ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

রেজাউল করিম খোকন

বিপথে যাওয়া বলিউডের নায়িকা...

প্রকাশিত: ১২:৫৪, ২৯ আগস্ট ২০১৯

বিপথে যাওয়া বলিউডের নায়িকা...

(পর্ব-১ ) সিনেমায় নায়ক নায়িকা হিসেবে যাদের দেখা যায়, যারা পর্দায় বিভিন্ন চরিত্র রূপায়ণ করেন, তাদের অভিনয় দেখে দর্শক হাসেন-কাঁদেন, উদ্দীপ্ত হন; অনুপ্রাণিত হন, দুঃখ ভারাক্রান্ত হন, আনন্দ উচ্ছ্বাসে রোমান্টিকতায় ভেসে যান। সেই সব চিত্রতারকা রক্ত মাংসে গড়া মানুষ। তাদেরও ব্যক্তিগত জীবন রয়েছে। সেখানে সুখ-দুঃখ-আনন্দ-বেদনা না পাওয়ার হতাশা দুঃখবোধ-সবই আছে। সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের ব্যাপারে সাধারণ মানুষের মধ্যে কৌতূহল, আগ্রহ সব সময়েই দেখা যায়। বলিউডে নায়িকাদের অনেকেই যুগে যুগে আলোড়ন তুলে ব্যক্তিগত জীবনের অশান্ত উচ্ছৃঙ্খল বেহিসেবী কর্মকা-ের জন্য। অনেক নায়িকাই এ কারণে পৃথিবী থেকে বেদনাদায়কভাবে অকালেই বিদায় নিয়েছেন, কারও সম্ভাবনাময় ক্যারিয়ার মাঝপথে থেমে গেছে। দর্শকদের ঘৃণা এবং অবজ্ঞার পাত্রী হয়েছেন। এমন নক্ষত্র পতনের তালিকায় যারা আছেন তাদের নিয়ে এই লেখা মধুবালা হিন্দী সিনেমার সোনালি যুগের নায়িকাদের কথা উঠলেই মধুবালার নামটি চলে আসে প্রথমেই। রুপালি পর্দায় ক্ল্যাসিক বিউটি অর্থাৎ ধ্রুপদী সুন্দরী হিসেবে দর্শক মনে আলাদা জায়গা করে নিয়েছিলেন তিনি। পুরনো দিনের সিনেমা দর্শক, যারা আজ বার্ধক্যে উপনীত তারা মধুবালার নামটি শোনামাত্র অদ্ভুত এক আবেশে হারিয়ে যান, নস্টালজিক ভাললাগা আবেগ জেগে ওঠে হৃদয়জুড়ে। পঞ্চাশের দশকে হিন্দী সিনেমায় দোর্দ- দাপটের সঙ্গে অভিনয় করে যাওয়া এই তুখোড় অভিনেত্রী একের পর এক ছবিতে নিজেকে তুলে ধরেছেন সৌন্দর্যের অপরূপ প্রতিমারূপে অভিনীত চরিত্রটিকে স্বপ্নময় করে তুলেছেন। কখনও বা বাস্তব জীবন থেকে তুলে আনা চেনা-জানা কারও মতো করে উপস্থাপন করেছেন। এই হলো মধুবালা, দ্য ক্ল্যাসিক বিউটি অব ইন্ডিয়ান সিনেমা। এক সঙ্গে সিনেমায় কাজ করতে গিয়ে মধুবালা ট্র্যাজেডি কিং কিংবদন্তি তারকা অভিনেতা দলীপ কুমারের সঙ্গে পর্দার বাইরে বাস্তব জীবনে প্রেমে জড়িয়ে পড়েছিলেন। তবে কন্যার এই প্রেম-ভালবাসাকে স্বীকৃতি দেননি মধুবালার বাবা আতাউল্লাহ খান। দিলীপ কুমারকে একান্ত আপন করে পেতে ব্যর্থ হওয়ায় মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছিলেন মধুবালা। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত এই জনপ্রিয় অভিনেত্রীর ক্যারিয়ার ক্রমেই বিপর্যস্ত হতে থাকে। তিনি জন্ম থেকেই হৃৎপি-ের অসুখে ভুগছিলেন। চিকিৎসকরা জানিয়ে দেন তিনি আর বেশি দিন বাঁচবেন না মধুবালা। লন্ডন থেকে ফিরেই মধুবালা বিয়ে করেন গায়ক অভিনেতা কিশোর কুমারকে। এক সঙ্গে অভিনয় করতে গিয়ে কিশোর কুমার ভালবেসে ফেলেছিলেন সুন্দরীতমা এই নায়িকাকে। দিলীপ কুমারকে না পেয়ে অনেকটা জেদের বশে তাকে দেখিয়ে দিতে কিশোর কুমারকে বিয়ে করেছিলেন মধুবালা। ‘আমি তোমাকে ছাড়াও