ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গারা বিরাট বোঝা ॥ সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয় আড়াই হাজার কোটি টাকা

প্রকাশিত: ১১:০০, ২৮ আগস্ট ২০১৯

রোহিঙ্গারা বিরাট বোঝা ॥ সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয় আড়াই হাজার কোটি টাকা

রহিম শেখ ॥ উদ্যোগ আছে; কিন্তু দফায় দফায় প্রস্তুতি নিয়েও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সরকারের কাক্সিক্ষত সাফল্য আসেনি। বর্তমানে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ১১ লাখেরও বেশি। এই বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার জীবনযাত্রার চাহিদা মেটাতে বিশাল অঙ্কের অর্থ খরচ করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। এর ফলে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা এনজিও ব্যুরোর তথ্য বলছে, প্রায় দুইবছরে এনজিওদের ব্যয় দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৭৪৮ কোটি টাকা। ১৮৯টি বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) ১ হাজার ২১টি প্রকল্পের মাধ্যমে ব্যয় করছে এ অর্থ। যতই দিন যাচ্ছে ততই বাড়ছে ভরণপোষণ ব্যয়। গত সপ্তাহে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডক্টর একে আবদুল মোমেন নিজ দফতরে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের জন্য একদিকে বৈদেশিক সাহায্য কমছে, অন্যদিকে বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে নিজেদের তহবিল থেকে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা শরণার্থীদের জন্য খরচ করেছে। এদিকে রোহিঙ্গা এলাকায় কাজ করতে চায় অনেক এনজিও। তাই যতই দিন যাচ্ছে ততই বাড়ছে এনজিওর সংখ্যা এবং ব্যয়ের পরিমাণ। সূত্র জানিয়েছে, রোহিঙ্গাদের পেছনে প্রতিবছর যে খরচ হচ্ছে তা জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর, বিশ্ব খাদ্য সংস্থা-ডব্লিউএপিএসহ বিভিন্ন বৈদেশিক সাহায্য সংস্থা থেকে অনুদান পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু এর বাইরেও রোহিঙ্গাদের পেছনে বিপুল পরিমাণ খরচ হচ্ছে। এ ব্যয় মেটাতে হচ্ছে বাজেট থেকে। এটি অনাকাক্সিক্ষত ব্যয়। বিশেষ করে যোগাযোগ, বিদ্যুত, স্যানিটেশন, নিরাপত্তাজনিত ব্যয় সরকারের তরফ থেকে করতে হচ্ছে। প্রথমদিকে রোহিঙ্গাদের জন্য সাহায্যের আশ্বাস পাওয়া গেলেও দুই বছরে বিদেশী সাহায্যের পরিমাণ কমেছে। রোহিঙ্গা খাতের বিপুল পরিমাণ প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড়ে শুরু থেকেই বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ও দেশগুলোর সহায়তা আরও বাড়ানোর কথা জানিয়ে আসছে সরকার। এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ও বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, রোহিঙ্গাদের ব্যয় মেটাতে প্রতিবছর প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের মতো খরচ হয়। পুরোপুরি অর্থ বৈদেশিক সহায়তা থেকে পাওয়া যায় না। ফলে সরকারের বাজেট থেকে খরচ করতে হয়। এতে বাজেটের ওপর চাপ পড়বে এটাই স্বাভাবিক। সেখান থেকে উত্তরণে ইউএনএইচসিআরের নেতৃত্বে একটি ফান্ড করা যেতে পারে। যেখানে প্রতিবছর বিভিন্ন দেশ ১ বিলিয়ন ডলার সহায়তা করবে। দ্রুত সময়ে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নেয়াও প্রয়োজন। এছাড়া অন্য দেশ সহানুভূতিশীল হয়ে তাদের দেশে রোহিঙ্গাদের একটি অংশ নিতে পারে। এ্যাকশন এইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির জনকণ্ঠকে বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে রোহিঙ্গা সঙ্কটের গুরুত্ব সেভাবে থাকছে না। জাতিসংঘের সংস্থাগুলো বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে অর্থ সাহায্য পায়। এসব দেশের কাছে রোহিঙ্গা সঙ্কটের গুরুত্ব কমলে অর্থ সহায়তাও কমে যেতে পারে। সরকারের বিভিন্ন দফতর, কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ও জাতিসংঘের বিভিন্ন সূত্রের তথ্য বলছে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা ৭ লাখ ৪৫ হাজার। এর আগে একই কারণে ১৯৭৮-৭৯, ১৯৯১-৯২ ও ১৯৯৬ সালেও মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। আশ্রয় নেয়ার পর রোহিঙ্গাদের জন্য তৈরি করা আশ্রয় ক্যাম্পে নতুন করে জন্ম নিয়েছে আরও ৬০ থেকে ৬৫ হাজার রোহিঙ্গা শিশু। সব মিলিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১১ লাখ ১৮ হাজারের কিছু বেশি। এদিকে ২০১৮ সালের জুন মাসে জাতিসংঘের তৈরি করা এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার পেছনে সরকারের বছরে ব্যয় হতে পারে কমপক্ষে ৬০ কোটি ডলার। দুই বছরে এর পরিমাণ ১২০ কোটি ডলার। যা বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখার ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা। গত বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন তার দফতরে সাংবাদিকদের জানান, রোহিঙ্গাদের জন্য একদিকে বৈদেশিক সাহায্য কমছে, অন্যদিকে বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে নিজেদের তহবিল থেকে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা শরণার্থীদের জন্য খরচ করেছে। বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ভবিষ্যত অন্ধকার বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রথমদিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যেভাবে সাহায্য নিয়ে এগিয়ে এসেছিল, সেটির মাত্রা কমে যাচ্ছে। আগামীতে আরও কমবে। এখন তারা খুব সুখে আছে কিন্তু তাদের সুখ খুব বেশিদিন থাকবে না জানা গেছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে জাতীয় বাজেটে রোহিঙ্গাদের জন্য ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় দেয়া হয়। ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য বাংলাদেশ খাদ্য, আবাসন, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য জরুরী সেবাসহ আনুষঙ্গিক ভৌত সেবা সুবিধা প্রদান করছে। রোহিঙ্গাদের জন্য স্থায়ী আবাসন গড়তে নোয়াখালীর ভাসানচরে আবাসন নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় ১২০টি গুচ্ছগ্রামে এক হাজার ৪৪০টি ব্যারাক ও ১২০টি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণে মোট ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ৩২৩ কোটি টাকা। যার পুরোটাই সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে যোগান দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্র। এনজিওবিষয়ক ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৯ সালের আগস্ট পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের ভরণপোষণে ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ৭৪৮ কোটি ৯১ লাখ টাকা। এ সময় ১৩৪টি দেশী এনজিও ৬৯৬টি প্রকল্পের মাধ্যমে ব্যয় করেছে ১ হাজার ৩১৫ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। আর আন্তর্জাতিক ৫৫টি এনজিও ৩২৫টি প্রকল্পে ব্যয় করেছে ১ হাজার ৪৩৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা। চলতি মাসের ২৫ তারিখ পর্যন্ত ১৯টি এনজিও ২৭টি প্রকল্পে ব্যয় করেছে ৬৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এ মাসে দেশীয় ১৪টি এনজিও ২২টি প্রকল্পে ব্যয় করেছে ৫৮ কোটি ৩৫ লাখ টাকা এবং পাঁচটি আন্তর্জাতিক এনজিও পাঁচটি প্রকল্পে ব্যয় করেছে ৫ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। এনজিও ব্যুরোর তথ্য বলছে, এ পর্যন্ত শেল্টার নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ২৫৬ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। এ পর্যন্ত মোট নির্মাণ করা হয়েছে ১ লাখ ৩৯ হাজার ১২৭টি শেল্টার। কক্সবাজার জেলা প্রশাসন থেকে পাওয়া আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের চিহ্নিতকরণ-সংক্রান্ত একটি কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার বসবাসের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে প্রায় এক লাখ ৬৫ হাজার আশ্রয় ক্যাম্প। পাহাড় ও বন কেটে স্থাপন করা হয়েছে এসব আশ্রয়ক্যাম্পের অবকাঠামো। এ কারণে উজাড় হয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার একর সংরক্ষিত বনভূমি। এতে ৩৯৭ কোটি ১৮ লাখ ৩৭ হাজার ৩৯৩ টাকার সমপরিমাণ জীববৈচিত্রের ক্ষতি হয়েছে। এদিকে বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন ২০১২-এর ৪/১৪ (ক)-অনুযায়ী সংরক্ষিত বনাঞ্চলের দুই কিলোমিটারের মধ্যে কোন প্রকার অবকাঠামো বা স্থাপনা নির্মাণ করার ক্ষেত্রে আইনগত বাধ্যবাধকতা থাকলেও বাংলাদেশ বন বিভাগের এই আইন উপেক্ষা করে কক্সবাজারের কুতুপালংয়ের ৪০১ দশমিক ৪০ একর, জামতলী ও বাঘঘোনার ৫১৬ একর, বালুখালীর ৮৩৯ একর, তাজনিমা খোলার ৪৫১ একর, উখিয়ার বালুখালী ঢালা ও ময়নারঘোনার ৩১০ একর, শফিউল্লাহ কাটা এলাকার ২০১ দশমিক ২০ একর, নয়াপাড়ার ২২৪ একর, টেকনাফের হোয়াইক্যংয়ের পুঁটিবুনিয়ার ৮৮ দশমিক ৬০ একর, কেরনতলী ও চাকমারকুল এলাকার ৭৯ দশমিক ৮০ একর এবং লেদারের ৪৫ একর সংরক্ষিত বনভূমি উজার করে রোহিঙ্গাদের জন্য আবাসন ক্যাম্প গড়ে তোলা হয়েছে। কক্সবাজার বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, স্থানীয় হিসাবে এই পরিমাণ জমির দাম দাঁড়ায় প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। যা সরকারের নিজস্ব সম্পত্তি। এনজিও ব্যুরোর তথ্য বলছে, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যয়ের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় খাত হচ্ছে স্বাস্থ্য। এ খাতে স্বাস্থ্য যন্ত্র, সেবা এবং ওষুধে ব্যয় করা হয় অর্থ। খাদ্য সরবরাহে ব্যয় হয়েছে ১৭৮ কোটি ১৩ লাখ টাকা। স্যানিটেশন ও পানি সরবরাহ করে ব্যয় হয়েছে ৪৮ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। কম্বলসহ শীতবস্ত্র বিতরণ হয়েছে ৮০ কোটি ৬৯ লাখ টাকার। ৯৭ কোটি ১০ লাখ টাকার বিতরণ হয়েছে গৃহস্থালী সামগ্রী। এছাড়া স্যানিটারি ল্যাট্রিন বিতরণ করা হয়েছে ৩২ হাজার ৬৫টি, বাথরুম ১৫ হাজার ৬৬০টি এবং টিউবওয়েল নির্মাণ করা হয়েছে ২২ হাজার ৩৮৬টি। যতইদিন যাচ্ছে চাহিদা এবং ব্যয় দুটোই বাড়ছে। এদিকে রোহিঙ্গা এলাকায় কাজ করতে চায় অনেক এনজিও। তাই যতইদিন যাচ্ছে ততই বাড়ছে এনজিও সংখ্যা এবং ব্যয়ের পরিমাণ। নতুন করে নিবন্ধন পেতে এনজিও ব্যুরোতে জমা পড়েছে শতাধিক আবেদন। এদিকে অনিয়ম-দুর্নীতির নানা অভিযোগে ছয়টি এনজিওর কর্মকা- বন্ধ করে দিয়েছে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা এনজিও ব্যুরো। বিশেষ করে, স্মল কাইন্ডনেস অব বাংলাদেশ, এসকেবি এবং বাংলাদেশী চাষী কল্যাণ সমিতির কর্মকা- পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এছাড়া মুসলিম এইড ইউকে, ইসলামিক এইড, নমিজান ফাউন্ডেশন এবং ইসলামী রিলিফের কর্মকা- কক্সবাজার এলাকায় বন্ধ করে দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। পুলিশের গোপন প্রতিবেদন এবং নিয়মবহির্ভূত কাজে জড়িত থাকায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এছাড়া ৮ থেকে ১০টি এনজিও’র কর্মকা- মনিটরিং করছে এনজিও ব্যুরো।
×