ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ডেটলাইন দেয়ারা!

প্রকাশিত: ০৯:৩৫, ২৭ আগস্ট ২০১৯

ডেটলাইন দেয়ারা!

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ ॥ ১৯৭১ সালের ২৭ আগস্ট দিনটি ছিল শুক্রবার। সকালে ২নং সেক্টরে পাকবাহিনী নয়নপুরের পশ্চিম পাশে শশীদল গ্রামের নিকট সেনা সমাবেশ করে সেনেরবাজার মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের ওপর মর্টারের সাহায্যে আক্রমণ চালায়। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের আক্রমণকে প্রতিহত করে। এই সংঘর্ষে ১৫ জন পাকসেনা নিহত হয়। মুক্তিবাহিনী পরশুরাম থানার কাছে পাকসেনাদের একটি টহল দলকে এ্যামবুশ করে। দুই ঘণ্টা সংঘর্ষের পর পাকসেনারা মর্টারের সাহায্যে আক্রমণ চালিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। এই সংঘর্ষে ৭ জন পাকসেনা নিহত হয়। ঢাকায় মুক্তিবাহিনীর গেরিলা দল পাকসেনাদের ৪-৫টি বেডফোর্ড গাড়ি ও জীপকে গ্রীন রোডে এ্যামবুশ করে। মাইনের আঘাতে পাকবাহিনীর একটি গাড়ি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়। কয়েক ঘণ্টা সংঘর্ষের পর মৃতের সংখ্যা বাড়তে থাকলে পাকসেনারা ক্যান্টনমেন্টের দিকে পালিয়ে যায়। এ সংঘর্ষে ২৪ জন পাকসেনা নিহত ও ৪১ জন আহত হয় এবং তিনটি গাড়ি বিধ্বস্ত হয়। মুক্তিবাহিনীর দু’জন বীর যোদ্ধা আহত হন। কুমিল্লার শালদা নদী এরিয়া, যেখানে শত্রুর ওপর ক্রমাগত নজর রাখা হয়েছে এবং অতর্কিত আক্রমণ করা হয়েছে; সেখানে শত্রুপক্ষের অসংখ্য কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন অপারেশনে ৪৫ জন নিহত হয়। আল চৌবাশে ১৫ জন শত্রুসৈন্য নিহত এবং ২১ জন আহত হয়। মাধবপুরে ১টি শত্রু জীপ এবং একটি ৩ টন ট্রাক ধ্বংস করে দেয়া হয়। ফলে ৪ জন শত্রুসৈন্য মারা যায় এবং ৬ জন আহত হয়। মহেশপুর এবং দেউশে মুক্তিফৌজের একটি অতর্কিত হামলায় শত্রুপক্ষের ১১ জন নিহত ও ৯ জন আহত হয়। সিলেটের মনুর কাছাকাছি পাকসৈন্যদের ওপরে এ্যামবুশে ৫ জন হতাহত হয়। একই দিনে ৩ মাইল উত্তরে তামার্জুনিতে রাজাকারদের টহল দলে অভিযানে ৬ জন হতাহত হয়। তাদের কাছ থেকে ২টি রাইফেল উদ্ধার করা হয়। কানাইরঘাটে পাক প্যাট্রোলে অতর্কিত আক্রমণে ৩ পাকসেনা আহত হয়। একই এলাকায় নৌকায় চলন্ত পাকবাহিনীর ওপরে অতর্কিত আক্রমণে ২ জন নিহত ১ জন আহত হয়। জকিগঞ্জ-আতাগ্রাম রাস্তায় একটি পাক জীপ মাইন দিয়ে আক্রমণ করা হয়। এতে ২ পাকসৈন্য নিহত হয় এবং ৩ জন আহত হয়। তাদের গাড়ির প্রচুর ক্ষতি হয়। শমসেরনগরের কাছাকাছি টেলিফোন লাইন ধ্বংস করে এই এলাকায় টেলি যোগাযোগ ব্যাহত করা হয়। নোয়াখালীর ফেনী-বিলোনিয়া এলাকায় পাক বাহিনীর রসদ বহনকারী ১৫টি পাক বেসামরিক যানবাহনে মুক্তিবাহিনী অতর্কিত আক্রমণ করে এবং প্রায় সব যানবাহন ভাংচুর করে। হাসানপুরের কাছাকাছি একটি সড়ক সেতু ধ্বংস এবং ক্ষতিগ্রস্ত করে ফেনী-বিলোনিয়ার মধ্যে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে। কুমিল্লা জেলার মন্দভাগে পাক বাহিনীর ওপর অভিযান চালিয়ে মুক্তিবাহিনী ৫ জনকে হতাহত করে। এই দিনে তারা বিবির