেশের এক বিদগ্ধ চিত্র। এই গল্পের গভীরে গেঁথে আছে তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার এক অভিশপ্ত ধারা পণ-প্রথার করুণ কাহিনী। নায়ক একজন শিক্ষার্থী। কিন্তু বাবা-মা যৌতুকের বিনিময়ে তেরো বছরের কিশোরী রাবেয়ার সঙ্গে গল্প কথকের পরিণয় সূত্র অনিবার্য করলে হতভাগ্য সন্তান তা মেনে নিতে বাধ্য হয়। পাত্র-পাত্রী নির্বাচনে সংশ্লিষ্টদের কোন মতামতকে কখনও গ্রাহ্য করা হতো না। শিক্ষার্থী নায়ক পরীক্ষার কারণে কলেজে চলে গেলে দুঃখে, হতাশায়। বিরহে রাবেয়া মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। কিন্তু পাষ- শ্বশুর মহাশয় ছেলেকে আবারও বিয়ে দেন সেই পণ-প্রথার আবর্তে। নতুন করে সংসার পাতা হলো সখিনার সঙ্গে। কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর দূরত্ব নিকটতম হওয়ার আগেই সখিনাও পরপারে চলে যায়। জীবনের এমন করুণ আখ্যানের সঙ্গে মোকাবেলা করতে গিয়ে নায়কের পড়াশোনারও বারোটা বাজে। বিক্ষব্ধ পিতা শেষ অবধি সন্তানকে ত্যাজ্য করতেও দ্বিধা করেনি। সৈনিক নজরুলের কি অসাধারণ সমাজ পর্যবেক্ষণ। তৎকালীন সামাজিক কঠিন অবয়বে নারী-পরুষ দ্বৈত ভাবেই তার নিঃশর্ত বলি হতে সময় নিত না। নজরুল সেই যে শুরু করলেন সমাজের অসম ব্যবস্থাপনার করুণ চিত্রায়ন সুস্থির এবং সৃজন শক্তির শেষ অবধি তার কখনও ব্যত্যয় ঘটেনি। ১৯১৯ সালে এই গল্প দিয়ে সৃষ্টি দ্যোতনার যে সমৃদ্ধ দ্বার উন্মোচন করলেন তার গতিপ্রবাহ কতখানি অবারিত, মুক্ত এবং মানবিকতার অনুষঙ্গ ছিল সেটা সময়ই যথাযথভাবে প্রমাণ করে দেয়। শুধু ধর্ম নয়, জাতি, বর্ণ আর বিত্তের ফারাকে উৎকণ্ঠিত, উদ্বেলিত নজরুল আরও সূক্ষ্মভাবে অনুধাবন করলেন নারী-পুরুষের অসম ব্যবধান সমাজের গভীরে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে আছে, তাকে সজোরে আঘাত করতে না পারলে যথার্থভাবে কোন মুক্তিই জাতির মঙ্গল আনবে না। দীপ্ত কণ্ঠে জানান দিলেন জাতির এই অর্ধাংশ কিন্তু পশ্চাদপদ গোষ্ঠীকে সব ধরনের অধিকার দিতে না পারলে আমরা সবাই কখনও সঠিকভাবে এগুতে পারব না। অবরোধবাসিনী নারীদের ঘরের অর্গল খুলে নিজেদেরই বের হয়ে আসতে হবে। কঠোর পর্দাপ্রথা যেভাবে নারীর স্বাধীন চলার পথকে বার বার ব্যাহত করছে তাকে ভেঙ্গে চুরমার করে দিতে হবে। আপন শক্তি আর উদ্যোমে অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে নিজেদেরই সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে। নজরুল মনে করতেন শিক্ষা থেকে আরম্ভ করে সৃজন দ্যোতনা বিকাশের স্বাধীনতাও নারীদের প্রাপ্য। বিদ্রোহী কবি বিশ্বাস করতেন যে ধর্ম মানুষের জন্য, যে বিধাতা মানবতার কল্যাণে সব কিছু তৈরি করেছেন তার বিধান কখনও অন্য কাউকে ছোট করতে পারে না। সুতরাং সমাজের মধ্যে ভেদ-বুদ্ধি যেমন অসঙ্গত একইভাবে নারী সমাজকে পশ্চাদবর্তী করে রাখা সেটাও কোন ভাবেই সুস্থ স্বাভাবিক অবয়ব নির্দেশ করে না। ঘর থেকে বাইরে এসে নারীরা শিক্ষা গ্রহণে ব্রতী হবে, নিজের মতামত যাচাইয়ের সর্ববিধ অধিকার পাবে, তাদের মধ্যে যদি কোন মানসিক বিকাশের সুযোগ থাকে সেখানেও তাদের কর্মদক্ষতা দেখিয়ে যেতে হবে। তিনি মনে করতেন মেয়েরা শুধু ঘরের লক্ষ্মীই নয় সমাজের হরেক রকম কর্মদ্যোতনার সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত যদিও তাদের সেভাবে মূল্যায়ন করা হয় না। নারীরা কৃষি কাজে স্বামীর সহযোগী হয়, বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে তাদের একাত্মতা এবং প্রেরণায় সমাজ দীপ্তভাবে এগিয়েও যায়। কোন কালে একা হয়নিক জয়ী পুরুষের তারবারি, প্রেরণা দিয়েছে, সাহস দিয়েছে বিজয় লক্ষ্মী নারী। শুধু কবিতায় নয় অসংখ্য প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস এবং বিভিন্ন কর্মযোগে নারী শক্তির যে বন্দনা কবির সৃজন আঙিনায় মুখরিত হয়ে ওঠে তা আজও যুগের চাহিদায় প্রাসঙ্গিক এবং অপরিহার্য। গল্প-উপন্যাসে নারী চিত্র রূপায়ণে কবি বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থার যে অসঙ্গতি নিরূপণ করেন সময়ের দুর্বার মিছিলে আজও তার যুগান্তকারী আবেদন শেষ হয়ে যায়নি। নারীরা সামাজিক অপসংস্কার থেকে এখনও সেভাবে মুক্ত হতে পারেনি। মুষ্টিমেয় সফলকাম নারী ব্যক্তিত্ব পুরো সমাজ ব্যবস্থার প্রতিনিধিত্ব করে না। ফলে সিংহভাগ নারী আজ যেখানে সভ্য সমাজের আলোকিত জগত থেকে নিরাপদ দূরত্বে কোনমতে টিকে আছে, তারা আজও নির্যাতন-নিপীড়নের নৃশংস শিকার। আধুনিকতার বিস্তর বলয় এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ নারীকে সুরক্ষা দিতে হিমশিম খাচ্ছে। নারীদের অধিকার এবং কর্মপ্রবাহ সেভাবে মূল্যায়ন, স্বীকৃতি কিংবা যথার্থ অধিকারের আলোকে বিচার ও করা হয় না। নজরুল মনে করতেন বেগম রোকেয়ার মতো নারী জাগরণের চেতনা সব নারীর মধ্যে সঞ্চারিত হতে না পারলে এমন মুক্তি সুদূর পরাহত হবে। শুধু শিক্ষা নয় কর্ম ও সৃষ্টিশীল কার্যক্রমে সব নারীকে বোধে, চেতনায় জেগে উঠতে হবে। সৃজনশীল ক্ষমতাকে নিয়ত শাণিত করতে হবে। এ শুধু কবির কথার কথা নয়। বাস্তব কর্ম যাগে তার প্রতিফলনও দেখা যায়। যেমন তাঁর ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় মেয়েদের লেখার জন্য ‘সন্ধ্যাপ্রদীপ’ নামে একটি জায়গা রাখা হতো। যেখানে তাদের নিজস্ব চিন্তা, ধ্যান-ধারণা, মুক্তির বারতার ওপর বিভিন্ন বিষয়ে লেখা যেত। লেখা আসত এবং কবি নির্দ্বিধায় তা ছাপাতেনও। মিসেস এম রহমানের লেখা তো নিয়মিতই প্রকাশ পেত। সমকালীন আঙিনা উত্তপ্ত হতেও সময় লাগত না। শুধু যে পুরুষরা এর প্রতিপক্ষ ছিলেন তা কিন্তু নয় অনেক রক্ষণশীল মহিলাও এসব লেখার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে উঠতেন। তৎকালীন সময়ে এমন ধারণাই প্রচলিত ছিল যে, ‘সন্ধ্যাপ্রদীপে’ নারীরাই পক্ষে, বিপক্ষে, বিতর্কে, মতদ্বৈততায় নিয়োজিত থাকতেন। এভাবে নজরুলের সৃজন চেতনায় নারীর সামগ্রিক বিকাশ সম্প্রসারিতভাবে ছড়িয়ে পড়ত। সেটা মননশীল শৌর্য আর সৃষ্টিশীল পারদর্শিতা যেখানেই হোক না কেন। নারীর প্রতি অপরিসীম সহনশীল এই সংগ্রামী প্রাণপুরুষ নারীকে তার যথার্থ সম্মান দিয়েও তাদের অধিকার হরণকেও অত্যন্ত কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যাত করেছেন। নারী শক্তির পূজারী এই বিপ্লবী মহানায়ক আন্দোলন আর লড়াইয়ে আমলে নিয়ে তাদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা জীবনের অনুগামী করতে সব সময়ই পরামর্শ দিতেন। ভাবতেন পুরো একটি অংশের অর্ধেকই যদি অজ্ঞানতার অন্ধকারে ডুবে থাকে তাহলে সমাজ ব্যবস্থায় আলো বিকিরণ হতে অনেক বেশি সময় লাগবে।
×