ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৯:২৯, ২৭ আগস্ট ২০১৯

ঢাকার দিনরাত

রোদ্দুর ভীষণ তীব্র, কবির ভাষায় বললে, প্রখর তপন তাপ। ভাদ্র মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ চলছে। পঞ্জিকা অনুযায়ী শরতকাল। যদিও ঢাকায় ভাদ্রের অসহনীয় গরমে প্রাণ ওষ্ঠাগত। কোন কোন দিন থাকছে বৃষ্টিবিহীন। প্রকৃতি প্রেমিকদের কাছে শরত ঋতুর বিশেষ কদর রয়েছে। ভ্যাপসা গরমকে হাওয়ার ঝাঁপটায় আলতু সরিয়ে শরত এনে দেয় একরাশ স্বস্তি। আকাশে ভাসে মেঘের ভেলা। ভোরে ঘাসের ডগায় শিশিরের চুম্বন রোমান্টিক মনকে যুগপৎ প্রাণবন্ত ও উদাসীন করে। প্রসঙ্গত পুরনো কথাগুলো পুনরায় বলতে ইচ্ছে করছে। সৈয়দ মুজতবা আলীর নায়ক কান্দাহারে গিয়ে কাবুলদুহিতা শবনমের প্রেমে পড়ে শরতের স্মৃতি তুলে এনেছিল। শবনম মানে শিশিরবিন্দু, হিমকণা। পরিচয়ের শুরুতেই নায়ক মজনুন শবনমকে শিশিরের সঙ্গে শিউলির সম্পর্ক তুলে ধরে কবিতা আউড়েছিল। সেই কবিতা মন হরণ করে শবনমের, সে নিজের নাম ‘শিউলি শবনম’ হলে কেমন হয় জানতে চেয়েছিল প্রেমাষ্পদের কাছে। একটি মাত্র রজনীই তো শিউলি ফুলের নিয়তি। পরদিন ভোরবেলা গাছকে বিচ্ছেদ বেদনা দিয়ে শিউলির ঝরেপড়া। শবনম-মজনুনের বাসর রাতের পরদিনই শুরু হয় তাদের চির বিচ্ছেদকাল। সাহিত্যরসসিক্ত দারুণ এক আখ্যান। না, চলতি বছরেও সত্যিকারের শরত আসতে কিছুটা সময় নেবে বলেই মনে হচ্ছে। মানুষের পাশে মানুষ ১৬ আগস্ট মিরপুরের রূপনগর ঝিলপাড় বস্তির ভয়াবহ আগুনে সবারই পুড়েছে ঘর। হারিয়েছেন সর্বস্ব। আমরা হৃদয়বান মানুষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছি কোনো না কোনোভাবে মাথা গোঁজার ঠাঁইহীন, কপর্দকশূন্য এইসব অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে। বস্তিতে নানা পেশার মানুষের ভেতর একজন রিক্সামিস্ত্রির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। রিক্সামিস্ত্রি রফিকুল ইসলাম প্রতিবেশীদের ঘর রক্ষায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের সহযোগিতা করতে উঠে যান একটি দ্বিতল ভবনে। অচমকা পা ফসকে পড়ে যান নিচে। এতে তাঁর ডান পা ভেঙে যায়। চিড় ধরে মেরদণ্ডের তিনটি হাড়ে। যখন তিনি চলনশক্তিহীন, তখন তাঁর পাশে এসে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলেন একেবারেই অচেনা-অজানা একজন। রফিকুল পেলেন ঘুরে দাঁড়ানোর সম্বল। আগুনে সব হারানো রফিকুল ইসলামকে নিয়ে বুধবার একটি সংবাদপত্রে ‘একজন রফিকুল ও ঝিলপাড় বস্তির অসহায় শিশুরা’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটি পড়ে নাম-পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যাংক কর্মকর্তা অসহায় রফিকুলের পাশে দাঁড়ানোর আগ্রহ প্রকাশ করেন। আবারও প্রমাণিত হলো মানুষ মানুষের জন্যে। ঢাকায় এমন মানবতাবাদী মানুষের অভাব কোনকালেই