ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সব সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর

প্রকাশিত: ১০:৫৮, ২৮ আগস্ট ২০১৯

সব সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর

স্টাফ রিপোর্টার ॥ অতিরিক্ত গাড়ির চাপ, যত্রতত্র পার্কিং আর নিয়ম মেনে গাড়ি না চালানোর কারণে ভোগান্তি বাড়ে মানুষের। শুধু রাজধানীতেই নয় মহাসড়কেও ভোগান্তি রয়েছে। বিভিন্ন উৎসবে ভোগান্তি বাড়ে কয়েকগুণ বেশি। সড়কে অনেক সময় যানবাহন শৃঙ্খলাভাবে চালানো হয় না। মানা হয় না অনেক নিয়মকানুন। তাই দেশের সব সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর এমন নির্দেশনায় দ্রুতই শৃঙ্খলা ফিরবে আশা করছেন বিশিষ্টজনরাও। এছাড়া জেলা বা উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে যেতে না চাওয়ায় চিকিৎসকদের প্রতি ক্ষোভ, বিরক্তি প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। মঙ্গলবার শেরেবাংলা নগরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় এসব সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোসহ প্রধানমন্ত্রী কিছু নির্দেশনা দেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী ও একনেক চেয়ারপার্সন শেখ হাসিনা। সভায় ১২ প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে একনেক। এগুলো বাস্তবায়নে মোট খরচ ধরা হয়েছে ৫ হাজার ৪৯৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারী তহবিল থেকে ৫ হাজার ৪১৬ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক সহায়তা থেকে ৭৮ কোটি টাকা খরচ ধরা হয়েছে। পরে ব্রিফিংয়ে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনাসহ প্রকল্পের বিস্তারিত তুলে ধরেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। এ সময় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন- পরিকল্পনা সচিব নুরুল আমিন, সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব সৌরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী এবং ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য শামীমা নার্গিস। পরিকল্পনামন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার কথা উল্লেখ করে বলেন, একনেক সভায় ‘খুলনা-চুকনগর-সাতক্ষীরা মহাসড়ক খুলনা চারলেনে উন্নীতকরণ’ প্রকল্পটি অনুমোদন দেয়া হয়। প্রকল্পটি অনুমোদনের সময় কিছু ফুটেজ দেখানো হয়। ফুটেজে দেখা গেছে সড়কে যানবাহন এলোপাতাড়িভাবে রাখা। সড়কও আঁকাবাঁকা। এসব ছবি দেখে প্রধানমন্ত্রী সড়কের শৃঙ্খলা ফেরানোর নির্দেশ দেন। একনেক সভায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ড্রাইভার- হেলপারদের জন্য সড়কের পাশে আধুনিক বিশ্রামাগার নির্মাণ করা হবে। শ্রমিক, চালক, হেলপারদের প্রতি মানবিক সুবিধা রাখা, সহযোগী হওয়ার আহ্বানও জানান প্রধানমন্ত্রী। এছাড়া রাস্তার পাশে গাছ লাগানোর কথা বলেছেন। বিশেষ করে খুলনা চুকনগর-সাতক্ষীরা সড়কে বাঁশজাতীয় গাছ লাগানোর পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ট্রাফিক সংশ্লিষ্টদের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সড়কে নির্দিষ্ট নিয়মকানুন থাকলেও অনেক সময় চালক বা যাত্রী উভয়ই মানতে চায় না; এর ফলে উভয়ের ভোগান্তি বাড়ে দীর্ঘ হয় জট। ট্রাফিক বিভাগের এক উর্ধতন কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, ব্যস্ত সড়ক পার হতে যে যেভাবে পারে পার হতে চায়। ফলে জটলা বেড়ে যায়। অনেক সময় যত্রতত্র পার্র্কিং থাকে। নো পার্কিংয়ে পার্কিং রাখে। আমাদের চেষ্টার ত্রুটি থাকে, বলেন তিনি। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের অভিমত, এই ধরনের নির্দেশনা যে কোন বিষয়কে আরও গুরুত্ব দেয়া হয়। এর ফলে আশা করা যায় ভবিষ্যতে দ্রুতই সড়কের শৃঙ্খলা ফিরবে। বিশিষ্টজনরাও আশা প্রকাশ করেছেন সড়কে শৃঙ্খলা ফেরার বিষয়ে। