ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

শাহরিয়ার কবির

কাশ্মীর কোন পথে

প্রকাশিত: ০৮:৪৪, ৩০ আগস্ট ২০১৯

কাশ্মীর কোন পথে

॥ পনেরো ॥ একুশ তারিখ সন্ধ্যের পর আমার সঙ্গে কাটাবার জন্য এহসান ছুটি নিয়েছিল। ওকে বলেছিলাম খাঁটি কাশ্মীরী ডিনার করব, ওর কথা শুনব। অনেক ঘুরে একটা বনেদি রেস্তোরাঁ পাওয়া গেল। কাশ্মীরে মাছ খুব কম পাওয়া যায়। কাশ্মীরীরা খেতে পছন্দ করে মাংস। মাংস মানে ভেড়ার, কাশ্মীরীরা গরু খায় না। সবচেয়ে প্রচলিত এবং জনপ্রিয় মাংসের যে রান্না তার নাম গুস্তাভা। প্রায় টেনিস বলের সাইজের মাংসের কোপ্তা ভেজে ঝোল দিয়ে রাঁধা। ঝোলের মসলার ভেতর বাদাম-আখরোট বাটা আছে, ঘন দুধের ক্রিম আর জাফরান আছে। কোপ্তার মাংস খুব মিহি করে বাটা, মুখে দিতেই মিলিয়ে যায়। অতি উপাদেয় খেতে। এহসান বলল, ‘উত্তর ভারতীয়দের ভেতর কাশ্মীরীরা রুটি পছন্দ করে না। তারা ভাত খায়। ওকে বললাম, ‘এত অপূর্ব গন্ধ আর স্বাদের ভাত থাকতে রুটি খেতে হবে কোন দুঃখে!’ খেতে খেতে এহসান নিজের কথা বলছিল। বাবার অমতে সাংবাদিকতা পড়েছে। এখনও বিয়ে করেনি। রসিকতা করে বললাম, এই চেহারা নিয়েও ইউনিভার্সিটির কোন মেয়ের নজর কাড়তে পারেনি এটা একটা কথা হলো?’ গম্ভীর স্বভাবের এহসান বলল, ‘আমি যে ধরনের মেয়ে পছন্দ করি সে রকম মেয়ে ইউনিভার্সিটিতে চোখে পড়েনি।’ ‘তোমার না হয় চোখে পড়েনি। তুমিও কি কারও চোখে পড়নি?’ ‘কয়েকজনই ঘনিষ্ঠ হতে চেয়েছিল। ওরা খুবই মামুলি ধরনের।’ ‘তোমার কী রকম পছন্দ?’ ‘ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হতে হবে। আত্মমর্যাদাবোধ থাকতে হবে।’ ‘সুন্দরী না হলেও চলবে?’ ‘কাশ্মীরে ওটা কোনও সমস্যা নয়।’ মৃদু হেসে বলল এহসান। রাজনীতি নিয়ে আলোচনা এহসান খুব একটা পছন্দ করে না। খুব কম ক্ষেত্রেই নিজের মত দিচ্ছিল। খাওয়া শেষ হওয়ার পরও কথা বলা শেষ হচ্ছিল না। আমিই শেষ করতে চাইনি। এহসান হঠাৎ বলল, ‘তুমি কি খুব ধর্মপরায়ণ?’ ‘মোটেই না। কেন বলতো?’ ‘আমি যদি ভিন্নধর্মী কোন মেয়েকে বিয়ে করি কেমন হবে?’ ‘খুবই ভাল হবে এহসান। আমি খুবই খুশি হব। সে রকম কারও কথা কি ভেবেছ?’ কিছুক্ষণ চুপ থেকে এহসান বলল, ‘মেয়েটা জম্মু থাকে। ফ্যাশন ডিজাইনার। গত বছর পরিচয় হয়েছে। যথেষ্ট ব্যক্তিসম্পন্ন মেয়ে। ও আমাকে পছন্দ করে বুঝতে পারি। আমি এখনও কিছু বলিনি। মেয়েটা হিন্দু।’ ওকে উৎসাহ দিয়ে বললাম, ‘এসব কাজে দেরি করতে নেই। আজই টেলিফোনে প্রপোজ কর।’ এহসান একটু হেসে বলল, ‘অক্টোবরে জম্মুতে একটা ফ্যাশন শো আছে। তখন যাব।’ ‘প্রপোজ করবে তো?’ ‘বলছো যখন করেই ফেলব।’ ‘বিয়েতে দাওয়াত দিতে ভুলো না।’ ‘দাওয়াত নিশ্চয়ই করব। তবে ভাবী আর বাচ্চাদেরও আনতে হবে।’ কাশ্মীরে জঙ্গী তৎপরতা শ্রীনগরের সাংস্কৃতিক জীবনকেও বিপর্যস্ত করে ফেলেছে। জম্মুতে ফ্যাশন প্যারেড হতে পারে, কিন্তু শ্রীনগরে তা সম্ভব নয়। মুজাহিদীনরা বলেছে মেয়েদের সব বোরখা পরতে হবে। শ্রীনগরের রাস্তায় খেটে খাওয়া মহিলা ছাড়া মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত মহিলাদের অধিকাংশই বোরখা পরা। স্কুল-কলেজের মেয়েরা বোরখা না পরলেও ওড়না মাথায় দিতে ভোলেনি। কয়েক হাজার বছরের পুরনো জনপদ শ্রীনগরে এখন কোনও সাংস্কৃতিক সংগঠন নেই, নাটকের দল নেই, গানের দল নেই। কণ্ঠশিল্পী আছেন কয়েকজন, বেতারে গান করেন, ওদের ক্যাসেটও পাওয়া যায়। এহসানের কাছে শুনেছি হাবা খাতুনের নাম। চারশ’ বছর আগেকার এই কবি ও গায়িকার গান আজও জনপ্রিয়। এহসান ওর গানের ক্যাসেট কিনে দিয়েছে। আধুনিক কাশ্মীরী সাহিত্যের প্রধান কবি গুলাম আহমদ মাহ্জুর (১৮৮৭-১৯৫২), যিনি শুধু মাহ্জুর নামে বিখ্যাত। এহসান বলল, বাংলায় যেমন রবীন্দ্রনাথ, উর্দুতে ইকবাল, কাশ্মীরী ভাষায় তেমনি মাহ্জুর। অনেক খুঁজে মাহ্জুরের কবিতার ইংরেজী অনুবাদের একটা সংকলন এনে দিয়েছে এহসান। অনুবাদ করেছেন ভারতের প্রাক্তন পররাষ্ট্র সচিব টি এন কল, যাঁর সাক্ষাতকার নিয়েছিলাম দুই যুগ আগে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর। টি এন কল নিজেও কাশ্মীরী। সেই সময় ভারতের নীতি নির্ধারকদের অনেকেই ছিলেন কাশ্মীরী। টি এন কল ছাড়াও তখন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রধান পরামর্শকদের ভেতর ডিপি ধর, পিএন হাকসার, আরএন কাও-এর নাম উল্লেখ করা যায়Ñ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন, তারা সবাই ছিলেন কাশ্মীরী। দিল্লীতে মৌলবাদীদের হাতে নিহত প্রখ্যাত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সফদর হাশমীও কাশ্মীরী। শিক্ষকতার ক্ষেত্রে কাশ্মীরী প-িতরা সারা ভারতের ভেতর সবার ওপরে রয়েছেন। ভারতবর্ষের প্রথম ঐতিহাসিক হিসেবে স্বীকৃত পণ্ডিত কলহন কাশ্মীরের সন্তান। তাঁর লেখা ‘রাজতরঙ্গিনী’ (১১৪৮) কাশ্মীরের ইতিহাস এবং তাঁর সমকালীন সমাজের অসাধারণ বিবরণ রয়েছে। কাশ্মীরের মানুষ সম্পর্কে কলহনের পর্যবেক্ষণ হচ্ছেÑ ‘কাশ্মীরকে আধ্যাত্মিক শক্তির দ্বারা জয় করা সম্ভব, কিন্তু তলোয়ারের দ্বারা অসম্ভব।’ নয়শ’ বছর আগে কলহনের এই মন্তব্য কাশ্মীরীয়াতের বৈশিষ্ট্য। