ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রেজ্যুলেশন অন জেনোসাইড

প্রকাশিত: ০৯:১৫, ২৯ আগস্ট ২০১৯

রেজ্যুলেশন অন জেনোসাইড

১৯৭১ সালের ২৯ আগস্ট দিনটি ছিল রবিবার। ক্যাপ্টেন আইনুদ্দিনের নেতৃত্বে ৪র্থ বেঙ্গলের ‘ডি’ কোম্পানির এক প্লাটুন যোদ্ধা কসবার পশ্চিমে পাকবাহিনীর টি. আলীর বাড়ির কাছে পাকসেনাদের অবস্থানের পেছনে জলপথের ওপর এ্যামবুশ করে। পাকসেনাদের দুটি নৌকা তাদের অবস্থানের দিকে অগ্রসর হলে এ্যামবুশের আওতায় আসার সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ওপর আক্রমণ চালায়। প্রচ- গোলাগুলির পর পাকসেনাদের নৌকা দুটি পানিতে ডুবে যায় এবং সেই সঙ্গে ৩০ জন পাকসৈন্য নিহত হয়। ক্যাপ্টেন মাহফুজের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর এক কোম্পানি যোদ্ধা ১নং সেক্টরে আমলিকাতে উপেন্দ্র লাল চাকমা বিওপির বিপরীতে পাকসেনাদের শক্ত অবস্থানের ওপর আক্রমণ রচনা করে। ভারতীয় বাহিনীর ৪নং গার্ডস-এর একটি কোম্পানি লেঃ কর্নেল হিম্মত সিংহের কমান্ডে মুক্তিযোদ্ধাদের মর্টার ও এলএমজি সাপোর্ট দেয়। আধঘণ্টা স্থায়ী এই সংঘর্ষে মুক্তিবাহিনীর তিনটি কলাম তিন দিক থেকে পাকসেনাদের বাঙ্কারগুলোর ওপর গ্রেনেড চার্জ করে। পাকসেনারা মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের মুখে চরম মার খেয়ে শোতাপুরের দিকে পালিয়ে যায়। পাকবাহিনী লাকসাম থানার বুটচি গ্রামে সন্ধ্যা সাতটায় শান্তি কমিটির একটি সভা অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নেয়। পাকসেনা ও রাজাকাররা সভা শুরু করলে ২নং সেক্টরের মিয়ারবাজার সাব-সেক্টরের এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা তাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে ৮ জন পাকসেনা, ৯ জন পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ, ও ২০ জন রাজাকার হতাহত হয় এবং শান্তি কমিটির সভা ভেঙ্গে যায়। মুক্তিযোদ্ধা দল নিরাপদে নিজ অবস্থানে ফিরে আসে। রাতে পাকবাহিনী আকস্মিভাবে এলিফ্যান্ট রোডের ৩৫৫ নম্বর কনিকা বাড়িটি চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। সেখান থেকে পাকসেনারা শরীফ, জামিল ও গেরিলা যোদ্ধা রুমীকে বন্দী করে নিয়ে যায়। রুমী ভারতের ‘মেলাঘর’ থেকে গেরিলা ট্রেনিং নিয়ে জুন মাসে ঢাকায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিফৌজের ছয়জনের একটি গেরিলা দল ঢাকার সৈয়দাবাদ সেতুটি এক্সপ্লোসিভ লাগিয়ে উড়িয়ে দেয়। এ সময় গেরিলারা একটি বাসে দু’শ’ মণ পাটসহ লতিফ বাওয়ানী জুটমিলে যাওয়ার পথে বাসটিকে ধ্বংস করে দেয়। করাচীতে গোলাম আজম এক সাংবাদিক সম্মেলনে আলাদা নির্বাচন পদ্ধতিতে পুনরায় পূর্ব পাকিস্তানে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানান। তিনি বলেন, এ মুহূর্তে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে চরম বোকামি। এ্যান এ্যাপিল টু জেসীস টু মুভ দ্য পিপল অব দেয়ার ওয়ার্ল্ড ইউএন রেজ্যুলেশন অন জেনোসাইড ঘোষণা করে যে ‘আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে গণহত্যা এমন একটি অপরাধ যা সভ্য সমাজের কাছে তীব্র নিন্দনীয়।’ ১৯৪৮ সালের ৯ ডিসেম্বরের ২৬০ এ দ্বারা সাধারণ পরিষদ প্রস্তাব উপস্থাপন করে এবং অনুমোদন দেয়, এই গণহত্যা যা শান্তি স্থাপন বা যুদ্ধের সময় যেভাবেই হোক না কেন তা আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে অপরাধযোগ্য যা তারা প্রতিহত করা এবং শাস্তি দেয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করে। সাইমন ড্রিংসের রিপোর্ট উদ্ধৃত করে ৩০ মার্চ, ১৯৭১ লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ লিখেন, সৃষ্টিকর্তা এবং অখ- পাকিস্তানের নামে ঢাকা বর্তমানে একটি চূর্ণ-বিচূর্ণ ও ভীত নগরী...পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর নির্মম ও ঠা-া মাথার গোলাবর্ষণের ২৪ ঘণ্টা পর হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছে, বিস্তীর্ণ এলাকা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে এবং এভাবে পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধকে নৃশংসভাবে শেষ করে ফেলা হয়েছে। ছাত্রদের তাদের নিজ বিছানায় মেরে ফেলা, কসাইদের তাদের দোকানের পিছনে হত্যা করা, নারী ও শিশুদের তাদের ঘরেই জীবিত পুড়িয়ে মারা, পাকিস্তানী হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জোর করে ঘরের বাইরে এনে গণহারে গুলি করে হত্যা করা, বাজার এবং কেনাকাটার জায়গাগুলোতে আগুন লাগিয়ে ধ্বংস করে ফেলার চিত্রই শুধু সামরিক বাহিনীর এমন ভয়াবহতাকে যথার্থভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারে। ২৫ মার্চে ঢাকায় এগিয়ে আসা ট্যাংকের প্রথম লক্ষ্যই ছিল ছাত্ররা। এই ক্ষতি সংশ্লিষ্ট সবার নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণায় পরিণত হয়েছে, সাংবাদিকরা দেখেছে মাটিতে মিশিয়ে দেয়া হাজারো পুড়ে যাওয়া ভবনের দেয়াল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত আগা হিলালী বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণ তাদের হাজারো বন্ধু এবং আত্মীয়কে হারিয়েছে। জাতিসংঘের সনদ উল্লেখ রয়েছে যে, ‘পরবর্তী প্রজন্মকে যুদ্ধের অভিশাপ হতে রক্ষা করা; যা আমাদের জীবদ্দশায় দুই দু’বার মানবজাতির ওপর অবর্ণনীয় দুঃখ বয়ে এনেছে এবং মানুষের ব্যক্তি সম্মান ও মূল্যবোধ, নারী ও পুরুষের সমান অধিকার এবং বড় ও ছোট দেশগুলোতে মৌলিক মানবাধিকারে পুনঃনিশ্চয়তার আস্থা ফিরিয়ে আনা এবং যে চুক্তিসমূহ ও আন্তর্জাতিক আইনের অন্যান্য মাধ্যম হতে উদ্ভূত ন্যায়বিচার ও দায়িত্বের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের পরিস্থিতির প্রতিষ্ঠা করা এবং সামাজিক অগ্রগতি ও বৃহত্তর স্বাচ্ছন্দ্যতার সঙ্গে জীবন যাপনের মান অধিকতর উন্নততর করতে আমরা জাতিসংঘের সদস্যরা সংকল্পবদ্ধ।’ পশ্চিম পাকিস্তান অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত উন্নত এবং পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৬% নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান গঠিত যারা অত্যন্ত অনগ্রসর ও অনুন্নত। অধিকতর বৈষ্যম্যতার কারণে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মাঝে ভয়ঙ্কর রকমের অস্থিরতা বিরাজ করছে। ধর্ম ভিন্ন এই দুই অঞ্চলের মধ্যে অন্য কোন মিল নেই। এমনকি এদের ভাষাও ভিন্ন; পশ্চিম পাকিস্তান উর্দু আর পূর্ব পাকিস্তান সাংস্কৃতিকভাবে তারা মেরুসম তফাতে। প্রশাসনের সকল উর্ধতন সামরিক সদস্যই পশ্চিম পাকিস্তান হতে। পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান এবং কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী, অর্থ বরাদ্দ প্রকল্পের সকল গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা সব সময়ই পশ্চিম পাকিস্তানী। জয়সীস- বাংলাদেশ ‘এই সংগঠনের চার দেয়ালে মাঝে প্রাণ যেখানে চরিত্র ও ভাল নাগরিকত্বের ভিত্তি স্থাপিত করা হয় সেখান হতে আমি আশা করি যে আগামীর কোন এক সময়ের এমন একটি বার্তা আসবে যা মানুষকে একটি স্থায়ী ও চিরস্থায়ী বিশ্ব শান্তির জন্য উদ্দীপিত করবে।’ এই কথাগুলো জুনিয়র চেম্বার মুভমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা হেনরি গিসেন বিয়েরের। এটা স্পষ্ট যে আমাদের সকল প্রচেষ্টার চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে, আমাদের আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতার মতোই স্থায়ী ও চিরস্থায়ী বিশ্ব শান্তি। ‘এই লক্ষ্যটি সকলের বোধগম্যের। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মাঝে ১৯৫১ সালে এই জুনিয়র আন্দোলনের জন্ম হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যেই ১৯৪৪ সালে আন্তর্জাতিক জুনিয়র চেম্বার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।’ সাতাশ বছর বিদ্যমান থাকার পর, স্থায়ী ও চিরস্থায়ী বিশ্ব শান্তির এখনই প্রকৃত সময়। এই পর্যন্ত প্রতিষ্ঠাতার স্বপ্ন পূরণে আমরা কি করতে পেরেছি? ... পার্থক্য শুধু এইটাই যে ভারতের ওপর এর নজিরবিহীন প্রভাব। এই রকম লক্ষাধিক শরণার্থীর বোঝা বহন করার মতো বিশ্বের আর কোন দেশের এমন কোন সময়ের ইতিহাস নেই। যদি তাদের প্রতি কোন প্রত্যাশা উন্মুক্ত থাকে তবে তা হচ্ছে প্রতিটি নীতিকে অস্বীকার করা যা অলঙ্ঘনীয় হিসেবে ঘোষিত হয়। যে তারুণ্যকে স্বাধীনতা হতে বঞ্চিত করা হয়, শিক্ষা হতে বঞ্চিত করা হয়, খাদ্য হতে বঞ্চিত করা হয়, নিজের ভূমি হতে বঞ্চিত করা হয়, নিজের ভূমিতে উন্নতির সম্ভাবনা হতে বঞ্চিত করা হয়, সে তারুণ্যকে আদতে তার একমাত্র অস্তিত্ব হতে বঞ্চিত করা হয়। আমরা ত্রাণ দিয়ে ও মানবেতর জীবন যাপন হতে মুক্ত করার জন্য সাহায্য করে যেতে পারি। আমার আমাদের তরুণদের এই রকম