বাজার অভিযান চালিয়ে ২ পাকসৈন্য হত্যা করে। দিনাজপুর জেলার হালিবান্দায় মুক্তিবাহিনী অভিযান চালিয়ে ২ জনকে আহত হয়। উত্তরবঙ্গের নকুরগাছিতে মুক্তিবাহিনী আক্রমণ করে রেলওয়ে ট্র্যাক ধ্বংস করে। দারপুলে ৩ জন পাকসৈন্যকে আহত করা হয়। কুষ্টিয়া জেলায় পটলডাঙ্গায় মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে পিস কমিটির চেয়ারম্যান নিহত হয়। সারাদেশের ন্যায় দালাল- রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে ফিরছিল। মাত্রই ভোরের সূর্য ফুটতে শুরু করেছে। এমন সময় খুলনা জেলার দেয়ারা গ্রামে রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা পাকিস্তানী সেনাদের নিয়ে হামলা করে। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগী রাজাকাররা খালিশপুরের পিপলস জুট মিলের খেয়াঘাট পার হয়ে এপারে আসে। এরপর সেনহাটি গ্রাম হয়ে তারা দেয়ারা এসে পৌঁছায়। ভোর রাতেই কয়েকশ রাজাকার, বিহারি ও পাকিস্তানী সেনা সদস্যরা গোটা দেয়ারা গ্রামটি ঘিরে ফেলে। তারা মুক্তিযোদ্ধা আবদারকে খুঁজতে থাকে। কিন্তু কোথাও মুক্তিযোদ্ধা আবদারকে খুঁজে না পেয়ে ক্ষুব্ধ ও হতাশ হানাদার বাহিনী প্রতিশোধের নেশায় উন্মত্ত হয়ে মুক্তিযোদ্ধা আবদারের পিতা ডা. মতিয়ার রহমানসহ বাড়ি থেকে ছয় জনকে ধরে ফেলে। রাস্তায় এনে তাদের পিঠমোড়া দিয়ে বেঁধে সেখানেই তাদের কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে। হানাদাররা সবাইকে ধরে এক জায়গায় জড়ো করে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করতে শুরু করে। আক্রমণের মুখে কেউ কেউ পালাতে সক্ষম হলেও ঐদিন পাকিস্তানী হায়েনাদের হাতে মোট ৬১ জন যুবক-বয়স্ক মানুষ ধরা পড়ে। মাটিতে ফেলে হানাদার বিহারী রাজাকাররা ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করে কুপিয়ে কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। ৬১ জনের মধ্যে ৬০ জন ঘটনাস্থলেই শাহাদাতবরণ করেন। এদের মধ্যে ৩৮ জন শহীদের লাশ ভৈরব নদীতে ছুড়ে ফেলে। বাকি ২২ জনকে তিনটি গণকবরে মাটিচাপা দেয়। বাকি একজন সারা শরীরে ধারালো অস্ত্রের ১৯টি আঘাত সয়েও বেঁচে যান। শরীরে হায়েনাদের ১৯টি আঘাত নিয়ে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিটি হলেন স্থানীয় সৈয়দ আবুল বাশার (৮৪)। ঐদিনের ঘটনার বীভৎসতা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন-“বিহারি রাজাকারগুলো ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করে মানুষকে কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছে। পাকিস্তানী সেনারা গুলি করেছে, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মানুষ মেরেছে। খুনিদের কি উল্লাস, তা চোখে না দেখলে বিশ^াস করা যায় না। বাংলাদেশ সরকারের মুখপাত্র মিজানুর রহমান চৌধুরী মুজিবনগরে এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক মোতায়েন না করার জন্য জাতিসংঘ মহাসচিব উ’ থান্টের প্রতি আহ্বান জানান। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার বিশেষ সহকারী ডাঃ এএম মালিক ইসলামাবাদে বলেন, ইয়াহিয়া খান দেশে একটি বেসামরিক সরকার গঠনে আগ্রহী। