ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ভারতের মেঘালয় থেকে এক বীর মুক্তিযোদ্ধাকে লেখা আমার বাবার একটি অপ্রকাশিত চিঠি

প্রকাশিত: ০৯:০২, ২৮ আগস্ট ২০১৯

ভারতের মেঘালয় থেকে এক বীর মুক্তিযোদ্ধাকে লেখা আমার বাবার একটি অপ্রকাশিত চিঠি

আগস্ট বাঙালী জাতির জন্য একটি শোকাবহ মাস। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ মাসে স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতকদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন। শোক এবং বেদনাহত এই মাসে জাতির পিতা এবং তাঁর পরিবারের শহীদ সদস্যদের গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি এবং আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। আজ ২৮ আগস্ট। এই দিনটি আমার পরিবারের জন্য একটি শোকাবহ দিন। ২০১২ সালের এই দিনে আমার পিতা ডাঃ আখলাকুল হোসাইন আহমেদ হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। আমি আজকের এই দিনে আমার মরহুম পিতার আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭০-এর নির্বাচনে ময়মনসিংহ- ২২ আসন থেকে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে আমার পিতাকে মনোনয়ন দেন। জনগণের ভোটে তিনি প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বিজয়ের প্রাক্কালে ১৯৭১-এর ১১ ডিসেম্বর তিনি ভারতের মেঘালয় রাজ্যের মহেষখলা ক্যাম্প ইনচার্জ এবং ঈরারষ অফসরহরংঃৎধঃরড়হ ঈড়ঁহপরষ ড়ভ ইযধষর অৎবধ ড়ভ গুসবহংরহময ঘ. ঊ. তড়হব ঘড়-ওও-এর চেয়ারম্যান থাকাকালীন নেত্রকোনার মোহনগঞ্জের বীর মুক্তিযোদ্ধা ইছাক মিয়াকে একটি চিঠি লিখেছিলেন; যা ৪৭ বছর পর আমার হস্তগত হয়। গত বছর (২০১৮ সালে) গাজীপুরে ময়মনসিংহের মোহনগঞ্জ উপজেলা সমিতির ছেলেমেয়েদের এক পিকনিকে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। সেখানে বীর মুক্তিযোদ্ধা ইছাক মিয়ার ভাতিজা কাঞ্চন এই চিঠিটি আমার হাতে হস্তান্তর করেন। আমার পিতার এ রকম একটি চিঠি পেয়ে আমি এতটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি যেÑ চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আমার পিতার মতো মুক্তিযোদ্ধাদের কষ্টের বিনিময়েই তো আমাদের এ স্বাধীনতা। এমন একটি প্রাসঙ্গিক দলিল থেকে মুক্তিযোদ্ধারা কত কষ্ট, কত বৈরী পরিবেশের ভেতর দিয়ে দেশটাকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীন করেছিল। সেই বিষয়টি নতুন প্রজন্মকে অবহিত করার জন্যই চিঠিটা প্রকাশ প্রয়োজনীয় মনে হলো। আজকের এই দিনে, আমি যাঁরা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে দেশের স্বাধীনতায় অবদান রেখে গেছেন তাদেরও গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। আমার আব্বা ডাঃ আখলাকুল হোসাইন আহমেদ চিঠি লিখতে ভালবাসতেন। সাধারণত চিঠি আব্বা প্রেসক্রিপশন প্যাডেই লিখতেন। আব্বাকে দেখেছি, এক টানে দ্রুতই লিখে ফেলতে পারতেন। সে সময় তো মোবাইল বা মেসেঞ্জার ছিল না, তাই মানুষ চিঠি লিখত। মনের কথাগুলো লিখে ডাক বাক্সে রেখে আসত। এখন মানুষ খুব কমই চিঠি লেখেন। আব্বার চিঠির বিষয় ছিল নানাবিধ। তিনি মানুষকে খুব ভালবাসতেন। বিষাদে-আনন্দে মানুষের পাশে থাকতেন। ধরুন, আমাদের হাওরাঞ্চলের