ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ সাহাবুদ্দিন চুপ্পু

বঙ্গবন্ধুকে আমি যেমন দেখেছি

প্রকাশিত: ০৯:৩৬, ২৭ আগস্ট ২০১৯

 বঙ্গবন্ধুকে আমি যেমন দেখেছি

(শেষাংশ) কমিটি গঠনের পর জেলা বাকশালের সম্পাদক ও ৫ যুগ্ম-সম্পাদক মিলে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যাই। তিনি তখন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে রোডস্থ বাসায়। জাতির পিতার স্বভাব ড্রেসকোড ‘হাফ-শাটর্’ ও ‘লুঙ্গি’ পরেছিলেন। এটা ছিল বঙ্গবন্ধুকে আমার শেষ দেখা। এই সাক্ষাতের দু’মাস পরেই যে তিনি চলে যাবেন, কে জানত সেটা? যাই হোক, ভবনে ঢুকে বঙ্গবন্ধুকে সালাম দিলাম। বাকশাল কমিটিতে স্থান দেয়ায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম। তিনি আমাদের নানা দিক-নির্দেশনা দিলেন। চলে আসব, ঠিক এই মুহূর্তে ডাকলেন বঙ্গবন্ধু। বললেন- ‘কীরে, আমার সাথে তো ছবি না তুলে কেউ যায় না; তোরা কেন যাস’। তাৎক্ষণিক ক্যামেরাম্যান ডাকলেন। ফটোবন্দী হলাম রাজনীতির কবি’র সাথে। বঙ্গবন্ধুর হাত থেকে নেয়া সেই ছবি আজও আমি আগলে রাখছি। তার কাছ থেকে পাওয়া সর্বশেষ স্মৃতিচিহ্ন যে এটাই! ১৫ আগস্ট মুশতাক চক্রের বুলেটে বঙ্গবন্ধু পরিবার শহীদ হলে আমি ও পাবনা আওয়ামী লীগ নেতা রফিকুল ইসলাম বকুলের নেতৃত্বে প্রতিরোধ গড়ে তুলি। বিশাল এক মিছিল নিয়ে জেলা শহর প্রদক্ষিণ করি। আমি, বেবি ইসলাম, রফিকুল ইসলাম বকুল, ফজলুল হক মন্টু, আবুল কালাম আযাদ, রেজাউল রহিম লালের নেতৃত্বে অস্ত্র সংগ্রহ করে জোরালো প্রতিরোধ গড়ে তুলি। সকাল ৮টা-সাড়ে ৮টার দিকে পাবনার জেলার তৎকালীন পুলিশ সুপার পি বি মিত্র আমাদেরকে কোন এ্যাকশনে যেতে বারণ করলেন। তিনি জানালেন, তিন বাহিনীসহ বিডিআর প্রধান ও রক্ষী বাহিনী ইতোমধ্যে মুশতাক সরকারের আনুগত্য প্রকাশ করেছে। তোমাদের উচিত- আত্মগোপনে চলে যাওয়া। বিষয়টি অনুধাবন করলাম। শহর ছেড়েছিলামও, কিন্তু ২০ আগস্ট খুনী মুশতাকের তৎসময়ের অনুগত বিপথগামী কিছু সেনা ও পুলিশ সদস্যের হাতে গ্রেফতার হই। সামরিক আইনের ৭ ধারায় (সন্দেহভাজন) হিসেবে ডিএসপি মো. শামসুদ্দিন আমাকে গ্রেফতার করে, গ্রেফতারকারী সেই কর্মকর্তা ছিলেন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মুক্তিযোদ্ধা ব্যাচ (১৯৭৩) থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত। গ্রেফতারের পর জেলখানায় নিয়ে যাওয়া হয় আমাকে। সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে কোনো এক গভীর রাতে জেলখানা থেকে চোখ বেঁধে বালুর ট্র্যাকে করে সেনা ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। শুরু হয় নতুন উদ্যোমে নির্যাতন। সেই নির্যাতনকারীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ডিএসপি কংশধর তরফদার। ছিলেন পাকিস্তান ফেরত সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল এ এল এম ফজলুর রহমানও। ফজলুর রহমান আমাকে একের পর এক বুটের লাথি মারতে থাকেন, আর বলতে থাকেন, ‘এই ব্যাটা তোর বঙ্গবল্টু কোথায়?’ এও বলা হয়- তোরা শেখ মুজিব হত্যার প্রতিবাদ করেছিলি, মিছিল করেছিলি? তোদের গুলি করে মারা হবে। ভেবেই নিয়েছিলাম, জীবন চলে যাবে। যে দেশে জাতির পিতা সপরিবারে নিহত হন, সে আমি আর এমন কী! কিন্তু পরক্ষণেই দেখলাম, আমাদের আবারও গাড়িতে ওঠানো হচ্ছে। পরে সেনা ক্যাম্পে ফিরিয়ে নিয়ে প্রায় অর্ধমৃত অবস্থায় পুনরায় কারাগারে প্রেরণ করা হয়। জেল থেকে বের হয়ে পরিবারের সকল সদস্যের আর্থিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থা থেকে আমিও দুর্বল হয়ে যাই। ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলি বর্ণাঢ্য এক রাজনৈতিক জীবন। কষ্ট হলো তখন, যখন দেখলাম বঙ্গবন্ধুকে গালি দিয়ে আমাকে নির্যাতন করা সেই ফজলুর রহমানই বিজিবি প্রধান (ফেব্রুয়ারি ২০০০-জুলাই ২০০১) হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন করা বাংলাদেশে বসে রাষ্ট্রীয় সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন তিনি। আগস্ট আসলেই দুঃসহ স্মৃতি ভেসে ওঠে মানসপটে। বারবার স্মৃতি খুঁজে ফিরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কাটানো সেই নাতিদীর্ঘ সময়গুলো। কিছুটা আশ^স্ত হই এই ভেবে যে, প্রিয় নেতা, ঘাতক জল্লাদরা আপনাকে হত্যা করেছে ঠিকই, কিন্তু বাঙালী জাতির হৃদয় আসন থেকে আপনাকে কি সরাতে পেরেছে? পারেনি। আপনি অমর-অক্ষয়-অবিনশ্বর। ছড়া-কবিতা-গান, শিল্প-কাব্য-সাহিত্য, চিন্তা-চেতনা-আদর্শ, পরিবার-সমাজ এমনকি রাষ্ট্র- বঙ্গবন্ধু, কোথায় নেই আপনি? নির্ভীক এ বিশ্বনেতসহ তাঁর পরিবার ও ১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এ নিহত সকল শহীদদের প্রতি রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা। লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক দুদক কমিশনার
×