ছিল না। এখন অবশ্য বেশির ভাগই আত্মকেন্দ্রিক মানুষ, তাদের হৃদয় যেন পাথরে গড়া! ব্যাংক কর্মকর্তাটি ওই সংবাদপত্রের প্রতিবেদককে বলেন, ‘রফিকুল ইসলামের সংবাদটা পড়ার পর রাতে ঘুমাতে পারিনি। বার বার তাঁর কথা, তাঁর ছোট ছোট তিনটি মেয়ের কথা মনে পড়ছিল। আমারও তাঁর মতো দুটো মেয়ে আছে। আর রফিকুল নিজের কথা না ভেবে অন্যের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়লেন। একে কী বলবেন! চরম ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার এই যুগে রিক্সাশ্রমিক রফিকুলের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। শুধু নিজেরটা নিয়ে ব্যস্ত না থাকা, সুখে-দুঃখে মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মতো মহান মানবিকতার শাশ্বত মূল্যবোধ তিনি ধারণ করেন। এই মানুষটির পাশে দাঁড়াতে পেরে আমি আত্মিকভাবে স্বস্তি পাচ্ছি।’ আরেকটি কথা, বঙ্গবন্ধু বিদ্যানিকেতনে আশ্রয় নেয়া বস্তির শিশুদের হাতে একটা কোম্পানি থেকে চকোলেট দুধ দেয়া হয়েছে। এমন মানবিক উদ্যোগ আরো দেখতে চাই। মানুষের পাশে মানুষ দাঁড়াবে, এটিই তো স্বাভাবিক। ভবনে মশার লার্ভা, গুনতে হচ্ছে জরিমানা ডেঙ্গু নিয়ে মানুষের দুর্ভাবনার অবসান হয়নি। সামনের সেপ্টেম্বর মাসও সতর্ক থাকতে হবে। মশা মারার অভিযান নিয়মিত চালাতে হবে। এদিকে এডিস মশার লার্ভা পাওয়ায় ধানমন্ডির সাতটি ভবনকে ৭৭ হাজার টাকা জরিমানা করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) ভ্রাম্যমাণ আদালত। ডিএসসিসির অঞ্চল-১ এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী হাকিম শনিবার দুপুরে এই আদালত পরিচালনা করেন। ধানমন্ডি ১২/এ সড়ক ‘নগর হোমস’ নামের রিয়েল এস্টেট কোম্পানির নির্মাণাধীন একটি ভবনে এডিস মশার লার্ভা পায় ডিএসসিসির অঞ্চল-১ এর কর্মকর্তারা। এ সময় এই প্রতিষ্ঠানকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। একই সড়কের ৫৩ নম্বর হোল্ডিংয়ে অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ ও মশার প্রজননের উপাদান থাকায় ১০ হাজার টাকা জরিমানা করে একই আদালত। এছাড়া একই অপরাধে ধানমন্ডির বিভিন্ন সড়কের আরও পাঁচটি বাড়িকে ১৭ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। ডেঙ্গুর রেকর্ড-ভাঙ্গা বিস্তারে এডিস মশাকে নির্বংশ করার সব রকমের বৈধ ও সক্রিয় পদক্ষেপ ঢাকাবাসীর সমর্থন পাবে বলে আমরা আশা করলেও যখন নিজের ঘাড়ে এসে দায় পড়ে তখন কিছুটা ভিন্ন চিত্র পাওয়া স্বাভাবিক। মশা মারায় ব্যর্থতা রয়েছে দুই সিটি কর্পোরেশনেরই। এ জন্য তারা কি কোনো জরিমানা বা জবাবদিহিতার মধ্যে পড়েছে? নাগরিকরা বলতেই পারেন, ভবনের ভেতরে যদি এডিস মশার প্রজননস্থল মেলে সেটি ভবনবাসীর দোষ। ভবনের বাসিন্দারা হয় সচেতন নয়, কিংবা তারা অলস। মশা মারার ব্যাপারে তাদের সক্রিয়তা