কর্মকা-ের মাধ্যমে নেতৃত্বের অভিজ্ঞতা অর্জনে সাহায্য করতে পারি। কিন্তু এই রকমের আচরণ কী আসলেই আমাদের প্রতিষ্ঠাতার মূল লক্ষ্যকে ফুটিয়ে তোলার মতো কাছাকাছিও নিয়ে যেতে পারে? বিশ্বের এমন তরো আবহ কী ভাল কিছুর জন্য পরিবর্তনের বদলে খারাপ কিছুর জন্য পরিবর্তনের মতো আমাদের উদ্দেশ্যের দিকে ধীরস্থিরভাবে ধাবিত করতে পারে? আমাদের সকল প্রচেষ্টাই কি বৃথা ও ক্ষীণ আচরণের মতো নয়? এটা হচ্ছে সেই পরিস্থিতি যা বিশ্বজুড়ে অবস্থান নেয়ার মতো জয়সীসের প্রয়োজন। এটা সত্যি যে আমাদের মতবাদ আমাদের কোন দলীয় রাজনৈতিক কর্মকা-ে এবং একটা দেশের স্বার্থের ওপর আরেকটির স্বার্থ প্রচারে অংশগ্রহণ করা থেকে নিষেধ করে। আমাদের দ্বারে এই প্রসঙ্গটি নিয়ে আসা হয়েছে যে বাংলাদেশে সৃষ্ট পরিস্থিতিকে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে অগ্রাহ্য করা যাবে না। এটা মানবিকতার বিষয়। এই প্রসঙ্গ অচিরেই আরও অনেক উন্নয়নশীল দেশের দ্বারা সম্মুখীন হতে পারে, কারণ বাংলাদেশ ফোর্ডের কাছে উপ-জাতীয়তার মধ্যে বহুজাতিক উন্নয়নশীল দেশের সম্পর্ককে নিয়ে এসেছে। যদি যুদ্ধের কোন অংশ বিভিন্ন জাতির মধ্যে চলে তবে উন্নয়নশীল দেশের মধ্যেও যুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে, অচিরেই আমরা বিশৃঙ্খলতা ও বর্বরতার সীমা অতিক্রমের দিকে ধাবিত হতে যাচ্ছি। আমরা ইতোমধ্যেই বিশ্বের বিভিন্ন অংশে এমন হতে দেখে ফেলেছি। আমরা এখন তা বাংলাদেশেও হচ্ছে দেখতে পাচ্ছি। এটা এখন আর কিছুতেই রাজনৈতিক বিষয়ে নেই বরং মানবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানবিকতার পটভূমিতে হলেও আমরা জয়সীস অবশ্যই বাংলাদেশের সমস্যার দিকে দৃষ্টিপাত করব এবং এই প্রাসঙ্গিকে শান্তির উদ্দেশ্যে কাজ করার মতো বৈশ্বিক কার্যবিধি প্রদান করতে হবে। এর মাঝেই আমাদেরকে অবশ্যই আমাদের সকল সম্পদকে গতিশীল করে ফেলতে হবে যাতে যুদ্ধের শিকার ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দিতে পারি। বিশ্বজুড়ে তরুণদের সর্ববৃহৎ সংগঠন হিসেবে আমাদের অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে আমাদের ভবিষ্যত এমনতরো মানুষ ধ্বংসের মতো কাজ দ্বারা উপেক্ষিত নয় যা বৃদ্ধের সম্মানকে অস্বীকার করে, যে কাজ মানুষের ব্যক্তিত্বকে অধঃপতিত করে। এটা যুদ্ধের বিরুদ্ধে কার্যপ্রণালী এবং যুদ্ধের কারণ আমাদের মতবাদ দ্বারা, আমাদের উদ্দেশ্য দ্বারা এবং সেই স্বপ্ন দ্বারা বিচারিত হবে যা প্রতিষ্ঠাতা হেনরী গিসেনবিয়েরকে অনুপ্রাণিত করেছে। সেই ‘আগামীর কোন এক সময়’ এখন নতুন বার্তার জন্য চলে এসেছে ‘এই সংগঠনের চার দেয়ালে মাঝে প্রাণ যেখানে চরিত্র ও ভাল নাগরিকত্বের ভিত্তি স্থাপিত করা হয় সেখান হতে আমি আশা করি যে আগামীর কোন এক সময়ের এমন একটি বার্তা আসবে যা মানুষকে একটি স্থায়ী ও চিরস্থায়ী বিশ্ব শান্তির জন্য উদ্দীপিত করবে। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×