চলতে পারি’Ñ এ কথাটি প্রমাণ করতে কিশোর কুমারকে বিয়ে করলেও আসলে দিলীপ কুমারকে হৃদয়ের মণিকোঠা থেকে সরাতে পারেননি মধুবালা। দিলীপ কুমারকেই মনেপ্রাণে ভালবেসে ছিলেন মধুবালা। প্রেমিককে না পাওয়ার দুঃখ-বেদনা বুকে পুষে নিয়ে অনেক কষ্টে বাকি কয়েকটি বছর বেঁচেছিলেন তিনি। মীনা কুমারী মীনা কুমারীকে হিন্দী সিনেমার দর্শক সহজে ভুলতে পারবে না, তাকে মনে রাখবে অনন্তকাল। সবাই তাঁর অসাধারণ, হৃদয় ছোঁয়া অভিনয়ের কথা মনে করতেই স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন। ট্রাজিক সিনেমায় অনবদ্য অভিনয়ের জন্য মীনা কুমারী হয়ে উঠেছিলেন ‘ট্র্যাজেডি কুইন’ অর্থাৎ ‘বিরহ সম্রাজ্ঞী’। তবে তাঁর ব্যক্তি জীবনের ট্র্যাজেডি হার মানায় যে কোন নাটকীয় সিনেমার গল্পকে। সাফল্যের চূড়ায় উত্থান আর সেখান থেকে নরকে পতন, সিনেমা আর বাস্তব জীবনের চরম নাটকীয়তা মিলে মীনা কুমারী হয়ে উঠেছিলেন হিন্দী সিনেমার দ্য ট্র্যাজেডি কুইন। শিশু শিল্পী হিসেবে সিনেমা জগতে পা রেখে পরবর্তীকালে নায়িকারূপে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন তিনি। হিন্দী চলচ্চিত্রে ৩০ বছরের ক্যারিয়ারে ৯০টির বেশি সিনেমায় অভিনয় করেছেন মীনা কুমারী। বয়সের অনেক ব্যবধান থাকলেও তিন সন্তানের জনক বিবাহিত চিত্র পরিচালক কামাল আমরোহীর প্রেমে পড়েছিলেন মীনা কুমারী। মূলত ভালবাসার জন্য নয়, উঠতি সুন্দরী মেধাবী অভিনেত্রী মীনাকে বিয়ে করেছিলেন আমরোহী নিত্যনতুন সিনেমা বানাবেন বলে। অন্যদিকে মীনা কুমারীর পরিবারের লোকজন এ বিয়েতে ভীষণভাবে অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন রোজগেরে মেয়েটি হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার কারণে। স্বামী কামাল আমরোহীর কাছ থেকে যে ভালবাসা চেয়েছিলেন তা পাননি বলে তার মনে অনেক দুঃখবোধ জমতে শুরু করেছিল। স্বামী, জন্মদাতা পিতা-মাতা, কাছের লোকজন সবাই তাকে ব্যবহার করে শুধুই নিজের স্বার্থ হাসিল করেছেন। নিজের ব্যর্থ, দুঃখ-যাতনাময় দাম্পত্য জীবনের ঘানি টানতে টানতে এক পর্যায়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলার উপক্রম হয়। ক্যারিয়ারে সাফল্যের শিখরে পৌঁছলেও দাম্পত্য জীবনে কামাল আমরোহীর সঙ্গে তার দূরত্ব বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে হতাশা থেকে মদ্যপানে আসক্ত হয়ে পড়েন মীনা কুমারী। অতুলনীয় রূপ নিয়েও এক প্রেমহীন হাহাকারময় জীবনযাপন করে সে কথাটিই হয়ত প্রমাণ করে গিয়েছিলেন হিন্দী সিনেমার অসাধারণ সুন্দরী ব্যক্তিত্বময়ী মেধাবী অভিনেত্রী মীনা কুমারী। মদের নেশায় ডুবে থাকতেন তিনি সারাক্ষণ। ফলে তার দেহে বাসা বাঁধে কঠিন লিভার সিরোসিস রোগ। জীবনের শেষ অধ্যায়ে হাসপাতালে অসহায় নিঃসঙ্গ অবস্থায় মৃত্যু প্রহর গুণতে হয়েছে তাকে। ১৯৭২ সালের ৩১ মার্চ মৃত্যু হয় হিন্দী সিনেমার এই কিংবদন্তি নায়িকার। পারভীন বাবি পারভীন বাবি ছিলেন, সত্তর দশকে হিন্দী ফিল্মের বহুল আলোচিত ‘গ্ল্যামার কুইন’। এমন একটা সময় ছিল