ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কাশ্মীর কোন্্ পথে

প্রকাশিত: ০৯:০৩, ২৮ আগস্ট ২০১৯

কাশ্মীর কোন্্ পথে

॥ চৌদ্দ ॥ মওলানা আব্বাস আনসারী সম্পর্কে শ্রীনগরের সর্বাধিক প্রচারিত ইংরেজী দৈনিক ‘গ্রেটার কাশ্মীর’-এর তরুণ সাংবাদিক এহসান চিশতি আমাকে বলেছ- ‘আনসারী সাহেব কাশ্মীরের শিয়া সম্প্রদায়ের নেতা। শিয়ারা এখানে এমনিতে পাকিস্তানবিরোধী। উন-আশিতে জেকেএলএফ যখন পাকিস্তানের সমর্থন নিয়ে কাশ্মীর স্বাধীন করার আন্দোলন শুরু করে তখন তারা হিন্দু প-িতদের ওপর হামলার পাশাপাশি শিয়াদেরও আক্রমণের লক্ষ্যে পরিণত করেছিল। মওলানা আনসারী শিয়াদের বাঁচানোর জন্য হুরিয়াতে যোগ দিয়েছেন। আমার সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার শেষে মওলানা আনসারী ইংরেজীতে লেখা তাঁর একটি চটি জীবনী পুস্তিকা দিয়েছিলেন, যার শিরোনাম- ‘এ স্টার্বন কাশ্মীরী ক্রুসেডার।’ চার রঙে দামী কাগজে ছাপা, ভেতরেও চাররঙা সব ছবি। চটি জীবনী থেকে জানা গেল পাকিস্তানপ্রীতি অন্যদের চেয়ে তাঁর এতটুকু কম নয়। ’৭৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে শেখ আবদুল্লাহর সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর চুক্তির প্রতিবাদে জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানে হরতাল আহ্বান করেছিলেন। মওলানার জীবনীতে বলা হয়েছে, তার তখনকার সংগঠন পিপলস ইউনাইটেড ফ্রন্টের কঠিন প্রয়াসের কারণে কাশ্মীরেও সর্বাত্মক হরতাল হয়েছিল। অথচ সাক্ষাৎকারে মওলানা বলেছেন, তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে যোগ দেয়ার পক্ষে নন। হুরিয়াতের শরিক দল এবং তাদের নেতাদের সম্পর্কে চূড়ান্ত মন্তব্য করা খুব কঠিন। কারণ, তারা প্রতিনিয়ত নীতি ও কৌশল পরিবর্তন করছেন এবং তা করছেন প্রধানত পাকিস্তানের পরামর্শে, দ্বিতীয়ত: কাশ্মীরী জনসাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির প্রয়োজনে। মুজাহিদীনের জঙ্গী তৎপরতা সম্পর্কে তাদের মনোভাব নমনীয় হলেও প্রকাশ্যে নিজেদের তারা অহিংস আন্দোলনের সমর্থক বলেন। বর্তমানে হুরিয়াত কনফারেন্স দুই ভাগে বিভক্ত। দুটোই ইসলামপন্থী বিচ্ছিন্নতাকামী হলেও নমনীয় অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন মীর ওয়াইজ উমর ফারুখ, আর কট্টর অংশের নেতৃত্বে রয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর আলী শাহ গিলানী। তিরিশ বছর ধরে কাশ্মীরে পাকিস্তানের জেহাদ রফতানির প্রয়াস এবং মৌলবাদীদের জঙ্গী তৎপরতা কাশ্মীরের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত করলেও মৌলবাদ কি কাশ্মীরে শেকড় গাড়তে পারবে? এ প্রশ্ন আমার একার নয়, পশ্চিমের বহু কাশ্মীর গবেষকের জবাব খোঁজার চেষ্টা