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক সড়কের শৃঙ্খলা ও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা নিয়ে জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা প্রায়ই দেখি প্রধানমন্ত্রী অনেক বিষয়ে অনুশাসন দেন। অনেক ইচ্ছা-অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসনকে অবশ্যই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া উচিত। তবে অনেক সময় দেখা যায় আমলাতন্ত্রের জটিলতায় বাস্তবায়নে সমস্যা তৈরি করে। এক্ষেত্রে আমাদের জনপ্রতিনিধিদের আরও বেশি মনিটরিংয়ের দায়িত্ব দিতে হবে। কিংবা প্রধানমন্ত্রীর আস্থাভাজন ব্যক্তিদের পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব দিতে হবে, প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন বা যে কোন কাজ সঠিকভাবে হচ্ছে কিনা তা দেখার জন্য। তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী সাধারণ জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত বা যে বিষয়টি জনগণকে বেশি ভোগাচ্ছে তা দ্রুত সমাধানের ক্ষেত্রে এমন নির্দেশনা দেন। এসব বাস্তবায়নে জনপ্রতিনিধি ও আমলাদের সম্পর্ক ভাল থাকতে হবে। দ্রুতই সড়কে শৃঙ্খলা ফিরবে এমন আশা প্রকাশও করেন তিনি। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষকও মনে করেন নির্দেশনার আলোকে বাস্তবায়ন দরকার। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় বিশেষ গুরুত্ব পাবে এই শৃঙ্খলার বিষয়টি। আর শৃঙ্খলা ফিরলে স্বস্তি পাবে সবাই। এছাড়া একনেক সভায় প্রত্যন্ত অঞ্চলে ডাক্তারদের অনিহার বিষয়েও আলোচনা হয়েছে। ‘কর্নেল মালেক মেডিক্যাল কলেজ ও ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল স্থাপন, মানিকগঞ্জ’ প্রকল্পের প্রসঙ্গ এলে প্রধানমন্ত্রীকে জানানো হয়, সেখানেও চিকিৎসকরা যেতে চান না। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য তুলে ধরে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ডাক্তার আমরা দিই, কিন্তু ডাক্তার যেতে চান না। এজন্য প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এটা তো আমাদের চেষ্টা করতে হবে মিটমাট করার জন্য। তিনি (প্রধানমন্ত্রী) মনে করেন, ডাক্তাররা যেখানে চাকরি করেন, সেখানে প্রাইভেট প্র্যাক্টিস করলে তবুও হয়ত কিছুটা ভাল হতো। চাকরি করেন এক জায়গায়, প্রাইভেট প্র্যাক্টিস করেন আরেক জায়গায় বা পার্টটাইম পড়ান আরেক জায়গায়, তখন তারা হাসপাতালে থাকতে পারেন না। দুঃখের সঙ্গে, বিরক্তির সঙ্গে, ক্ষোভের সঙ্গে, অভিমানের সঙ্গে কথাগুলো বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী এর আগেও কথাগুলো বলেছিলেন, আজ আবার পুনরাবৃত্তি করেছেন বলে মন্ত্রী জানান। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ড্রেন ওয়াটার সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন। নিজেরা করেন, বাড়ির আশপাশে খাল-বিল, পুকুর থাকে, সেগুলো পরিষ্কার করে তাতে পানি সংরক্ষণ করেন। কাজে লাগবে। বিশেষ করে আগুন লাগলে দমকল বাহিনী পানি পায় না। এটা খুব বেশি দরকার। সড়ক রক্ষার্থে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পণ্যবাহী কোন যানবাহন বা ট্রাক যাতে ওভারলোড হয়ে সড়কে না ওঠে সেজন্য সংশ্লিষ্টদের খেয়াল রাখতে হবে। সড়কের নিয়ম-শৃঙ্খলা রক্ষা করতে হবে। সড়কের পাশে একই ধরনের প্রকল্প যেন অনেকে বাস্তবায়ন না করে এই বিষয়টিও খেয়াল রাখতে হবে। ওভারলোডিংয়ের (মাত্রাতিরিক্ত চাপ) বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য তুলে ধরে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, আমাদের এখানে গ্রোয়িং ইকোনমি, ওভারলোডিং হয়। ওভারলোডিং সম্পর্কে আমরা সচেতন। ওভারলোডিং কমানোর জেনারেল ইন্সট্রাকশন এসেছে যে, আপনারা যান, খোঁজখবর নেন। আমরা স্বীকার করি, গ্রোয়িং ইকোনমির এই পর্যায়ে ওভারলোডিং পুরোপুরি এভয়েড করতে পারব না। