ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

গান কবিতা ও বক্তৃতায় উচ্চারিত সাম্যের চেতনা

সম্প্রীতির আবাহনে পালিত নজরুল প্রয়াণবার্ষিকী

প্রকাশিত: ১১:০১, ২৮ আগস্ট ২০১৯

সম্প্রীতির আবাহনে পালিত নজরুল প্রয়াণবার্ষিকী

স্টাফ রিপোর্টার ॥ গাহি সাম্যের গান/যেখানে আসিয়া থেমে গেছে সব বাধা-ব্যবধান/যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান- এভাবেই মানুষে মানুষে সমতার স্বপ্ন জাগিয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। সৃষ্টির আলোয় ধারণ করেছিলেন প্রেম ও মানবতাকে। কবিতার ছন্দে কিংবা গানের সুরে মিলিয়ে দিয়েছিলেন বিভেদের সীমারেখা। অন্যায় কিংবা শোষণের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছে বিদ্রোহী কবির কলম। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কিংবা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অনন্ত অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে ধরা দিয়েছে তার সৃষ্টিসমগ্র। এভাবেই দ্রোহ, প্রেম, সাম্য ও মানবতার কবি হিসেবে ঠাঁই করে নেন বাংলা সাহিত্য ও শিল্পের অনুরাগীদের মননে। মঙ্গলবার ছিল গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াকু কবি নজরুলের ৪৩তম প্রয়াণবার্ষিকী। জাতীয় কবির মৃত্যুবার্ষিকীর আয়োজনে গান, কবিতা বা বক্তৃতায় বারংবার উচ্চারিত হয়েছে সাম্যের চেতনা। ধর্মের বিভেদ পেরিয়ে সম্প্রীতির আবাহনে পালিত হয়েছে কবির প্রয়াণবর্ষিকী। অনুরাগীদের হৃদয় উৎসারিত ভালবাসার সঙ্গে কবির অসাম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী চেতনার অনুরণন ছিল গোটা জাতির অন্তরে। বিশ্বব্যাপী জেগে উঠে ধর্মান্ধতা ও উগ্রবাদের আস্ফালনের সঙ্কটময় সময়ে অসাম্প্রদায়িক চেতনার মর্মবাণীতে পালিত হয়েছে কবির প্রয়াণবার্ষিকী। সমাধিতে পুষ্পাঞ্জলি নিবেদনের পাশাপাশি নানা আয়োজনে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করা হয় কবিকে। জাতীয় পত্রিকাগুলোয় গুরুত্বসহকারে প্রকাশিত হয়েছে নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর সংবাদ। সরকারী-বেসরকারী টেলিভিশন ও বেতারে দিনভর প্রচারিত হয়েছে নজরুলকে নিবেদিত গান-কবিতায় সাজানো অনুষ্ঠানমালা। এছাড়া নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কবিকে স্মরণ করেছে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। মঙ্গলবার ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে জাতীয় কবির সমাধিতে ছুটে আসেন তার পরিবারের সদস্য, ভক্ত, অনুরাগী ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা। কবির প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসার প্রকাশ ঘটিয়ে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান সমাধিতে। পুষ্পাঞ্জলি অর্পণের পাশাপাশি কবি আত্মার শান্তি কামনা করে ফাতেহা পাঠ করা হয়। কবি পরিবারের সদস্যদের পুষ্পাঞ্জলি অর্পণের মাধ্যমে সূচনা হয় শ্রদ্ধাঞ্জলি পর্বের। এরপর একে একে বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। কবির সমাধিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি ॥ পূব আকাশে সূর্যের রক্তিম আভার দেখা মিলতেই সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে কবির সমাধিতে পুষ্পাঞ্জলি নিবেদনের মাধ্যমে শুরু হয় জাতীয় কবিকে স্মরণে দিবসের কর্মসূচী। শ্রদ্ধা নিবেদনে জাতীয় কবির সমাধিতে সমবেত হন ভক্ত, অনুরাগী ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা। কবির প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসার প্রকাশ ঘটিয়ে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান সমাধিতে। পুষ্পাঞ্জলি অর্পণের পাশাপাশি কবি আত্মার শান্তি কামনা করে ফাতেহা পাঠ করা হয়। কবির সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, বাসদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন শ্রদ্ধা জানায়। বরাবরের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে পৃথকভাবে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। এছাড়া কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, নজরুল সঙ্গীত শিল্পী পরিষদ, জাতীয় কবিতা পরিষদ, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, বঙ্গবন্ধু লেখক পরিষদ, নজরুলসঙ্গীত চর্চা কেন্দ্র সুরসপ্তক, নজরুল চর্চা কেন্দ্র বাঁশরীসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের প্রতিনিধিরা কবির সমাধিতে ফুলেল শ্রদ্ধা জানান। আওয়ামী লীগের পক্ষে শ্রদ্ধা জানান সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক এ কে এম এনামুল হক শামীম, দফতর সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক আবদুস সবুর, উপ দফতর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া। ওবায়দুল কাদের বলেন, আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন অসম্প্রদায়িক