করছেন। কাশ্মীর মৌলবাদীদের সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সহজ ক্ষেত্র হতে পেরেছে প্রধানত ভৌগোলিক অবস্থার কারণে। কাশ্মীরের সঙ্গে দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে পাকিস্তানের। এই সীমান্তজুড়ে অতি দুর্গম পার্বত্য অঞ্চল। সীমান্তের মানুষদের আয়ের কোন সহজ উৎস নেই। জীবনযাত্রা অত্যন্ত কষ্টকর সেখানে। সীমান্তের মানুষদের মাদক ব্যবসা, অস্ত্র বহন এবং সন্ত্রাসী কার্যক্রমের জন্য সহজেই রিক্রুট করা যায় অর্থের বিনিময়ে। তবে কাশ্মীরী সমাজে, এমনকি ধর্মীয় জীবনে মৌলবাদ কখনও ছিল না। পাঁচ হাজার বছরের প্রাচীন কাশ্মীরের সভ্যতা। কাশ্মীরীদের আদি ধর্ম ছিল হিন্দু বা সনাতন ধর্ম। হিন্দু ধর্মের পরে কাশ্মীরে একে একে বৌদ্ধ ধর্ম এসেছে, জৈন ধর্ম এসেছে, ইসলাম ধর্ম এসেছে। পাকিস্তানে ইসলাম প্রচারিত হয়েছে প্রধানতঃ তলোয়ারের জোরে। কাশ্মীরে ইসলাম প্রচারিত হয়েছে সুফীদের দ্বারা, যাঁরা শান্তি ও সম্প্রীতির কথা বলেছেন। কাশ্মীরীদের অবিসংবাদী নেতা শেখ আবদুল্লাহ প্রায়ই বলতেন, তিনি যে ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের কথা বলেন তা কাশ্মীরের সুফীবাদের সমার্থক, সকল মত ও পথের মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, যাকে তিনি বলতেনÑ ‘কাশ্মীরীয়াৎ’। বাংলায় মধ্যযুগের চন্ডীদাস যেমন শুনিয়েছিলেন, ‘শুনহ মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’Ñ তারও একশ’ বছর আগে কাশ্মীরে শেখ নূরউদ্দিন ওয়ালি, যিনি হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকল কাশ্মীরীর প্রিয় ‘নুন্দ ঋষি’ বহুত্বের ভেতর ঐক্যের সন্ধান করেছিলেন, যা মানবিক মূল্যবোধের চূড়ান্ত রূপ। নুন্দ ঋষি প্রায় ছয়শ’ বছর আগে বলেছিলেন, ‘একদিন অশুভ শক্তি কাশ্মীরকে ধ্বংস করে দেবে, যখন পবিত্র স্থানগুলো আগুনে জ্বলবে।’ কাশ্মীরে সুফীবাদী এই ধর্মীয় গুরু ও কবি নুন্দ ঋষির মাজার হচ্ছে চারার-এ শরীফ, যা ’৯৫-এর ১১ মে ঈদ-উল আজহার দিন ধ্বংস হয়েছে জঙ্গী মৌলবাদীদের দ্বারা। চারার-এ শরীফকে তারা তাদের ঘাঁটি বানিয়েছিল। দিল্লীতে মওলানা ওয়াহিদউদ্দীন খান চারার-এ শরীফ ধ্বংসের বিবরণ দিয়ে বলেছিলেন, হাজার বছর ধরে কাশ্মীর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এখানে মৌলবাদ কখনও শেকড় গাঁড়তে পারবে না। শ্রীনগরের সাধারণ মানুষ হুরিয়াত কনফারেন্স সম্পর্কে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেও জঙ্গী মৌলবাদীদের সন্ত্রাসী তৎপরতা সম্পর্কে খুবই বীতস্পৃহ। কারণ, তারা খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের রুটি রুজি অনিশ্চিত করেছে। লালচকের শাল বিক্রেতা অপ্রত্যাশিত কম দামে শাল বিক্রি করতে গিয়ে বলেছিল, ‘খোদার কসম বলছি, অন্য সময় হলে এই দুটো শালে কম করে হলেও এক হাজার টাকা লাভ করতাম। আপনাকে যে দামে বিক্রি করলাম তাতে দুটোতে লাভ হবে দু’শ’ টাকা মাত্র।’ শ্রীনগরে যে কদিন ছিলাম সুলতানের গাড়িতেই ঘুরছি। নেতাদের সবাইকে ও চেনে। তিন ছেলের গর্বিত পিতা। বড় ছেলে কলেজে পড়ছে বিজ্ঞান বিভাগে। ছেলেকে ডাক্তার বানাবার ইচ্ছে। প্রায় পঞ্চাশের কাছে বয়স হলেও ওর সঙ্গে বন্ধুর মতো ব্যবহার করি, গাড়িতে বসি পাশের সিটে, দুপুরে খাওয়ার সময় একসঙ্গে কোনও রেস্তোরাঁয় বসে খাই, ওর পছন্দ মতো খাবারের অর্ডার দিতে বলিÑ সুলতান এতে দারুণ খুশি। প্রথম দিনে জেকেএলএফ-এর অফিসে ঢোকার সময় জিজ্ঞেস করেছিল আমার সঙ্গে ও থাকতে পারে কি-না। ওকে বলেছি, ‘নিশ্চয়ই পারো, তবে দয়া করে কাউকে বোলো না আমি কখন কোথায় যাচ্ছি।’ এতে সুলতান আহত হয়েছেÑ ‘আমি আপনার নিমক খেয়েছি। আমরা কখনও নিমকহারামি করি না।’ সুলতানকে অনেক বলেও ওর ‘স্যার’ আর ‘আপনি’ বলা ছাড়াতে পারিনি। তবে নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে সঙ্গে থাকার অনুমতি পেয়ে সুলতান রীতিমতো ভক্ত বনে গেছে। শুধু দুটো বৈঠকে প্রটোকলের কারণে ওকে সঙ্গে রাখা সম্ভব হয়নি। একটি হচ্ছে মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ ফারুখ আবদুল্লাহর সঙ্গে, অপরটি জেনারেল কিষেণ পালের সঙ্গে। শুধু প্রটোকল নয়, নিরাপত্তার প্রশ্নও জড়িত ছিল। সুলতান শেখ আবদুল্লাহর ভক্ত। শেখ আবদুল্লাহকে ও বলে ‘বাবায়ে আযম’। ওর মতে বাবার মতো শেরদিল না হলেও মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শেখ আবদুল্লাহর পর ফারুখ আবদুল্লাহ ভাল চালাচ্ছেন। সুলতানকে কিছু জিজ্ঞেস করলে খুব ভেবে-চিন্তে মত দেয়। হুরিয়াতের নেতাদের সম্পর্কে ওর বক্তব্যÑ ‘এরা এক এক সময় এক এক কথা বলে। তবে শ্রীনগরে ওদের জনসভায় লোক হয়, হরতাল ডাকলে তাও হয়। অনেকে হুরিয়াত কনফারেন্সকে রসিকতা করে ‘হরতাল কনফারেন্স’ বলে। ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘ওরা যে নির্বাচন বয়কটের কথা বলে সাধারণ মানুষ কি ওদের কথা শোনে?’ সুলতান বিজ্ঞের মতো বলল, ‘নির্বাচন ওরা ঠেকাতে পারবে না। তবে গণ্ডগোল হবে।’ গ-গোল কারা করবে এর জবাবে সুলতান বললো, ‘কেন, মিলিট্যান্ট লোগ!’ জঙ্গীদের কে কিভাবে উল্লেখ করে তা থেকে বোঝা যায় সে তাদের সমর্থন করে কি করে না। জঙ্গীদের কেউ যদি ‘মুজাহিদীন’ বলে তাহলে বুঝতে হবে সে তাদের সমর্থক। যারা পছন্দ করে না তারা বলবে ‘মিলিট্যান্ট লোগ’। বই কিনতে গিয়ে কিতাব ঘরের দোকানিকে সহানুভূতি জানাবার জন্য বলেছিলাম ‘মুজাহিদীনদের জন্য ব্যবসায় বুঝি খুব মন্দা যাচ্ছে?’ বিরক্ত হয়ে দোকানি জবাব দিয়েছেন, ‘মুজাহিদীন কাদের বলছেন? ওরা কিসের মুজাহিদীন? ওরা হচ্ছে মিলিট্যান্ট। বর্ডারের ওদিক থেকে আসে গণ্ডগোল বাঁধাবার জন্য।’ ‘বর্ডারের ওদিক মানে পাকিস্তান থেকে?’ ‘পাকিস্তান থেকেও অনেকে আসে। বেশি আসে মুজাফফরাবাদ থেকে।’ মুজাফফরাবাদ হচ্ছে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের রাজধানী। শ্রীনগরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কোর কমান্ডার লেঃ জেনারেল কিষেণ পাল বলেছেন, এপার থেকে কিছু তরুণকে তারা ভয় দেখিয়ে দলে ভিড়িয়েছিল। পরে ওদের কেউ কেউ আত্মসমর্পণ করেছে, কেউ সামরিক অভিযানে ধরা পড়েছে। এদের সবাইকে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। এদিকের ছেলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে খুব কমই মুজাহিদীনদের খাতায় নাম লিখিয়েছে। পশ্চিমের যেসব লেখক ও সাংবাদিকের পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের মুজাফফরাবাদ, গিলগিট, বাল্টিস্তান প্রভৃতি অঞ্চল দেখার সুযোগ হয়েছে তারা প্রত্যেকে বলেছেন সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান সীমান্তের ওপারে আরও শোচনীয়। কাজের জন্য অনেকে সীমান্ত অতিক্রম করে এপারে আসে। কাশ্মীরে জঙ্গী তৎপরতা শুরু হওয়ার পর থেকে যে সব তরুণ কোনও সাতেপাঁচে নেই তাদের অবস্থা সবচেয়ে বেশি খারাপ। সর্বক্ষণ ওদের ওপর নজর রাখা হয়, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় গেলে বার বার জেরা এবং দেহ তল্লাশির মুখোমুখি হতে হয়। কাজের জন্য কাশ্মীর ছেড়ে অন্য কোথাও গিয়ে খুব একটা সুবিধে করতে পারছে না। কাশ্মীর থেকে এসেছে শুনলে অমনি তাকে সন্দেহের চোখে দেখা হয়। জম্মু-কাশ্মীরের বাইরে সাধারণ মানুষের ধারণা কাশ্মীরের সব যুবক বুঝি মুজাহিদীনদের দলে নাম লিখিয়েছে। কেউ কোথাও কাজ পেলেও হয়রানি পিছু ছাড়ে না। কাশ্মীরের তরুণরা সব কিছুতেই বীতস্পৃহ হয়ে উঠেছে। শ্রীনগরে প্রথম দিনই আলাপ হয়েছিল এহসান চিশতির সঙ্গে। সাতদিনে রীতিমতো বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। ওকে বাংলাদেশ থোক আনা শার্ট আর বই উপহার দিয়েছি, রেস্তোরাঁর একসঙ্গে খেয়েছি। বিনিময়ে ও দিয়েছে গত দশ বছরের আন্দোলনের বহু দুর্লভ আলোকচিত্র। আলাপ করিয়ে দিয়েছে স্থানীয় ইংরেজী দৈনিকের সাংবাদিকদের সঙ্গে। কাজ চালাবার মতো উর্দু বলতে পারি বটে তবে শিক্ষিত বিদগ্ধজনের সামনে নয়। এহসান পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল দৈনিক ‘গ্রেটার কাশ্মীর’-এর প্রধান আলোকচিত্রি ফারুখ জাভেদের সঙ্গে। ফারুখ ইংরেজীতে সড়গড় নয় বলে আলাপ জমেনি। এহসানের সঙ্গে বইয়ের দোকানে গিয়েছি। যে কটা বই পছন্দ হয়েছে বেছে দাম দিতে গিয়েছি এহসান বাধা দিয়েছে। জোর করে নিজে বইয়ের দাম দিয়েছে। (ক্রমশ.)
×