ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সোনালি আঁশে হস্তশিল্পের প্রসার- আলোকিত জীবনের সন্ধান

প্রকাশিত: ১১:২১, ২৯ আগস্ট ২০১৯

সোনালি আঁশে হস্তশিল্পের প্রসার- আলোকিত জীবনের সন্ধান

মেজবাহউদ্দিন মাননু ॥ গৃহস্থালি কাজ শেষে অবসর কিংবা গল্প করে কাটানোর সময়কে তারা পরিণত করেছেন কর্মের সময়ে। তাও অর্থকরী ফসল ঐতিহ্যবাহী সোনালি আঁশ বা পাটের আঁশ দিয়ে সৌখিন নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী তৈরির মধ্য দিয়ে। অনগ্রসর, পিছিয়ে পড়া নারীদের অর্থনৈতিক সচ্ছলতার পথ দেখাচ্ছেন। সকাল, দুপুর কিংবা বিকেল যখনই সময় পান তখনই বসে পড়েন পাটের আঁশ দিয়ে ডাইনিং টেবিলের ওপরে ব্যবহারের উপকরণ তৈরির কাজে। শুধু একটা উপকরণ নয়, চাবির রিং ঝুলানে পুতুলের আদলে উপকরণ। ডাইনিং ম্যাট ছাড়াও কয়েল ম্যাট, ফ্লাওয়ার ম্যাট, কি রিং ডল তৈরি করেন। যেন পাট দিয়ে তৈরি করা এসব উপকরণ এখন যেন তাদের জীবনের অনুষঙ্গ হয়ে গেছে। পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার হাজীপুর খ্রীস্টিয়ান পল্লীর বাসিন্দা জুলিয়েট বাড়ৈ একা নয়, রানু বেপারী, মালা বাড়ৈ, রোজি বিশ্বাস, কাকলি বাড়ৈ, ভরথী বিশ্বাস, মিলি বৈদ্য, মঞ্জু বাড়ৈ, জহুরা বেগম, পারুল বেগম, তেরেজা বাড়ৈ, লতিকা বিশ্বাস, ইতি, ভরতী বিশ্বাসসহ ২০ নারী পাটের এ সামগ্রী তৈরি করছেন। খ্রীস্টিয়ান ও মুসলিম এ নারীরা এ কর্মের মধ্য দিয়ে এক সম্প্রীতির বন্ধনও তৈরি করেছেন। এলাকার মানুষের কাছে বিষয়টি অনুকরণীয় হয়ে উঠেছে। তারা জানান, ২০১৭ সালের ৬ জুলাই যাত্রা শুরু করেন। প্রথমে পাটের আঁশ দিয়ে এসব সামগ্রী তৈরির পাঁচদিনের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা কারিতাসের দেখানো এ পথের দেখা মেলে খ্রীস্টিয়ান পল্লীর বিপুল ফাদারের মাধ্যমে। কারিতাসের কোর-দি জুট ওয়ার্কস হস্তশিল্প উৎপাদক সমিতি নামে সংগঠন করে তোলেন। নাম দেয়া হয় ‘মাদার তেরেজা হস্তশিল্প মহিলা সমিতি।’ করেন ব্যাংক হিসাব। সংস্থা এদের নির্দিষ্ট মূল্যে কাঁচামাল অর্থাৎ সাদা রঙের পাটের আঁশ সরবরাহ করে আসছে। তা দিয়ে পাঁচ থেকে ৩০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত সাইজের এ সামগ্রী তৈরি করা হয়। এরা জানালেন, সবচেয়ে বড় সাইজের দুটি আনোয়ারা ম্যাট তৈরিতে একজনের সর্বোচ্চ একদিন লাগে। সমিতির সবকিছু শৃঙ্খলভাবে চলে আসছে। রয়েছে এদের উৎপাদন কেন্দ্রিক চাহিদাপত্র। পাটের আঁশ কিনতে হয় কেজি ৬০ টাকা দরে। কারিতাস ঢাকা থেকে এ কাঁচামাল পাঠানো হয়। চাহিদা অনুসারে তৈরি উপকরণ ঢাকায় সংস্থার কাছে পাঠানো হয়। তারাই কিনে নেন। এজন্য তৈরি সামগ্রী বিক্রি নিয়ে কোন সমস্যা নেই। অর্ডারশীট অনুসারে ২০ সদস্য উৎপাদন টার্গেট ভাগাভাগি করে নেন। সংগঠনের সভাপতি রানু বেপারী জানান, মহিলাদের যখন কোন কাজ থাকে না তখন এ কাজ করতে বসি। গল্পের ছলে হস্তশিল্পের এই কাজটি করতে পারেন। সকাল বিকেল কিংবা দুপুর, এমনকি এখন গ্রামের বাড়িতে বিদ্যুত থাকায় ওই সময়টায় (রাতেও) হস্তশিল্পের এ কাজটি তারা করতে পারেন। একত্রে, একই উঠানে কিংবা ঘরের মাঝে বসে নারীরা এ কাজটি করলে সকলের সঙ্গে সকলের সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটে। পারস্পরিক আস্থা বাড়ছে। পারিবারিক বন্ধন আরও দৃঢ় হয়। একে অপরের সমস্যা নিয়ে আলাপ-আলোচনাও করা যায়। ১০ মায়ের ১০ মেয়ে একত্রে থাকলে মহল্লায় শান্তিও বাড়ে বলে এ নেত্রীর দাবি। সংগঠনের কোষাধ্যক্ষ জুলিয়েট বাড়ৈ জানান, কাঁচামাল আনা এবং উৎপাদিত সামগ্রী পৌঁছানের জন্য যাতায়াত বাবদ সাত পার্সেন্ট টাকা পাচ্ছেন। উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করে শুধু লাভই করেননি এই নারীরা। মাসিক জনপ্রতি ২০ টাকা হারে এ পর্যন্ত ব্যাংকে সঞ্চয় করেছেন ছয় হাজার ৩৪০ টাকা। শুরু থেকে এ পর্যন্ত পাটের দামসহ বিভিন্ন খরচ বাদ দিয়ে অন্তত ৭০-৮০ হাজার টাকা লাভ করেছেন। উপার্জনের এ টাকা তারা তাদের শখ, আহ্লাদের পাশাপাশি সংসারের প্রয়োজনে লাগাচ্ছেন। এছাড়া, এসব নারী প্রত্যেকে সেলাইয়ের কাজও করছেন। যেন নারী জাগরণে নেমেছেন এ ২০ নারী। প্রতিমাসে সভা করেন। যেখানে কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ করেন। রেজুলেশনে আনেন পরবর্তী মাসে কী কী উপকরণ তৈরির কাঁচামাল সংগ্রহ করবেন। কে কী পরিমাণ সামগ্রী তৈরির অর্ডার নেবেন। যেন এসব হস্তশিল্পী নিজেদের ছকে বাধা এক উন্নয়ন পরিকল্পনায় এনেছেন। এখন আর তারা পিছিয়ে নেই। সবার দাবি সরকারীভাবে কিছু পুঁজির প্রয়োজন। এছাড়া একটি নির্দিষ্ট শেড করে দেয়া হলে ওই পল্লীতে বসেই তাদের কর্মপরিধি আরও বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। এ ২০ নারী যেন এই এলাকার অনগ্রসর নারীদের এগিয়ে নেয়ার পথ দেখাচ্ছেন। নিজেরাও হাঁটছেন আলোর পথে। যে পথে হাঁটতে পারেন পরবর্তী প্রজন্ম।
×