নেই। সেক্ষেত্রে তাদের সতর্ক ও সচেতন করার জন্য প্রতীকী জরিমানা হতেই পারে। তবে আরও প্রশ্ন থেকে যায়। এখন পর্যন্ত জরিমানা করা ভবনের তালিকায় নেই সরকারী ভবনগুলোর একটিও। অথচ গণমাধ্যমেই খবর এসেছে, সরকারী ভবনগুলো এবং স্থাপনাগুলোতেই সবচেয়ে বেশি এডিস লার্ভা পাওয়া গেছে। সেসব ক্ষেত্রে সরকারী ভবন এবং স্থাপনাগুলোকে বড় অঙ্কের জরিমানা করতে হবে, এবং সেই জরিমানা আদায় করে সিটি কর্পোরেশনকে উদাহরণ তৈরি করতে হবে। তাই নয় কি? বৈষম্য থাকা ঠিক নয়। রসনা বিলাস সেদিন ধানমন্ডির নান্দোজে আমরা কয়েকজন বন্ধু বসেছিলাম। আড্ডার একজন মহিলা সদস্য বাসায় তার স্বামীকে এই রেস্তরাঁর নাম বলায় ভদ্রলোক মুচকি হেসেছিলেন। হাসির কারণ হলো ওখানে তো সব নবীন তরুণদের রমরমা আড্ডা। আমাদের মতো পঞ্চাশ পেরুনোরা কেন যাবে ওখানে? মন্দ বলেননি ভদ্রলোক। তবে তরুণদের যে হটিয়ে দিচ্ছেন হবু বুড়ো এবং বর্তমানের বুড়োরা, দখল করে নিচ্ছেন সব টেবিল, সেটি যদি তিনি জানতেন। যা হোক, দিনে দিনে সবকিছুর সঙ্গে খাবার সংস্কৃতিতেও পরিবর্তন আসছে। দেশীয় বা কন্টিনেন্টাল খাবারের পাশাপাশি আমরা বিদেশী রকমারি খাবারে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি। আর বিদেশী সেই সব মুখরোচক খাবারও বর্তমানে সহজলভ্য হয়ে এসেছে। ঢাকাসহ বড় বড় শহরগুলোতে বসেই যে কোন দেশের খাবারের স্বাদ নিতে পারছেন রসনা বিলাসী ভোজন রসিকরা। বিশেষ করে ঢাকায় এখন বিশ্বের এমন কোন দেশের উপাদেয় খাবার নেই যা পাওয়া যায় না। মৌলিক স্বাদ ও আভিজাত্য না থাকলেও খাবার প্রস্তুতিতে মসলা ও উপাদান ঠিক রাখা হচ্ছে বলে দাবি করছেন রেস্তরাঁর মালিকরা। ‘ইটিং আউট’ যেন ব্যস্ত নাগরিকের অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক সময় ঢাকার রেস্তরাঁয় বিদেশি খাবার বলতে ছিল চাইনিজ, থাই আর ভারতীয়। এখন দেশের মাটিতে বসেই বিশ্বের নানা অঞ্চলের খাবারের স্বাদ নেয়া যাচ্ছে। মেক্সিকান, ইটালিয়ান, টার্কিশ, এ্যারাবিয়ান, ভিয়েতনামী, চাইনিজ, জাপানীজ, থাই, কোরিয়ান, আমেরিকান, ইউরোপীয়, ব্রাজিলিয়ান, আফগানী, ইন্দোনেশিয়ান, স্প্যানিশসহ প্রায় সব দেশের রসনা বিলাসী খাবারের রেস্তরাঁ রয়েছে ঢাকাতে। উত্তরার যে এলাকায় আমি থাকি বিগত এক দশকে সেখানে কমপক্ষে দশটি অভিজাত খাবারঘর গড়ে উঠেছে। অথচ পুরো রাস্তায় এক সময়ে একটিও ভাতের হোটেল পর্যন্ত ছিল না। মোটামুটি মানের একটি রেস্টুরেন্ট স্থাপন করা হলেও ভোজনপ্রিয় লোকের অভাবে কয়েক মাসের মধ্যেই সেটি বন্ধ করে দিতে হয়েছিল। অবাক লাগে আজ সেখানে দুই শ’ গজ পরপর একেকটি রেস্তরাঁ। ধানমন্ডি, বনানী, গুলশান, খিলগাঁও, বেইলি রোডসহ কয়েকটি এলাকায় রেস্তরাঁ স্ট্রিট ও রেস্তরাঁ পাড়া রয়েছে। জনবহুল ঢাকার ইট-পাথরের দেয়ালে আবদ্ধ তরুণ-তরুণী এবং আড্ডাবাজ মানুষের মিলনকেন্দ্র এখন রেস্তরাঁগুলো। ঢাকায় হাত