ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

সঙ্গীতজ্ঞ নজরুল

প্রকাশিত: ১২:৫৩, ২৯ আগস্ট ২০১৯

সঙ্গীতজ্ঞ নজরুল

নজরুলের বিদ্রোহী সত্তা উদ্ধত, তেজোদীপ্ত, অনমনীয় শৌর্যের অনির্বাণ দীপ্তি। কিন্তু তারই অন্তর্নিহিত বোধ আর হৃদয় নিঃসৃত আবেগে সঙ্গীতের যে কামনায় ঝঙ্কার বেজে ওঠে সেটার এই যুগোত্তীর্ণ সাধকের অমরকীর্তি। কবি, প্রাবন্ধিক, গল্পকার, ঔপন্যাসিক নজরুলের সব কিছু ছাপিয়ে যে সমৃদ্ধ আঙ্গিনা ভক্ত-শ্রোতাদের আজও মুগ্ধ আর বিমোহিত করে রাখে। তেমন অনবদ্য গানের ডালি সময়ের নির্দিষ্ট গ-ি পার হয়ে কাল থেকে কালান্তরে পৌঁছে যায় তাও এক বিস্ময়কর সৃজন প্রতিভা। সঙ্গীতজ্ঞ নজরুল নিজেই মনে করতেন গানের উপহারের চেয়ে মূল্যবান তার সৃষ্টির অন্য কিছু নয়। সময়ের দুরন্ত মিছিল সেই অমৃত বাণীকে এখনও ছড়িয়ে দিচ্ছে। এক বিরল ও ব্যতিক্রমী প্রতিভার উজ্জ¦ল নক্ষত্র সাহিত্যিক গগনে যে দ্যুতি ছড়ায় বাণী আর সুরের মূর্ছনা সেখানে চিরস্থায়িত্বের যে বোধ অনুরণন করে তাও নজরুলের এক বিস্ময়কর সৃজন ভা-ার। সময়টা ছিল রবীন্দ্র সৃজন শৌর্যের এক অনতিক্রম্য কাল পর্ব। আর গানের বেলায় তো অনেকখানি। রবীন্দ্রভক্ত নজরুল শ্রদ্ধায়, ভালবাসায় কবি গুরুর সঙ্গীত সম্পদে নিজেকে সমর্পণ করেও বাংলা গানের রাগ-রাগিনীর মধুর ঝঙ্কারে যে আলাদা মাত্রা তৈরি করলেন সে বিস্ময়ের ঘোর তো এখনও কাটে না। সুরের মহিমা ছিল তার অস্থিমজ্জায়, রক্তে, মাংসে। আর বাণীর অকৃত্রিম ¯্রষ্টার ক্ষমতা ছিল একেবারে সুদূরপ্রসারী, যা আজও আধুনিক সময়ের বিস্তৃত বলয়কে নানামাত্রিকে উজ্জীবিত করে যাচ্ছে। ১৯১৯ সাল থেকে শুরু হওয়া নজরুলের সৃষ্টিশীল জগত থেমে যায় পরবর্তী ২২ বছরে। এই স্বল্প সময়ে বাংলা সাহিত্যকে যা দিলেন, গানের ভুবনকে অন্যমাত্রার যে ডালি উজাড় করা হলো তাতে নিজেই শুধু সমৃদ্ধ হননি। বাংলা ও বাঙালীকে নানামাত্রিকে ভরিয়েও তুলল। পরাধীন ভারতের সৃজনদ্যোতনায় নিজেকে প্রথমেই ঢেলে দিলেন দেশমাতৃকার অনবদ্য বন্দনায়। স্মরণ রাখা প্রয়োজন সঙ্গীত জগতের সময় মাত্র ১০ বছর। অথচ বাণী ও সুরের ঝঙ্কারে গানের সংখ্যা হয়ে গেল ৩ হাজার। দর্শক-শ্রোতা তৈরিতেও এমন গানের উৎসব যুগান্তকারী। কত পরীক্ষা- নিরীক্ষা, সংযোজন, আহরণ আর গবেষণায় সুরের যে অভাবনীয় মিলন সৌধ সেখানে মাটির টান থেকে শুরু করে সর্বভারতীয় রাগ-রাগিনীর সুমধুর ঐক্যতানই শুধু নয় সর্বমানুষের মিলন ও সুরও বেজে ওঠে। দেশমাতৃকার পায়ে অঞ্জলি দিয়ে গানের ভুবনের যে দ্বার খুলে দিলেন তা যেমন সময়ের চাহিদা মেটায় পাশাপাশি যুগও কালকে পার করতেও বিশেষ অবদান রাখে। প্রেম, বিরহ, ইসলামী গান, রাধাকৃষ্ণের মর্মবেদনায় শ্যামা সঙ্গীত, রাগ সাধনা সব মিলিয়ে যে নবধারা বাংলার গানের আঙ্গিনায় সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয় সেটাই আধুনিক বাংলা গানের এক অনিবার্ণ দ্যুতি। বাংলার লোকসঙ্গীতের ধারা এবং বাউল গানের যে সমৃদ্ধ শিকড় ইতোমধ্যে লালন শাহ ও রবীন্দ্রনাথ গড়ে দিলেন তাকে অন্য