ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সারতাজ আলীম

জীবন বাঁচাতে ‘জীবন’

প্রকাশিত: ০৭:৩০, ২৭ আগস্ট ২০১৯

 জীবন বাঁচাতে ‘জীবন’

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপার লীলাভূমি পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি। ছোট-বড় পাহাড়-টিলা, হাওড়, নদী, বনাঞ্চল, ঝরনার অপরূপ সমারোহ নিয়ে রাঙ্গামাটি জুড়িয়ে দেয় পর্যটক এবং দর্শকদের প্রাণ। তবে চোখ জুড়ানো সবুজ আর পাহাড়ের মাঝেই যেন ওতপেতে আছে নানারকম সমস্যা। প্রত্যন্ত অঞ্চল হওয়াতে প্রকৃতির রূপসী কন্যা রাঙ্গামাটির যোগাযোগ ব্যবস্থা তেমন উন্নত না। যোগাযোগের অপ্রতুলতা মানুষের দৈনন্দিন চলাফেরা থেকে শুরু করে প্রভাব ফেলছে মানুষের জীবনে বা জীবন রক্ষার ক্ষেত্রেও। এই অঞ্চলে এখনও চিকিৎসা ব্যবস্থা সারাদেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উঠতে পারেনি। রক্তদানের মতো বিষয়েও তাই এই জেলা যোজন যোজন পিছিয়ে আছে। শুধু যে যোগাযোগ ব্যবস্থা এর একমাত্র কারণ সেটা নয়। ইন্টারনেটের স্বল্পতা, জাতিভেদও এই জন্য কিছুটা দায়ী। রক্ত চাই। কথায় বলে, রক্ত দিলে হয় না ক্ষতি, জাগ্রত করে মানবিক অনুভূতি। সেই মানবিকতা জাগতে হবে সমাজ থেকেই। ধরাবাঁধা কোন নিয়ম করে মানবিকতা জাগ্রত করে তোলা সম্ভব না। জীবন বাঁচানোর তাগিদে দরকার সচেতনতা। আজকের গল্প রাঙ্গামাটির প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিগত ৮ বছর কাজ করে যাওয়া একটি ব্লাড ব্যাংকের যারা এখন পর্যন্ত সাড়ে সাত হাজার ব্যাগের বেশি রক্ত দান করেছেন। গল্পের শুরু ২০১১ সালে। রাঙ্গামাটির আনোয়ারুল কবিরের পিতা নোয়াখালীতে বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েন। জরুরীভিত্তিতে রক্তের প্রয়োজন হলেও তখন রক্ত পাওয়া যাচ্ছিল না। আনোয়ারুল কবির ছিলেন একজন শিক্ষক। রাঙ্গামাটি থেকেই তার কয়েকজন ছাত্র ফোনে রক্তদাতার সন্ধান করেন। সুস্থ হয়ে আনোয়ারুল কবিরের পিতা ধন্যবাদ দিয়ে সেই তরুণদের জানান- ফোনে যদি তারা নোয়াখালীতে রক্তদাতা খুঁজে বের করতে পারেন তাহলে অবশ্যই রাঙ্গামাটিতেও এ ধরনের কাজ করা সম্ভব। ব্লাড ব্যাংক ‘জীবন’ এর যাত্রা শুরু এভাবেই। আনোয়ারুল কবির, সাজিদ-বিন-জাহিদ, মোহাম্মদ আশফাক হোসেন, মেহের নীগার চৌধুরী, গায়ত্রী চক্রবর্তী, তাসনিমা হক জেরীন, ইয়া হাকিম পিয়াস এবং সব্যসাচী চাকমা ছিলেন জীবনে মূল কারিগর। পেশাদার রক্তদাতা পরিহার ও স্বেচ্ছায় রক্তদানকে সামাজিক আন্দোলনে রূপদান করার জন্যই ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় পার্বত্যাঞ্চলের সর্বপ্রথম অনলাইন ব্লাড ব্যাংক ‘জীবন’। যাত্রা শুরু হয়েছিল মাত্র ৮ জনকে নিয়ে। সেখান থেকে এখন জীবনের সদস্য ৩০০ জনের বেশি। আর তাদের নিবন্ধিত রক্তদাতা আছেন সাড়ে ছয় হাজারের বেশি মানুষ। এর বাইরেও রক্তদাতা এবং স্বেচ্ছাসেবী হয়ে কাজ করছেন আরও অনেক মানুষ। পার্বত্য ঢলে সৃষ্টি হওয়া বন্যা বা পাহাড়ধস বা তীব্র বৃষ্টিতে কর্দমাক্ত পথ কোন কিছুই থামিয়ে রাখতে পারে না এই সংগঠনের সদস্যদের। সেই থেকে পার্বত্য এলাকায় হাজারো মুমূর্ষু রোগীর জন্য আলোর নাম ‘জীবন’। যাত্রা শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত ৭৫০০ ব্যাগের বেশি রক্তদান করছেন জীবনের সদস্যরা। সংগঠনটির স্বপ্নদ্রষ্টা সাজিদ-বিন-জাহিদ (মিকি) জানান প্রতিকূল আবহাওয়াকে জয় করে ৭৫ কিলোমিটার পাহাড়ী পথ পাড়ি দিয়ে এসেও রক্তদান করেছিলেন তাদের এক রক্তযোদ্ধা। সংগঠন হিসেবে মানুষের জন্য মানুষ এই উপবব্ধি জাগিয়ে তুলতে পারাই তাদের অনেক বড় সার্থকতা। এছাড়া বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে রক্তদানের গুরুত্ব তুলে ধরতে ও প্রয়োজনীয়তা বুঝাতে ‘হ্যালো ক্যাম্পাস’ ক্যাম্পাস একটিভেশন কার্যক্রম পরিচালনা করছে সংগঠনটি। ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্ন কর্মদক্ষতামূলক ও কর্মমুখী প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে ‘হ্যালো টিম’। বর্তমানে রাঙ্গামাটির কয়েকটি স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে জীবনের কার্যক্রম। ক্যাম্পাসে তারা গড়ে তুলেছে স্বতন্ত্র রক্তদান ইউনিট যার ফলে ২৫০০ শিক্ষার্থীকে রক্তদানের গুরুত্ব সম্পর্কে ধারণা দেয়া গেছে। এর বাইরেও বিভিন্ন হাসপাতাল এবং ক্লিনিকেও তাদের নিয়মিত যোগাযোগ আছে। বিগত ৮ বছর ধরে এসব কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে অনলাইনে। তাদের ওয়েবসাইট লরনড়হনফ.ড়ৎম থেকে রক্তের প্রয়োজনে মানুষ এই ডাটাবেস থেকে সার্চ করে রক্তদাতা খুঁজে নিতে পারবে। এর বাইরেও আছে জীবনের কল সেন্টার। জরুরী মুহূর্তে রক্তের প্রয়োজন হলেই রিং বেজে উঠে সংগঠনটির ২৪*৭ নিবেদিত রক্তদাতা কল সেন্টারে। গত ৮ মাসে কল সেন্টার থেকে ১৪০০ ব্যাগ রক্তদান সম্পন্ন হয়েছে। নারীদের জন্য রয়েছে জীবনের বিশেষ কার্যক্রম ‘অপরাজিতা’। নারীদের স্বাস্থ্য সচেতন করে তোলা হচ্ছে এই অপরাজিতা থেকে। বিতরণ করা হয়েছে স্যানিটারি প্যাড। ২০১৭ সালে ১৩ জুন রাঙ্গামাটিতে যে স্মরণকালের ভয়াবহ পাহাড়ধস হয়, সেখানে জীবনের সদস্যরা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর রাঙ্গামাটি রিজিয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে স্বেচ্ছাশ্রমে নিয়োজিত ছিল। এই মর্মান্তিক পাহাড়ধসে রেশমা নামের এক গর্ভবতী মহিলা তার স্বামী ও পরিবারের সবাইকে হারায়। আশ্রয় কেন্দ্রে এই গর্ভাবস্থায় মানবেতর জীবনযাপন করে সে। হঠাৎ-ই একদিন তার প্রচ- ব্যথা ও অনবরত রক্তক্ষরণ হতে থাকলে রাত প্রায় ১২টা ৩০ এর দিকে তাকে বিএডিসি অশ্র্রয় কেন্দ্র থেকে চট্টগ্রাম মেডিক্যালে পাঠানোর জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা করে দেয় জীবনের সদস্যরা। চট্টগ্রামে রক্তদাতাও প্রস্তুত রাখা হয় তার জন্য। গত বছর লঙ্গদুতে একজন ক্যান্সার রোগীকে শেষ মুহূর্তে রক্তদানের ফলে তার জীবন রক্ষা পায়। এ রকম অজস্র উদাহরণ তৈরি করেছে জীবন। সবুজ গেঞ্জি পড়ে দুর্যোগ মোকাবেলায় অংশ নেয়া স্বেচ্ছাসেবকরা গ্রিন আর্মি নামে পরিচিত। এখন পর্যন্ত কী কী প্রতিবন্ধকতা জানতে চাইলে সাজিদ জানান, ‘দুর্গম এলাকা হওয়ায় অনেক সময় রক্ত দিতে যাওয়া বেশ কষ্টকর হয়। রাঙ্গামাটিতে রক্ত সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই এবং তৃতীয় সমস্যা হলো অনেক সময় একটি কমিউনিটি অন্য কমিউনিটির সঙ্গে রক্ত আদানপ্রদান করতে চায় না, যদিও সাম্প্রতিক সময়ে এটা অনেকটাই কাটিয়ে উঠা গেছে। রক্তদানের মাধ্যমে জেগে উঠছে ভাতৃত্ববোধ। ছোট হলেও আরেকটি সমস্যা ভাষা। অনেক সময় স্থানীয় ভাষা বুঝতে অসুবিধা হয়’। অচিরেই জীবনের একটি অফলাইন এ্যাপ উন্মুক্ত হবে। এই এ্যাপের মাধ্যমে ইন্টারনেট ছাড়াই কেউ ডাটাবেজে থাকা রক্তদাতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবে। সম্পূর্ণ বিষয়টি হবে এসএমএসের মাধ্যমে। সমাজ এবং মানবতায় অনন্য ভূমিকা রাখায় ২০১৮ সালে জীবন জয় বাংলা ইয়ুথ এ্যাওয়ার্ড লাভ করে।
×