ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সঙ্গীতস্রষ্টা নজরুল

প্রকাশিত: ০৮:৪১, ৩০ আগস্ট ২০১৯

সঙ্গীতস্রষ্টা নজরুল

কালজয়ী সঙ্গীতস্রষ্টা কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মেতে রচনা করেন প্রায় সাড়ে তিন হাজার গান। এই অনন্যসাধারণ সৃষ্টি বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকের শুরু থেকে চল্লিশের দশকের প্রথমাবধি সঙ্গীত-রসসন্ধানীদের মাতিয়ে তোলে। সাহিত্য ও সঙ্গীতের ক্ষেত্রে নজরুলের আগমন প্রকৃত অর্থে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে। তিনি সুস্থ ছিলেন ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। এই হিসেবে তাঁর সৃষ্টিশীল জীবন মাত্র তেইশ বছরের। এই স্বল্প সময়ের মধ্যে কাব্য, উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ, অনুবাদ, নাটক, চলচ্চিত্র, পত্রিকা ইত্যাদির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত থাকার পরও সঙ্গীতের ক্ষেত্রে তিনি রচনা করেন ধ্রুপদ, খেয়াল, টপ্পা, ঠুংরি, রাগপ্রধান, স্বদেশী, গজল, মডার্ন বা আধুনিক, ইসলামী, কীর্তন, বাউল, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, ঝুমুর, ভজন, শ্যামা, হোরি, কাজরি, ঋতুভিত্তিক, নৃত্য-সংবলিত, অর্কেস্ট্রা-সংবলিত, হিন্দী, হাসির গান, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির গান। সব মিলিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ের প্রায় সাড়ে তিন হাজার গান, যরি শীর্ষ ভাগ গানের সুরকার তিনি নিজেই। উল্লেখ্য, ১৯২৮ থেকে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় পনেরো বছর তিনি ছিলেন গ্রামোফোন, বেতার, চলচ্চিত্র ও মঞ্চ এই চারটি প্রচার মাধ্যমের অন্যতম প্রধান সঙ্গীতস্রষ্টা। পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে দেশকে মুক্ত করার লক্ষ্যে গণজাগরণ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে দেশাত্মবোধক সঙ্গীতের ক্ষেত্রে তখন গভীর শূন্যতা বিরাজ করছিল। তিনি সে শূন্যতা পূরণে সমর্থ হন। বীররসের এক অভূতপূর্ব ব্যঞ্জনায় তাঁর দেশাত্মবোধক গান সকলকে উদ্দীপ্ত করে। তাঁর সঙ্গীতের আত্মবিসর্জনকারী আহ্বান ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর!’, ‘কারার ঐ লৌহ-কপাট’, ‘মোরা ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম’ ইত্যাদি। পরাধীনতার বিরুদ্ধে এই গানগুলো ছিল নজরুলের সংগ্রামমূলক গান। এ ধরনের গানে সঙ্গীতরচয়িতা হিসেবে তাঁর প্রতিভার সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটে। দেশপ্রেমের মাধুর্যম-িত গান রচনার ক্ষেত্রেও তাঁর সাফল্য উল্লেখযোগ্য। যেমনÑ ‘একি অপরূপ রূপে মা তোমায়’, ‘ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি আমার দেশের মাটি’ ইত্যাদি। আবার অবহেলিত, শোষিত, লাঞ্ছিত, নিপীড়িত মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের জন্য নজরুলের আহ্বান: ‘ওঠ্ রে চাষী জগদ্বাসী’ (‘কৃষাণের গান’), ‘জাগো অনশন বন্দী ওঠ রে যত’ (‘অন্তর-ন্যাশনাল সঙ্গীত’), ‘ওরে ধ্বংসপথের যাত্রী দল! (‘শ্রমিকের গান’) ইত্যাদি। এভাবেই কাজী নজরুল ইসলাম নারী জাগরণমূলক গান ‘জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখা’ ইত্যাদি, মুসলিম জাগরণমূলক গান ‘জাগে না সে জোশ লয়ে আর মুসলমান’, ‘ধর্মের পথে শহীদ যাহারা’ ইত্যাদি, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রামমূলক গান ‘মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান’, ‘ভারতের দুই নয়নতারা’ ইত্যাদি রচনা করেছেন। ধর্মের নামে গোড়ামির বিরুদ্ধে তিনি রচনা করেছেন ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব’ ইত্যাদি গান। এরপরই নজরুল সৃষ্টি করেন কোমল মধুর গজল গান। কবির গজল গানের রসে বাঙালী শ্রোতাচিত্ত অভিষিক্ত হলো এবং বাংলা গানের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হলো। তিনি বিভিন্ন ধরনের প্রচুরসংখ্যক গজল গান রচনা করেন। যেমন- ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই’, ‘চেয়ো না সুনয়না আর চেয়ো না’, ‘এ কোন মধুর শরাব দিলে’ ইত্যাদি। গ্রামোফোন কোম্পানিতে যোগদানের পর