ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

এসেছে শরত

কাশফুলের ঝিলিক, স্বপ্ন ও শুভ্রতার প্রতীক

প্রকাশিত: ১০:১৪, ২৭ আগস্ট ২০১৯

কাশফুলের ঝিলিক, স্বপ্ন ও শুভ্রতার প্রতীক

তাহমিন হক ববী ॥ কাশফুলে ভরা যৌবন, আকাশে শারদীয় মেঘ। চেনা চেনা প্রকৃতি, তাও দৃশ্যপট মনোমুগ্ধকর। ছয় ঋতুর বাংলাদেশ। প্রতিটি ঋতুর রয়েছে আলাদা রূপ ও বৈচিত্র্য। আর তাই প্রকৃতির ধারাবাহিকতা শরত এসেছে তার অপরূপ নিজস্বতা নিয়ে। নীলফামারীর তিস্তা নদীর ধারে বাতাসে শুভ্র কাশফুলের দোল আর আকাশে সূর্যের সঙ্গে সাদা মেঘের শরত একই সূত্রে বেঁধে গেছে। ঝকঝকে নীল আকাশে ভেসে বেড়ানো সাদা মেঘের ভেলা অথবা কখনও কালো মেঘের মাঝ থেকে সূর্যের ঝিলিক আর শ্বেত শুভ্র কাশফুলের শোভা সবই যেন শরত ঘিরে। আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ। এভাবেই প্রতি বছর ফিরে আসে শরত, বাংলার প্রকৃতিকে করে তোলে রূপময়। শুধু নীলফামারীর তিস্তা অববাহিকায় নয়, উত্তরের সব নদী চরাঞ্চলগুলো ঢেকে গেছে কাশফুলে। নীল আকাশে সাদা মেঘের সঙ্গে নদীর ধারে থোকা থোকা শুভ্র কাশফুলের মেলবন্ধন মন কাড়ে প্রকৃতিপ্রেমীদের। দর্শনার্থীরা বলেন, সাদা মেঘের সঙ্গে এই কাশফুলের সাদা রং মনকেও সাদা করে দেয়। প্রকৃতির কাছ থেকে একটু প্রশান্তি। শরত আসে সৌন্দর্য নিয়ে আর সেই সৌন্দর্য কাশফুল ছাড়া পূর্ণতা পায় না। এখানকার কাশবনের এই পরিবেশ যে কারও মনকে উদ্বেলিত করে। শেষ বিকেলের আলো আর মৃদু হাওয়ায় দোল খাওয়া সাদা কাশফুল এই দুয়ের মেলবন্ধনে গোধূলির লাল সূর্য যখন অস্তাচলে তখন প্রকৃতি হয়ে ওঠে আরও মায়াবী। শরতের প্রকৃতির ছোঁয়া পেতে শুধু তরুণ প্রজন্মই নয়, পরিবারের মুরব্বিরাও এক কাতারে নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার পূর্বছাতনাই ইউনিয়নের তিস্তা নদীর ডান তীর প্রধান বাঁধ। এই বাঁধের সঙ্গে রয়েছে টি-বাঁধ। টি-বাঁধের ওপারে নদীর চর গ্রাম। বাংলাদেশের অংশ আর ভারতের অংশ মিলে এই চর। নদীর কারণে নেই তারকাঁটার বেড়া। ফলে অনায়াশে দুই বাংলার মানুষজন এখানে চলাচল করতে পারে। তবে এই চলাচল ভালমনের প্রকৃতির টানের। সেখানে নদীর কিনার দিয়ে বয়ে চলেছে নৌকা। অপরূপ এক দৃশ্য। সেখানেই পরিবার পরিজন নিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে প্রেম করতে আসছে অনেকেই। আরিফা সুলতানা লাভলী নীলফামারী শহরের এক সমাজসেবী নারী। তিনি বলেন, ‘আমি প্রতিবারই এখানে আসি। ভাল লাগে।’ পেছনে স্মৃতির সঙ্গে তিনি বলে উঠেন মন তুই কোথা থেকে এসেছিস, কোথায় যাচ্ছিস? তিস্তা নদীকে জিজ্ঞাসা কর। জেনে নাও শহর পেরোনো জঙ্গলের বাতাসের কাছে...। মন কেমন করে দেয়া সেই কাশবন। কাশবনে সূর্যোদয়ে রঙিন আলোয় কাশফুলের লাল হয়ে ওঠা। ছোটবেলায় সেই সকালে বন্ধুদের সঙ্গে কাশবনে যাওয়ার জন্য মাকে কত তোয়াজ! মার পায়ে পায়ে ঘোরা। মা যা বলছেন সঙ্গে সঙ্গে সে কাজ করা। একটু পড়াশোনাও করে নেয়া। তারপর মিলত চরে যাওয়ার অনুমতি। ওই সকল দিনের স্মৃতি মনের মণিকোঠায় থাকলেও সেই দৃশ্যপটের সেলফি নেই। এখন গোছা গোছা কাশফুল হাতে নিয়ে সেলফোনে ছবি তুলে সেল্ফি তুলে ফেসবুকের পাতা ভরে দিতে পারি। তার হাতেই একগুচ্ছ কাশফুল। তিনি বলেন, ‘এখানে এসে কাশফুল নিয়ে ফেরার আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। তিনি আরও জানালেন শুধু আমি নই। দেখবে শরত জুড়ে অনেকেই আপলোড করে যাবে মাঠঘাটে কাশফুলের ছবি, শরত আকাশের থোকা থোকা পুঞ্জীভূত মেঘের ছবি। এদিকে অনেকে বলেন ঋতুচক্রে স্বপ্ন ও শুভ্রতার প্রতীক হয়ে শরত আসে, জেগে উঠে গোটা প্রকৃতি। বর্ষার অঝোরধারার পর শরতের সতেজ মাটিতে গাছপালা খুঁজে পায় ঝলমলে রোদ। পথের দূর্বাঘাসে শিশিরের আলপনা জাগে। আমাদের ডেকে যায় শরতের শান্ত প্রকৃতি গাঢ় নীল আকাশ ও শুভ্র প্রাণের কাশফুল। চারদিকে কাশবনের শোভা আর হেলিয়া-দুলিয়া নৃত্য দেখে চোখ-মুখে সুখের পরশ বুলিয়ে দেয়। আসলে এমন শরত, সাদা পালকের মতো কাশফুলের সমারোহ, সোনারঙা রোদ্দুর আর পেঁজো তুলোর মতো হালকা হাওয়ায় ভাসা মেঘের চোখ জুড়ানো সম্মিলন দেখে যে কারও চোখ জুড়িয়ে যেতে বাধ্য। এখন দূরত্বের আকাশে মেঘের দল ভেঙে গিয়ে উঁকি দিচ্ছে নীলের উজ্জ্বলতা। মেঘের নরম নীল আকাশ আবার এসেছে ফিরে বাংলার রূপে। নদীতীরে বাতাসে ঢেউখেলা সেই কাশের সারি, কাশফুল ছুঁয়ে দুরন্ত শিশুর মায়াবী হাসি, কাশবনে বাবুই, মুনিয়া পাখিদের ওড়াউড়ি দুই চোখ ভরে দেখে নিচ্ছে মানুষ। কাশ বাংলাদেশের জনপ্রিয় ফুলের মধ্যে একটি। একটি ঘাস তার ফুল দিয়ে আমাদের মন জয় করে নিয়েছে। আমাদের শিখিয়েছে কোমলতা ও সরলতা। পৃথিবীতে কোন ঘাসজাতীয় উদ্ভিদের ফুলের এত কদর এবং মানুষের জয় করে নেয়ার এই আবেদন আছে কি না, জানা নেই। বাংলা সাহিত্যে এ ফুলের উপস্থিতিও ব্যাপক। কাশফুল পালকের মতো নরম। বাংলাদেশে নদীর তীর, বিল, অবারিত মাঠ, চরাঞ্চল, পাহাড়, উঁচু জমি শরতকালে কাশফুল ফোটতে দেখা যায়। শুধু গ্রামাঞ্চনে নয় ঢাকার আশপাশে রয়েছে অনেক কাশবন। শরতের উদ্ভিদরাজ্যে নীলের নীলিমা কম, শুভ্রতাই বেশি। তবে সে অভাব ঘুচিয়ে দেয় নীলাকাশ। আমাদের দেশে সাধারণত তিন প্রজাতির কাশ রয়েছে। সমতলে এক প্রজাতি এবং পাহাড়ে দুই প্রজাতি। তবে সবার কাছে সমতলের প্রজাতিটি প্রিয় এবং সহজে দর্শনযোগ্য। বাংলাদেশের নোনাজলের নদীমোহনা বাদে প্রায় সব নদীর চরে, প্রাকৃতিক জলাশয়ের ধারে কাশ জন্মে। শরতের মাঝেই সনাতন ধর্মের ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজার আমেজ।
×