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নিয়মিত কথিকামালা বিশ্বজনমত অনুষ্ঠানে বলা হয়েছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাণরক্ষার জন্য অবিলম্বে সক্রিয় ও কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বিশ্বের সকল সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। ... লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকা জানিয়েছে যে, গেরিলাদের অপ্রতিরোধ্য তৎপরতার কারণে নির্বাচনে দাঁড়াবার মতো লোক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলেই ইয়াহিয়া খান উপনির্বাচন স্থগিত রাখতে বাধ্য হচ্ছে। গত ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচন ছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরবর্তী তেইশ বছরের প্রথম নির্বাচন। এই নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষ ভোট দিয়েছে শোষক-ষড়যন্ত্রকারী শাসকের কব্জা থেকে নিজেদের ভাগ্য ছিনিয়ে আনবার দুর্বার আকাক্সক্ষায় এবং বিজয়ী করেছে তাদের প্রিয় নেতা শেখ মুজিব ও তার দল আওয়ামী লীগকে। ... ‘হংকং স্ট্যান্ডার্ড’ পত্রিকার এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয় : সামরিক আদালতে শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারের নামে পাকিস্তানী সামরিক জান্তা যা করতে যাচ্ছে তা একটা প্রহসন ছাড়া আর কিছুই নয়। আইরিশ আইনজীবী সমিতির অত্যন্ত প্রভাবশালী সদস্য ও রাজনৈতিক বন্দী মার্জনা সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সংস্থার চেয়ারম্যান সিয়ান ম্যাকব্রাইড এক চিঠিতে জেনারেল ইয়াহিয়াকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার বেসামরিক আদালতে করার জন্য আবেদন জানিয়েছেন। দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এপিপি পরিবেশিত খবরে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তান সরকার প্রদেশে রাজাকার নামে একটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠনের উদ্দেশ্যে একটি অর্ডিন্যান্স জারি করেছেন। নতুন অর্ডিন্যান্স পূর্ব পাকিস্তান রাজাকারস অর্ডিন্যান্স-১৯৭১ নামে পরিচিত। প্রাদেশিক সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী রাজাকারগণ কর্তব্য সম্পাদন করবেন। জয়বাংলা ১ম বর্ষ : ১৬শ’ সংখ্যায় বলা হয়েছে, সভ্য জগত থেকে বিচ্ছিন্ন বেলুচিস্তানের কাকুনে বাংলাদেশে হত্যার জন্য বিশেষ জল্লাদ বাহিনী ট্রেনিং লাভ করেছে। এক ডজন আমেরিকান বিশেষজ্ঞ ইয়াহিয়ার স্পেশাল ফোর্স তৈরির কাজে ট্রেনিং দিচ্ছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মুক্তিকামী ভিয়েতনামী নাগরিকদের বেছে বেছে হত্যা ও ধ্বংসের উদ্দেশ্যে যেমন করে গুপ্ত ট্রেনিংপ্রাপ্ত একটি বাহিনী প্রেরণ করেছিল। যার নাম সরকারীভাবে ‘গ্রিন ব্যারেট’। ইয়াহিয়া সরকারও ঠিক তেমনি করে গোপন ট্রেনিং দিয়ে একটি বিশেষ হত্যাকারী বাহিনী গড়ে তুলেছে। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×