থেকে নজরুলের গান শত-সহস্র ধারায় বিকশিত হয়ে উঠল। বাংলা গানের একচ্ছত্র নায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন নজরুল। নজরুলের অবতীর্ণ হওয়ার প্রাক্কালে কেবল দেশাত্মবোধক গানের ক্ষেত্রেই নয়, প্রেমসঙ্গীত, ভক্তিসঙ্গীত, রাগপ্রধান ইত্যাদি গানের ক্ষেত্রেও বিরাজ করছিল এক প্রকার শূন্যতা। সেই শূন্যতা পূরণে এগিয়ে এলেন নজরুল এবং অবতীর্ণ হওয়া মাত্র তিনি ব্যাপকভাবে অভিনন্দিত হন। কাজী নজরুল ইসলামের প্রেমের গান বা আধুনিক গান যথার্থই সাধারণ মানুষের হৃদয়ের সঙ্গীতে পরিণত হয়। নজরুলের আধুনিক গান সহজেই উপলব্ধিযোগ্য হওয়ায় এই গানের সুর সহজেই শ্রোতার মনকে চঞ্চল করে তোলে, আন্দোলিত করে। সবার মতো হওয়ার সকল উপাদানই তাঁর গানে বর্তমান। এ কারণে প্রচার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নজরুলের আধুনিক গান প্রবল বেগে মানুষের হৃদয়কে জয় করতে সমর্থ হয়। যেমনÑ ‘তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়’, ‘আমায় নহে গো ভালোবাস শুধু’, ‘নয়ন ভরা জল গো তোমার’, ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রানী’ ইত্যাদি। বাংলা ভক্তিসঙ্গীতের সমৃদ্ধি সাধনের ক্ষেত্রেও নজরুলের অবদান অপরিসীম। কবি-রচিত প্রথম ইসলামী গান হলো ‘বাজলো কি রে ভোরের সানাই’। উল্লেখ্য, বাংলা ভাষায় ইসলামী গানের প্রথম রেকর্ড (এন ৪১১১) প্রকাশিত হয় ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে। এই রেকর্ডে নজরুল-রচিত গান দুটি হলোÑ ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে’ ও ‘ইসলামের ঐ সওদা লয়ে’। ইসলামী গান রচনার পাশাপাশি হিন্দু ধর্মসঙ্গীতের ধারায়ও নজরুলের রচনা ঈর্ষণীয় হয়ে ওঠে। তিনি এ ধর্মের বিভিন্ন পর্যায়ের গান রচনা করে সকলকে চমৎকৃত করেন। যেমনÑ ‘আয় মা উমা রাখব এবার’, ‘মহাবিদ্যা আদ্যাশক্তি পরমেশ্বরী কালিকা’, ‘বল্ রে জবা বল’্, ‘আমার কালো মেয়ের পায়ের তলায়’, ‘তুমি যদি রাধা হতে শ্যাম’, ‘মহাকালের কোলে এসে’, ‘ভগবান শিব জাগো জাগো’, ‘ব্রজ-গোপী খেলে হোরী, ‘রাই বিনোদিনী দোলো ঝুলন দোলায়’ ইত্যাদি। রাগপ্রধান বাংলা গানের ক্ষেত্রেও যুগপ্রবর্তকের ভূমিকা পালন করেন নজরুল। তবে এ-কথা বলা যায় যে, রাগসঙ্গীত বরাবরই বাংলা গানকে ঐশ্বর্যম-িত করেছে। সঙ্গীতের ক্ষেত্রে নজরুলের অবতীর্ণ হওয়ার কিছু আগে বাংলা গানে, বিশেষ করে রবীন্দ্রসঙ্গীতে-এর ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায়। কেননা রবীন্দ্রনাথ তাঁর ধ্রুপদ, খেয়াল, টপ্পা প্রভৃতি অঙ্গে গান রচনা করলেও বাণীর ক্ষেত্রে রাগ সঙ্গীতের সুরের কাঠামোটি গ্রহণ করলেও, সুর-বিস্তারের বিষয়টি তিনি এড়িয়ে গেছেন। ফলে রাগ সঙ্গীতের প্রকৃত রূপায়ণ রবীন্দ্রসঙ্গীতে ঘটেনি। কিন্তু রাগপ্রধান বাংলা গানে রাগ সঙ্গীতের সুরভা-ারকে নজরুল উজাড় করে এনে গ্রথিত করতে সমর্থ হন। ফলে বাংলা গানে ঐতিহ্যের বহুমুখীকরণ ঘটে। রাগ সঙ্গীতে যেমন আলাপ, বিস্তার, তান, সরগম রয়েছে, বাংলা গানেও সে-সবের সমন্বয় ঘটিয়ে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ও সুনিপুণভাবে তিনি রচনা করেন- ‘মেঘ মেদুর বরষায়’ (রাগ : জয়জয়ন্তী, তাল : ত্রিতাল), ‘গগনে সঘন চমকিছে দামিনী’ (রাগ : মেঘ, তাল : ত্রিতাল), ‘ভোরে ঝিলের জলে’ (রাগ : জিল্ফ্, তাল : ত্রিতাল), ‘নীলাম্বরী শাড়ি পরি’ নীল যমুনায় কে যায়’ (রাগ : নীলাম্বরী, তাল : ত্রিতাল) ইত্যাদি। কাজী নজরুল ইসলামের এ-বিশ্বাস সঠিক ছিল যে বাংলা গানের ইতিহাস রচনাকালে তাঁর কথা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে স্মরণ করা হবে। সৃষ্টির মৌলিকতা ও ব্যাপকতায় বর্তমান কালের বাংলা গানের ইতিহাসে নজরুল উচ্চাসন অধিকার করে আছেন। গভীর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নিজের অবদান সম্পর্কে তাই তো তিনি উচ্চারণ করেছিলেন ‘সঙ্গীতে আমি কিছু দিতে পেরেছি’। নতুন ধারা প্রবর্তন এবং প্রবর্তিত ধারায় নতুন প্রাণ সঞ্চার করে নজরুল বাংলা গানে যে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন, সন্দেহ নেই যে তা বাঙালীর হৃদয়ের গভীর প্রদেশে উজ্জ্বলরূপে চির জাগরূক হয়ে থাকবে। লেখক : নজরুলসঙ্গীতজ্ঞ ও অধ্যাপক [email protected]
×