মাত্রায়, ব্যতিক্রমী ধারায় আরও বেগবান করলেন বিদ্রোহী কবি নজরুল। এক ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক পরিবেশ বিদ্রোহী কবিকে যে বিপ্লবী সত্তায় উদ্বুদ্ধ করে তার অকৃত্রিম প্রভাব পড়ে তাঁর সঙ্গীত অনুভবে। পরাধীন ভারতে তা জনপ্রিয় হতেও সময় লাগেনি। শুধু তাই নয় আজও সে সব সঙ্গীত দ্যোতনা দেশপ্রেম আর স্বাধীনতার জয়গানে মুখরিত হচ্ছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও সেই অমর সঙ্গীত প্রতিদিনের প্রেরণা হয়েছিল, ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ কিংবা দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার, ‘তোরা সব জয়ধ্বনি করে, ‘এই শিকল পরা ছল মোদের’ আজও অধিকার চেতনায় সর্বমানুষের সুর ধ্বনিত, প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। প্রেমের কাঙাল নজরুল বরাবরই ভালবাসায় নিঃশর্ত আহুতি দিতে পছন্দ করতেন যা এক চিরস্থায়ী বোধ। তেমন সঙ্গীতও মানুষের দ্বারে পৌঁছাতে সময় লাগেনি। আমি চিরতরে দূরে চলে যাব, মোরা আর জনমের হংসমিথুন ছিলাম, মোর প্রিয়া হবে এসো রানী, ‘লায়লী তোমার এসেছে ফিরিয়া,’ ‘এত জল ও কাজল চোখে’, বাগিচায় বুলবুলি তুই, ‘মোর ঘুম ঘোরে এলে মনোহর’, ‘শাওন রাতে স্মরণে আসে মোরে’ এমন আরও কত সুর ও বাণীর মিলনদ্যোতনায় তাঁর সঙ্গীত চেতনার যুগান্তকারী আবেদনে মানুষের তৃষ্ণা মিটিয়ে যাচ্ছে। রাগ-রাগিনীর সূক্ষ্ম কারুকাজ, বাংলার মূল শেকড় থেকে উদ্ভূত সুরের নব সংযোজন, পৌরানিক বাহিনীর অভাবনীয় দ্যোতনায় সমৃদ্ধ নজরুল তার গানের ভুূবনকেও তেমন উচ্চ মানে নিয়ে যান যা আজ নজরুল সঙ্গীতের মর্যাদায় নিজস্ব শৌর্য বিস্তৃত করছে। সর্বমানুষের কাছে প্রতিনিয়ত গ্রহণযোগ্যতাও বাড়ছে। আগেই বলা হয়েছে রবীন্দ্রসঙ্গীতের অপ্রতিহত বলয়ের প্রায় পাশাপাশি নজরুল তার গানের সম্ভার নিয়ে সারা বাংলাকে বিস্মিত করে দেয়। তার শক্তি যতদিন সৃজন সাধনার অনুষঙ্গ ছিল সে সময়গুলো তিনি চলচ্চিত্রে গানের ভা-ারেও হাজির হতে পিছপা হননি। মনে রাখা একান্ত দরকার সিনেমারও তখন মাত্র যাত্রা শুরু। তেমন নতুন ভুবনের উদ্বোধনে নজরুলের অবদানও চিরস্মরণীয়। নাটক এবং সিনেমায়ও তার বৈচিত্র্যময় বাণী আর সুরের মহিমা বিভিন্নভাবে সংযুক্ত হতে থাকে। এই সময় একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়। কবি গুরুর ‘উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়ন। সঙ্গীত পরিচালক নজরুল। এই নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে নানা প্রতিবাদ আসতে থাকে নজরুল কি সুরে রবীন্দ্রনাথের গানকে গোছাতে পারেননি। সাহসী, আত্মবিশ্বাসী নজরুল কারও কথায় কান না দিয়ে রবীন্দ্রনাথের কাছে সরাসরি হাজির হলে বিশ্বকবি, নিজেই বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যান। তিনি গান না শুনেই নজরুলকে অনুমোদন দিয়ে বিদ্রোহী কবির প্রতি আস্থা রেখেছিলেন। একজন সঙ্গীত স¤্রাট আর এক গানের রাজাকে এভাবেই সম্মান দেখিয়েছিলেন।
×