ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

চক্রের নিয়ন্ত্রণে বস্তি

প্রকাশিত: ০৯:২৭, ২৭ আগস্ট ২০১৯

 চক্রের নিয়ন্ত্রণে বস্তি

উন্নয়নের ক্রমবর্ধমান অগ্রযাত্রায় শিল্প নগরী গড়ে তোলা এক অপরিহার্য শর্ত। আধুনিক যন্ত্র সভ্যতার বিকাশ, উন্নত অবকাঠামো সঙ্গে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় এর প্রত্যক্ষ প্রভাবও এক অনিবার্য বাস্তব। শিল্প-কারখানার চারপাশে শ্রমিক বসতি, শহরের আনাচে-কানাচে রিক্সাসহ অটোগাড়ি, বেবিট্যাক্সির চালকদের নিমিত্তে গড়ে ওঠা ঘনবসতিপূর্ণ নিম্নবিত্তের শ্রমজীবী মানুষদের আবাসন হিসেবে ‘বস্তি’ নামক এক অতি পরিচিত বাসস্থানের অভ্যুদয়। ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এসব বস্তিবাসীর সংখ্যা ৫ লাখেরও বেশি। অনুমান করা হয় এই সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ। শুধু ঢাকাতেই নাকি ৫ লাখ বস্তিবাসী তাদের প্রতিদিনের জীবন প্রবাহে নিজেদের মানিয়ে নেয়। তবে নিম্নমানের এসব আবাসন এলাকা মূলত বস্তিবাসীদের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। এক শক্তশালী প্রভাবশালী চক্র সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বস্তিগুলোতে কর্র্তৃত্বই শুধু বজায় রাখে না, অর্থবিত্তের সমৃদ্ধ বলয়টিকেও নানামাত্রিকে করায়ত্ত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত থাকে। শুধু তাই নয়, বিদেশের অর্থায়নে যেসব এনজিও দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্য নিয়ে নানা প্রকল্প পরিকল্পনা করে ঠিকই; কিন্তু যাদের কারণে এই পুঁজি বিনিয়োগ তার ছিটেফোঁটা ভাগও পায় না বলে বস্তিবাসীরা। অস্বাস্থ্যকর, দূষিত পরিবেশই শুধু নয়, আর্থিক অসঙ্গতির হরেক রকম টানাপোড়েনে বস্তিবাসীর নাভিশ্বাস উঠলেও হর্তা-কর্তা, গডফাদারদের পকেট ভারি হতে সময় লাগে না। দীনহীন, খেটে খাওয়া এই হতভাগ্যদের জীবনমানের উন্নতির কোন সম্ভাবনা সেভাবে দৃশ্যমানও হয় না। হতদরিদ্র মানুষদের দুঃখ-দুর্দশাকে পুঁজি করে যে বিদেশী সাহায্য-সহযোগিতা আসে যাদের মাধ্যমে, তারা নিজেরাই মূল ভাগটুকু আত্মসাত করে নিতে এতটুকু ভাবে না। বিত্তশালী ও প্রভাবশালীরা শুধু এনজিও কর্মকর্তাই নন, স্থানীয় প্রশাসন, কাউন্সিলর, সংসদ সদস্য এবং রাজনৈতিক কর্তৃত্বও পুরো ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বর্তমান সরকার বস্তি উন্নয়নের মহাপরিকল্পনায় আধুনিক বাংলাদেশ গড়তে যেসব প্রকল্প হাতে নিচ্ছে তার মধ্যে বস্তি উচ্ছেদের মধ্য দিয়ে বহুতল ভবন নির্মাণ করে দেয়াও এক আবশ্যিক পর্যায়। কিন্তু সেখানেও সরকারী কর্মকান্ড নানামাত্রিকে বাধাগ্রস্ত হয় শুধু বস্তিবাসীদের পক্ষেই নয়, পুরো সিন্ডিকেট ব্যবস্থার হরেক রকম প্রতিবন্ধকতায়ও। এমন অবস্থায় আরও হৃদয়বিদারক ঘটনা হিসেবে যুক্ত হয়েছে বস্তিতে আগুন লাগার ব্যাপারটি। যেখানে সহায় সম্বল হারিয়ে অনেকের বারবার সর্বস্বান্ত হতেও সময় লাগছে না। ঈদের পর পরই রূপনগর বস্তিতে অগ্নিসংযোগে দুর্বিপাকে পড়া অনেকেই তাদের শেষ সম্বলটুকুও হারিয়ে ফেলেন। ভুক্তভোগী বস্তিবাসীর অভিযোগ-ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই এই সর্বনাশা অগ্নিকান্ড। তাদের মতে, তারা যে এখন নিজেরাই উন্নয়নের মূলধারায় এগিয়ে যাচ্ছে, সেটা প্রভাবশালীরা মানতে পারছে না। বিশেষ করে নারী ও শিশুরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পেয়ে সম্মানজনক পেশাতেও প্রবেশ করতে সক্ষম হচ্ছে। বর্তমান সরকার শিক্ষা ব্যবস্থাকে যে মাত্রায় সর্বজনীন করে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছে, তেমন সুফল বস্তিবাসী মানুষও পেয়ে যাচ্ছে। ফলে স্বাবলম্বী হওয়ার অদম্য প্রেরণায় নিজেরাই আজ স্বনির্ভর হিসেবে দাঁড়াতে চেষ্টা চালাচ্ছে। তারা তাদের লক্ষ্যে সফলতার নিদর্শনও খুঁজে পাচ্ছে। ফলে তাদের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিতে অগ্নিসংযোগের মতো ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। বস্তি এলাকায় পানি, বিদ্যুত, গ্যাস এবং ডিশ লাইনেরও কোন আইনসম্মত বৈধ সংযোগ নেই। অনিয়ম আর দুর্নীতিতে পূর্ণ এসব ব্যবস্থাপনায় নতুন করে এমন সব চক্রান্ত শুরু করা হচ্ছে, যাতে অসহায়, নিরীহ বস্তিবাসীরা কখনই আলোর মুখ দেখতে না পারে। এসব বেআইনী অব্যবস্থাপনায় সরকারী নজরদারি আরও সম্প্রসারিত করা অত্যন্ত জরুরী। সরকারের মহৎ ও বড় ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বার্থন্বেষী চক্র কেন বাধা ও প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে তাও খতিয়ে দেখা একান্ত আবশ্যক। পূর্ণাঙ্গ জরিপের মাধ্যমে সব ধরনের প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করতে না পারলে, সমস্যা আরও মারাত্মক হয়ে উঠবে যা নিরাপদ এবং আধুনিক বাংলাদেশ গড়তে প্রতিবন্ধক হতে পারে।
×