বাড়ালেই পাওয়া যাচ্ছে জাপানী সুশি, ভারতের মুসাকা, দোসা, চীনের পিকিং ডাক, সাউথ আমেরিকান বারবিকিউ রিবস, নিউজিল্যান্ডের পাভলোভা, মালয়েশিয়ান নারিকেল দুধ, সামুদ্রিক মাছ বা গুল্ম, শিমের বিচি, শসা ও মসলার তৈরি লাকসা, জাপানীজ টেপানিয়াকি, থাইল্যান্ডের সমতাম, পর্তুগীজ চিকেন, কোরিয়ান উইংস, চিকেন গার্লিক পিপার, সিপ্রং রোল, লেবানিজ কাবাব, বিরিয়ানি, রুটি, পেশোয়ারি নানরুটি, মাটন রিবস, মাটন লেগস, কান্দাহারি নান, আরও কত কি। বঙ্গবন্ধু স্মরণে শোকের মাস আগস্ট শেষ হয়ে এলো। মাসটির শেষ পর্যায়েও নতুন নতুন আয়োজনের কথা জানা যাচ্ছে। রোববার নজরুল ইনিস্টিটিউটে ছিল কবিকণ্ঠে বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত কবিতা পাঠ। জাতীয় কবির নামসম্বলিত ওই সংস্থার বর্তমান পরিচালক একজন কবি। উপপরিচালকও কবি। কিন্তু এখানে আগে কোনো কবিসমাবেশ ঘটেছে বলে মনে করতে পারছি না। যাহোক, এজন্যেই বোধহয় কর্তৃপক্ষ কবিতা পড়তে আশিজনমতো কবিকে আমন্ত্রণ জানান। শতকরা পঞ্চাশ ভাগ হয়তো উপস্থিত হয়েছিলেন। তাও বা কম কী! সব বয়সী কবিদের মিলনমেলাই হয়ে গেল বলা চলে। তবে মাঝে পরিচালক খানিকটা আক্ষেপ নিয়েই বললেন, তাড়ার কারণে অনেক কবিই কবিতা পড়ে চলে যাচ্ছেন। অন্ততো এক ঘণ্টা সময় তো প্রত্যেক কবির কাছে আমরা প্রত্যাশা করতে পারি? মন্দ বলেননি পরিচালক। তাছাড়া কেউ কবিতা পড়লে সেটি ভালো না লাগলেও নীরবতা পালনই ভদ্রতা। বেশ কয়েকজন কবি সারাক্ষণই পাশের জনের সঙ্গে গল্প করে চলেছিলেন। একজন সিনিয়র কবি পাঠের আগে বিষয়টি নিয়ে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করলেও গল্পবাজ কবিদের কানে সেসব পশলোই না। তারপরও বলা চলে কবিতাপাঠের ভেতর দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করার বিষয়টি ছিল বহুমুখী ও নান্দনিক। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র আয়োজন করেছে ‘বঙ্গবন্ধু বিষয়ক পুস্তক প্রদর্শনী ও পাঠ’ কার্যক্রম। এ আয়োজনে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রকাশিত বই প্রদর্শন করা হচ্ছে। পাশাপাশি টানা পাঁচ দিন ধরে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের স্বনামখ্যাত পাঁচটি বিদ্যালয়ের ৫০ জন শিক্ষার্থী বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পাঠ ও প্রতিক্রিয়া তুলে ধরবে তাদের শিক্ষক, অভিভাবক, সহপাঠী অতিথি ও বিচারকমণ্ডলীর সম্মুখে। রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমিতে রোববার এটির সূচনা হয়, শেষ হবে বৃহস্পতিবার। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের এ আয়োজনে সহযোগিতা করছে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি এবং বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি। ২৫ আগস্ট ২০১৯ [email protected]
×