তার পর্দা উপস্থিতি বাণিজ্যিক হিন্দী ছবির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যাপার হিসেবে গণ্য হতো। তখন বিগ বাজেটের বড় বড় ব্যানারের নামী-দামী নির্মাতাদের তারকাবহুল ছবিতে নায়িকা ছরিত্রে পারভীন বাবিকে প্রায়ই ঘুরে ফিরে দেখা যেত। দীর্ঘ বেশ কয়েকটি বছর হিন্দী ছবির জগতে দাপটের সঙ্গে অবস্থান করলেও আত্মহত্যার পূর্ব পর্যন্ত অনেক দিন ধরে মুম্বাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি তথা গ্ল্যামার জগত থেকে অনেক দূরে স্বেচ্ছা নির্বাসনে অনেকটা নিজেকে লোকচক্ষুর অন্তরালে রেখেছিলেন পারভীন বাবি। তার নিজের ভাষায়, গোটা হিন্দী ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। নিঃসঙ্গ নির্বাসিত জীবনটাকে অসহনীয় নয় বরং নতুন এক পৃথিবীতে বসবাসের শামিল বলে অভিহিত করেছিলেন তিনি। মুসলিম পরিবারে তার জন্ম হলেও পরবর্তী সময়ে পারভীন বাবি ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রীস্টান ধর্মাবলম্বী হয়েছিলেন। ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার ক্ষেত্রে তার মধ্যে এক ধরনের বিদ্রোহী মনোভাব ছিল। মুসলিম হয়েও তখনকার দিনে চাইনিজ রেস্টুরেন্টে গিয়ে প্রায়ই শূকরের মাংস খেতেন। আজকাল বলিউডে নায়ক-নায়িকাদের ধূমপান, মদ্যপান, রাতভর পার্টি নিয়ে মেতে থাকাটা সাধারণ ব্যাপার হলেও ৭০ দশকে এসব ছিল রীতিমতো নিষিদ্ধ ব্যাপার। কিন্তু তখন পারভীন বাবি প্রকাশ্যে ধূমপান করতেন, মদ্যপান করতেন। অথচ ওই সময়ে অনেক সিনিয়র তারকা তাদের মদ্যপানের ব্যাপারটা গোপন রাখার চেষ্টা করতেন পারভীন বাবি তাঁর কোন ব্যাপার নিয়ে লুকোচুরি খেলতে পছন্দ করতেন না। তাঁর নিজের পছন্দ অপছন্দের ব্যাপারগুলো আড়াল না করে বরং সেগুলো ফলাওভাবে সবাইকে জানানোটাই ভাল কাজ বলে মনে করতেন। বেশ কয়েকজন সঙ্গেই তার গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। এ ব্যাপারটা আড়াল করতে চাননি পারভীন বাবি। সুদর্শন সুপুরুষ অভিনেতা কবির বেদি, চিত্রপরিচালক মহেশভাট, ভিলেন ড্যানি প্রমুখের সঙ্গে তার বেপরোয়া সম্পর্ক ছিল। নিজেকে পরম বিশ্বাসে তাদের কাছে সোঁপে দিলেও তারা নিজেদের উদ্দেশ্য সিদ্ধির পর তাকে উচ্ছিষ্টের মতো ছুড়ে ফেলেছেন। পুরুষদের প্রতারণা শিকার হয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন পারভীন বাবি। অভিনয় জগত থেকে নিজেকে বের করে স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে যান। ভগবান রজনীশের আশ্রমে ছিলেন। এক সময়ে ওখানকার ভ্রস্টাচার, অনৈতিক জীবনযাপন, যৌন উচ্ছৃঙ্খলতা ইত্যাদি স্পষ্ট হয়ে ওঠায় আশ্রম থেকে ফিরে আসেন এবং নীরব জীবনযাপন শুরু করেন। তাকে মৃত্যুর পর কয়েকদিন পেরিয়ে যাওয়ার পর নিজস্ব ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার করা হয়। ডায়াবেটিসের কারণে তার পায়ে পচন ধরে গ্যাংগ্রিন হয়েছিল। তার ওপর বেশ কয়েকদিন কিছু না খেয়েছিলেন। একাকী নিঃসঙ্গ অবস্থায় বেদনায়ক মৃত্যু হয়েছিল পারভীন বাবির। (অসমাপ্ত)
×