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় বলপ্রয়োগ করে যারাই কাশ্মীর দখল করতে চেয়েছে তারা ব্যর্থ হয়েছে। অনেক কাশ্মীরী বুদ্ধিজীবী আমাকে বলেছেন, কাশ্মীরীয়াৎ কখনও মৌলবাদ অনুমোদন করেনি। আবার ড. করণ সিং-এর মতো অনেকে এ বিষয়ে যথেষ্ট সন্দিহান। ২০০১ সালে কাশ্মীরের ওপর বই লেখার উপকরণ সংগ্রহের জন্য তৃতীয়বার যখন জম্মু-কাশ্মীরে যাই তখন ‘গ্রেটার কাশ্মীর’-এর তরুণ সাংবাদিক বন্ধু এহসান চিশতি অবাক করা খবর দিয়েছিল। কাশ্মীরে বিজেপির প্রভাব বাড়ছে এবং মুসলমানদের অনেকে বিজেপির দিকে ঝুঁকছে এই তথ্য জানিয়ে আমাকে প্রশ্ন করেছিল, তুমি কি জান জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যে বিজেপির সাধারণ সম্পাদক একজন মুসলিম মহিলা? আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘না জানি না। কে তিনি?’ এহসান তার নাম বলেছিল, নাসিম বেগম। থাকেন জম্মুতে। শ্রীনগর থেকে জম্মু গিয়ে সেবার সবার আগে কথা বলেছিলাম নাসিম বেগমের সঙ্গে। জানতে চেয়েছিলাম, একজন মুসলমান হয়ে তিনি কেন বিজেপি করেন? জবাবে তিনি তার জীবনের যে মর্মন্তুদ অভিজ্ঞতার কথা বললেন তা কাশ্মীরে জঙ্গীবাদ এবং বিজেপির জনপ্রিয়তা বোঝার ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ১৯৮৯ সালের পর কাশ্মীরে পাকিস্তান থেকে আসা জঙ্গী মৌলবাদীদের আক্রমণের প্রথম লক্ষ্য ছিল কাশ্মীরের হিন্দু জনগোষ্ঠী। কাশ্মীর হিন্দুশূন্য হলে এই রাজ্যটির পাকিস্তানীকরণ এবং পাকিস্তানের সঙ্গে সংযুক্তকরণ সহজ হবেÑ এটাই ছিল তাদের রণনীতি। সে সময় শ্রীনগর থেকে ৯০ কিলোমিটার দূরে এক গ্রামে থাকতেন নাসিম বেগম, তার স্বামী ও তিন শিশু সন্তানসহ। জঙ্গীরা একদিন গ্রামে এসে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সবার জন্য চাঁদা ধার্য করে। নাসিম বেগমের স্বামী জঙ্গীদের চাঁদা দিতে অস্বীকার করায় তাকে জঙ্গীরা ধরে নিয়ে যায়। ওরা নাসিম বেগমদের কাছে তিন লাখ টাকা চেয়েছিল। স্বামীকে জঙ্গীদের আস্তানা থেকে ছাড়িয়ে আনার জন্য নাসিম কয়েকবার ওদের কাছে গিয়েছিলেন। প্রত্যেকবার একই জবাব পেয়েছেন। অনেক দুয়ারে ঘুরে নাসিম এক লাখ টাকা জোগাড় করে ডিসেম্বরের এক প্রচ- শীতের সকালে জঙ্গীদের আস্তানায় গিয়েছিলেন। সঙ্গে তার তিন শিশু পুত্রকে নিয়েছিলেন যদি জঙ্গীদের করুণা হয়। জঙ্গীরা এক লাখ টাকা রেখে বলেছে বাকি দুই লাখ দিয়ে তার স্বামীকে নিয়ে যেতে। নাসিম বেগম ক্ষুব্ধ হয়ে কিছু কথা বলেছিলেন। ধর্মের দোহাই দিয়েছিলেন। জঙ্গীরা এর জবাব দিয়েছে নাসিমের তিন ছেলেকে তার সামনে বেধড়ক পিটিয়ে। তার বড় ছেলেটিকে ওরা বরফজমা ঠা-া পানিতে চুবিয়ে রেখেছে। তার পর থেকে ও