চেতনার মানবতাবাদী কবি। তার প্রতিটি লেখায় প্রতিবাদী কণ্ঠ, তার প্রতিটি লেখা অসম্প্রদায়িক চেতনার। আমরা আজ শপথ করব, আমরা সাম্প্রদায়িক শক্তিকে পরাজিত করে কবির স্বপ্নের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ব। নজরুলকে জাতীয় কবি ঘোষণা করা সংক্রান্ত সরকারী কোন প্রজ্ঞাপন বা দলিল নেইÑ সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জাতীয় কবি হিসেবে গেজেটের মাধ্যমে স্বীকৃতির চেয়ে বাস্তবে কর্মের মাধ্যমে কাজী নজরুল ইসলামকে ধারণ করাই গুরুত্বপূণ। বিএনপির পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে দলের যুগ্ম-মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন বলেন, জাতীয় কবির মৃত্যুবার্ষিকীতে আমাদেরকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের শপথ নিতে হবে। জাতীয় কবি আমাদের যে বিদ্রোহের মন্ত্র শিখিয়েছেন, সেই মন্ত্রে অনুপ্রাণিত হয়ে আমরা আমাদের নেত্রীকে মুক্ত করব। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মোঃ আখতারুজ্জামান বলেন, জাতীয় কবি নজরুল অসাম্প্রদায়িকতা, সাম্য, ভালবাসা ও সম্প্রীতির প্রতীক। তার এই মূল্যবোধগুলোর বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল কবির সাহিত্যকর্মের মধ্যে, যা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় অসাধারণ অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল। এ বিষয়টি অনুধাবন করেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কবি নজরুলকে কলকাতা থেকে ঢাকায় ফিরিয়ে এনেছিলেন বলে মন্তব্য করেন উপাচার্য। জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে নজরুলকে নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। এখন তার সাহিত্যকর্ম বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত করে বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে হবে। তাতে সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা ও হানাহানি থেকে বিশ্ব মুক্তি পাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মুহাম্মাদ সামাদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক এএসএম মাকসুদ কামালও এ সময় উপস্থিত ছিলেন। ‘নজরুলের বিদ্রোহ : রাজনীতি, অর্থনীতি ও ধর্মে’ ॥ কবির প্রয়াণবর্ষিকী উপলক্ষে ‘নজরুলের বিদ্রোহ : রাজনীতি, অর্থনীতি ও ধর্মে’ শীর্ষক একক বক্তৃতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বাংলা একাডেমি। একাডেমির কবি শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে একক বক্তৃতা করেন অধ্যাপক মোহীত উল আলম। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন একাডেমির সচিব ও ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন। সভাপতিত্ব করেন একাডেমির সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। একক বক্তৃতায় মোহীত উল আলম বলেন, নজরুল গানের মধ্য দিয়ে সমাজ থেকে বৈষম্য দূর করে সাধারণ মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছিলেন, বঙ্গবন্ধু তাকে রাজনৈতিক রূপ দিলেন। এখানে ব্যক্তি মানুষের উদ্বোধন কবি নজরুল করে গেছেন; বঙ্গবন্ধু একটি স্বাধীন জাতি রাষ্ট্রের জন্ম দিলেন। এভাবে আমরা আমাদের জাতির পিতা ও জাতীয় কবিকে মেলাতে পারি। তিনি বলেন, আমরা প্রকৃত নজরুলকে চর্চা করতে পারিনি। আমরা যে নজরুলকে চর্চা করি, তা আমাদের তৈরি। প্রকৃত নজরুল মনে-প্রাণে অসাম্প্রদায়িক ছিলেন, কুসংস্কার তার ভেতর ছিল না, শ্রেণীবৈষম্য ঘুচিয়ে ফেলার কথা তিনি বলেছেন। তার মতো উদার চিন্তার মানুষ আমরা হতে পারিনি। সভাপতির বক্তব্যে আনিসুজ্জামান বলেন, কাজী নজরুল ইসলাম বিদ্রোহী পরিচয় পেয়েছেন কেবল ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লেখার জন্য নয়, তিনি ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে ধর্মীয় গোঁড়ামির বিপক্ষে, সকল ধরনের বৈষম্য অত্যাচার অনাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন। নজরুলের বিদ্রোহ ব্যাপক ও তাৎপর্যপূর্ণ। সাংস্কৃতিক পর্বে নজরুলের কবিতা আবৃত্তি করেন বাচিকশিল্পী আশরাফুল আলম। নজরুলগীতি পরিবেশন করেন তানভীর আলম সজীব। নজরুল ইনস্টিটিউট ॥ প্রয়াণবার্ষিকীতে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় জাতীয় কবিকে স্মরণ করে নজরুল ইনস্টিটিউট। বিকেলে জাতীয় জাদুঘরের সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে এ অনুষ্ঠানে আয়োজন করা হয়। নজরুলকে নিবেদিত আলোচনায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ ঘোষ। আলোচনায় অংশ নেন ইনস্টিটিউটের সাবেক নির্বাহী পরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। সভাপতিত্ব করেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের চেয়ারপার্সন জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম। স্বাগত বক্তব্য দেন ইনস্টিটিউটের উপ-পরিচালক শেখ রেজাউদ্দীন স্টালিন।
×