কোন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় খুব ভাল ফল করেছে কিংবা চাকরি পেয়েছে- আব্বা তাকে চিঠি লিখে অভিনন্দন জানাতেন। কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করেছে, আব্বা সে স্কুলের প্রধান শিক্ষকসহ স্কুলকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে চিঠি লিখতেন। যাকে চিঠি লিখছেন, তাকে হয়ত তিনি চেনেনও না, তবু ঠিকানা সংগ্রহ করে অভিনন্দন জানিয়ে চিঠি লিখে উৎসাহ দিতেন। কৃতিমান শিক্ষার্থীদের তিনি শুধু চিঠিই লিখতেন না, পুরস্কারস্বরূপ ২০ কিংবা ৫০ টাকা হাতে গুজে দিতেন। তরুণ প্রজন্মের সাফল্যে খুব গর্বিত হতেন। ভারতের মহেষখলা, মহাদেও, রংড়া, তুড়া এই অঞ্চলগুলোতে একজন আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে ক্যাম্প ইনচার্জ হিসেবে, ডাক্তার হিসেবে তিনি কাজ করছিলেন। তিনি সিভিল এডমিনিস্ট্রেশন কাউন্সিল চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করেন। যে চিঠিটা সংযুক্ত সেটাও এ ধরনের একটি প্যাডে লেখা। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে চিঠিতে তিনি হয়ত দায়িত্ব ও পরিস্থিতিকেই লিখেছিলেন। ক্যাম্প থেকে ক্যাম্পে বার্তা পাঠিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহ ও ট্রেনিংয়ে পাঠানোর জন্যও হয়ত গুরুত্বপূর্ণ চিঠি লিখেছেন। এই চিঠিগুলোই হতে পারত সময় ও মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত দলিল। আব্বার সেই হৃদয়-নিংড়ানো দায়িত্বপূর্ণ লেখাগুলো যদি আমরা খুঁজে পেতাম! মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের বাসায় লুট হয়। বাসার একটা অংশ পুড়িয়েও দেয়া হয়। হারিয়ে যায় অনেক দুর্লভ জিনিসপত্র। ব্যবহৃত জিনিস লুট হলে কেনা যায়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সেই চিঠিগুলো কোথায় পাব! এই চিঠিগুলো আমার আব্বার স্মৃতি ছিল। লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস ছিল। আসলে, এই চিঠিগুলোই আমাদের সময় ও জীবনের প্রাণের দলিল। এর চেয়ে তাজা ইতিহাস আর কি হতে পারে! আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা আব্বার লেখা চিঠিগুলো যতœ করে সংগ্রহ করতে পারিনি। আব্বার হারিয়ে যাওয়া চিঠিগুলোর জন্য আজ খুব আক্ষেপ হয়। যে চিঠিটার কথা লিখতে যাচ্ছি সেখানে আমার বাবার আবেগ, দেশের প্রতি মমত্ববোধ, দায়িত্ব, কিছু কষ্ট সবই উঠে এসেছে। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে মহেষখলা থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধা ইছাক মিয়াকে লেখা চিঠিটির কিছু অংশ তুলে ধরছি : চিঠির একটি জায়গায় তিনি সম্মুখ সারির কয়েক মুক্তিযোদ্ধাকে সম্বোধন করে বলেছেন, ‘মোহনগঞ্জ আসার জন্য আমার মন ব্যাকুল হয়ে পড়েছে। তুমি হয়ত জান আমাদের একটা ইরহফরহমং আছে; এভাবে চলে আসতে পারি না। সরকারের একটা নির্দেশের দরকার। জনগণ নিশ্চয়ই তোমাদের ঘিরে আছে। আমার তরফ থেকে তাদের সংগ্রামী সালাম জানাইয়া আমার না আসার কারণ জানাইয়া দিও।’ একদিকে অস্থায়ী সরকারের প্রতি আনুগত্য অপরদিকে বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে দেশে আসার ব্যাকুলতা। অন্য একটি অংশে তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্বোধন করে লিখেছেন, ‘তুমি থানায় আছো; হীরা বাজারে ও মহব্বত আলী স্টেশনের দিকে আছে। উরংঃৎরনঁঃরড়হটা ভালই হয়েছে। নানা লোকে নানাভাবে তোমাদের নানা চাতুরী কথা বলবে। খুব চিন্তা করে; তার সম্বন্ধে ভালভাবে অবহিত হয়ে কাজ করিও।’ যতটুকু আমার ধারণা তিনি বোঝাতে চেয়েছেন দেশ বিজয়ের পথে। বঙ্গবন্ধু তখনও দেশে ফেরেননি। স্থানীয় প্রশাসন কাঠামো তৈরিতে কিছুটা সময় নেবে। এই অন্তর্বর্তীকালীন সময়টুকু খুব সতর্কতার সঙ্গে চলতে হবে, যাতে সুযোগ সন্ধানীরা কোন অপকর্মে জড়িয়ে না পড়ে। চিঠির অন্য একটি অংশে তিনি লিখেছেন, ‘অতিশীঘ্রই আমরা ঈরারষ অফসরহরংঃৎধঃরড়হ চালু করার ইচ্ছা রাখি। অতি তাৎপর্যপূর্ণ একটি বাক্য। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ৯ মাসের যুদ্ধের পর দেশ নিশ্চিত বিজয়ের পথে। আবার দেশ পুনর্গঠনে নামতে হবে। থেমে গেলে চলবে না। এত কষ্ট করে দিনাতিপাত করছেন এরপর দেশ কি করে ভালভাবে চলবে তাও চিন্তা করছেন। দেশপ্রেম না থাকলে এ ধরনের কমিটমেন্ট থাকে না। ১১ ডিসেম্বর, ১৯৭১ লেখা এই চিঠিতে উঠে এসেছে মোহনগঞ্জ বিজয়ের স্পষ্ট আনন্দ। চিঠিতে মোহনগঞ্জের কথা বলা আছে। পাঞ্জাবীরা, দালালরা থানা ছেড়ে পালিয়েছে। মোহনগঞ্জের পুরো নিয়ন্ত্রণ এখন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের অভিনন্দন জানাচ্ছেন। স্থানীয় জনগণকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন। সিভিল এডমিনিস্ট্রেটরের দায়িত্বে থাকায় এই আনন্দ মিছিলে যোগ দিতে পারছেন না। কিন্তু চিঠি পড়ে বোঝা যায়, উনার মনটা এই আনন্দ মিছিলে মিশে গেছে। চিঠিতে উঠে এসেছে আমাদের বাড়ি লুটের কাহিনী। তিনি চিঠিতে উল্লেখ করেন লোকমুখে শুনেছেন কারা আমাদের বাড়ি লুট করেছে, কার বাড়িতে কোন্ জিনিসটি আছে, কারা কারা আমাদের বাড়িতে আগুন দিয়েছে- আব্বা সবই জানতেন। আসলে, মুক্তিযুদ্ধ সংগঠকের দায়িত্ব নিয়ে চলে যাওয়ার পর আব্বা আমাদের পরিবারটি নিয়ে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন ছিলেন। তিনি জানতেন, পরিবারের ওপর হামলা হতে পারে। তাই আম্মাকে আমাদের মোহনগঞ্জের বাসা থেকে চলে আসার পরামর্শ দিয়েছিলেন। অবশ্য পরবর্তী সময়ে আমরাও মা, ভাই-বোনসহ ভারতে মেঘালয়ের মহেষখলায় আব্বার ওখানে চলে যাই। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের বাড়ির জিনিসপত্র লুট হয়েছিল। বাড়ির একটা অংশ আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়। বিনা ফিতে যাদের নিত্য চিকিৎসাসেবা দিতেন, এমন মানুষও ফার্মেসির সব ওষুধ লুট করে নিয়েছিল। ইতিহাসকে কেউ মুছে দিতে পারে না। সময়ের প্রয়োজনেই মানুষের সামনে এসে দাঁড়ায় মানুষের কর্ম। এই চিঠিতে একাত্তরে বাংলাদেশ কেমন ছিল, মুক্তিযোদ্ধার বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে জীবনবাজি রেখে দেশকে স্বাধীন করার যে ব্রত নিয়ে কাজ করেছিল তা দৃশ্যমান হয়। একইসঙ্গে একজন মুক্তিযোদ্ধা, একজন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের আনন্দ-উৎকণ্ঠার প্রামাণ্য দলিল এই চিঠি। যা বর্তমান প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের বাস্তবতা অনুভব করতে সাহায্য করবে। লেখক : সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়
×