শ্রবণশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। কাঁদতে কাঁদতে নাসিম বেগম ঘরে ফিরেছেন। সেই রাতেই তিনি কাশ্মীর ছেড়ে জম্মু এসে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন। শিবিরে হিন্দু শরণার্থীরা নাসিম বেগমের নির্যাতনের কথা শুনে সবাই মিলে দুই লাখ টাকা জোগাড় করে দিয়েছে। সেই টাকা জঙ্গীদের দিয়ে তিনি তার স্বামীকে ওদের বন্দীশিবির থেকে মুক্ত করেছেন। এরপর তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে তিনি লড়বেন। তার নির্যাতনের কথা এবং ইসলামের নামে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সবাইকে বলবেন। নাসিম বেগম বলেছেন, এর জন্য আমার একটা রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম দরকার ছিল। আমি প্রথমে ন্যাশনাল কনফারেন্সের সঙ্গে কথা বললাম। তারা আমার কথা শুনে রাজি হয়নি। এরপর কংগ্রেসের সঙ্গে কথা বললাম, সেখানেও জায়গা পেলাম না। তারপর গেলাম তারিগামী সাহেবের কাছে (ইউসুফ তারিগামী জম্মু-কাশ্মীরের সিপিএম-এর বিধায়ক), তিনিও রাজি হলেন না। শরণার্থী শিবিরে আমার হিন্দু ভাইরা বলল, তুমি বিজেপির কাছে যাচ্ছ না কেন। আমি বিজেপির কাছে গেলাম। নেতারা শুনে বললেন, বিজেপি আপনার দল। জঙ্গীদের বিরুদ্ধে যত খুশি আপনি বলুন। সেই থেকে বিজেপিতে আছি। এখন আমি দলের সাধারণ সম্পাদক। জঙ্গীদের চেয়ে কোরান হাদিস আমি কম পড়িনি। ওরা যা করছে এর সঙ্গে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। আমাকে নাসিম বেগম জিজ্ঞেস করেছিলেন, শ্রীনগরে কাদের সঙ্গে কথা বলেছেন? সব রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে কথা হয়েছে। এমনকি জঙ্গীদের গডফাদার জামায়াতে ইসলামীর আলী শাহ গিলানীর (কেউ কেউ জিলানী বলেন) সঙ্গেও কথা বলেছি। গিলানীর কথা শুনে নাসিম বেগম হেসে ফেললেনÑ ‘ইয়ে গিলানী সাব কো ম্যায় দিল্লী মে মিলা থা। ম্যায় উনকা দাড়ি পাকাড়কে পুছাÑ এই বলে তিনি যা বললেন সেটা দাড়ি ধরে টানার মতো হাস্যকর ছিল না। জামায়াত নেতাকে তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, গিলানী সাহেব, আপনারা যে জিহাদের কথা বলছেন, এটা কোন ধরনের জিহাদ? আমাদের মতো গরিব মানুষের সন্তানদের আপনারা বলছেন, মাদ্রাসায় পড়ো, জিহাদ করো, শহীদ হও; অথচ নিজেদের সন্তানদের আপনারা সব কিছু থেকে নিরাপদ রেখেছেন, বিলেতে, আমেরিকায় পাঠাচ্ছেন পড়ার জন্য, চাকরি করার জন্য। আমাকে আপনার বলতে হবেÑ এটা কোন ধরনের জিহাদ, কোন ধরনের ইসলাম? আমি জানতে চাইলাম, আপনার কথা শুনে গিলানী সাহেব কী বললেন? ‘অউর কেয়া বোলে গা? খামোশ রাহা!’ (ক্রমশ.)
×