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে জায়গা হচ্ছে না, হাসপাতালে জায়গা হচ্ছে না-সবকিছুই ওভারলোডিং। এগুলোকে সহ্য করে মনিটরিং করতে বলেছেন তিনি। নানা সংস্থা কাজ করছে। আপনারা একে অন্যের গায়ে ঠোকর মারবেন না- দেশে কাজ করা বিভিন্ন সংস্থার প্রতি এ আহ্বান রেখেছেন প্রধানমন্ত্রী। এছাড়া চট্টগ্রাম-মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে ভবন নির্মাণের সময় প্রতিটি ভবনে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা রাখার কথা সভায় উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। বৈঠকে অনুমোদিত প্রকল্পগুলো হচ্ছে- বেনাপোল স্থলবন্দরে কার্গো ভেহিকেল টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছে ২৮৯ কোটি টাকা। আলীকদম-জালানিপাড়া-করুকপাতা- পোয়ামহুরী সড়ক প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছে ৫০৯ কোটি টাকা। টেকসই ও নিরাপদ মহাসড়ক গড়ে তোলার জন্য ৪টি জাতীয় মহাসড়কের পাশে পণ্যবাহী গাড়ি চালকদের জন্য পার্কিং সুবিধা সংবলিত বিশ্রামাগার স্থাপন প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছে ২২৬ কোটি টাকা। বড়তাকিয়া থেকে মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল সংযোগ সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছে ১৮৩ কোটি টাকা। খুলনা-চুকনগর-সাতক্ষীরা মহাসড়কের খুলনা শহরাংশ চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছে ১০০ কোটি টাকা। উত্তরা এলাকায় পয়ঃশোধনাগার নির্মাণের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছে ১ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা। উত্তরা এই প্রকল্প অনুমোদনকালে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়ে বলেন, উত্তরা ঘনবসতি এলাকা প্রকল্পে বাস্তবায়নে যাতে স্থানীয় লোকদের ক্ষতি না হয় সেদিকে নজর রাখতে। এসময় প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এলাকা ঘনবসতি নয় দাবি করলে প্রধানমন্ত্রী আবারও বিষয়টি দেখার নির্দেশ দেন। অনুমোদন পাওয়া ইসিবি চত্বর হতে মিরপুর পর্যন্ত সড়ক প্রশস্তকরণ ও উন্নয়ন এবং কালশী মোড়ে ফ্লাইওভার নির্মাণ প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছে ১ হাজার ১২ কোটি টাকা। সমতল ভূমিতে বসবাসরত অনগ্রসর ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক ও জীবন মানোন্নয়নের লক্ষ্যে সমন্বিত প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছে ৩৫২ কোটি টাকা। পুকুর পুনঃখনন ও ভূউপরিস্থ পানি উন্নয়নের মাধ্যমে ক্ষুদ্র সেচে ব্যবহার প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছে ১২৮ কোটি টাকা। কর্নেল মালেক মেডিক্যাল কলেজ ও ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল স্থাপন, মানিকগঞ্জ প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছে ১ হাজার ৫৭ কোটি টাকা। বেগম আমিনা মনসুর টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট, কাজিপুর-সিরাজগঞ্জ প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছে ১১৯ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। সমন্বিত খামার ব্যবস্থাপনা অঙ্গ-দ্বিতীয় পর্যায় (আইএফএমসি-২) প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছে ১১৭ কোটি টাকা। সভায় উপস্থিত ছিলেন- অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, পরিকল্পনামন্ত্রী এম এম মান্নান, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মোঃ তাজুল ইসলাম, শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি, শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী শম রেজাউল করিম, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়কমন্ত্রী মোঃ শাহাব উদ্দিন, ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীবর্গ সভার কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেন। এছাড়া সভায় এসডিজির মুখ্য সমন্বয়ক, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যবৃন্দ, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং উর্ধতন কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন।
×