ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

চির তারুণ্যের জয়ধ্বনিতে বিদ্রোহী নজরুল

প্রকাশিত: ০৭:২৯, ২৭ আগস্ট ২০১৯

চির তারুণ্যের জয়ধ্বনিতে বিদ্রোহী নজরুল

১৮৯৯ সালে জন্ম নেয়া বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম সমকালীন সমাজ আর জীবন প্রবাহকে যেভাবে প্রত্যক্ষ করেছেন, তেমন সৃষ্টিশীল উদ্যোম আজও তার সাক্ষী হয়ে অনুরাগী, ভক্তদের উদ্দীপ্ত করে যাচ্ছে। তারুণ্যের প্রাবল্য আর চেতনা ছিল এই মানবতার পূজারীর সহজাত, সাবলীল। উনিশ শতকীয় নবজাগরণের সুবর্ণ সময় পার হওয়ার ক্রান্তিলগ্নে নজরুল বিশ শতকের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ আবহে যে মাত্রায় শৈশব, কৈশোর পার হতে থাকেন তাও ছিল ঔপনিবেশিক শাসনের এক দুর্দমনীয় প্রতিরোধ আর বিপরীত স্রোত। সঙ্গতকারণে নিজেকে তৈরি করেছেন বিদেশী শাসন-শোষণের অনিবার্য পরিণতিতে দীপ্ত তারুণ্যের এক বিপ্লবী মনস্তত্ত্ব নিয়ে। প্রথাসিদ্ধ সমাজের বিরূপ প্রতিবেশকে আঘাত করাই শুধু নয় মানুষ মানুষে ভেদাভেদকেও অদম্য চেতনায় নির্মূল করতে তার সৃজন শক্তিকে নিঃশেষে সমর্পণ করেছেন। সে তো বিশ শতকের দুই দশক পার হওয়ার অন্তিম পর্বে। কিন্তু তারও আগে বালক নজরুলের প্রতিদিনের যাপিত জীবনের টানাপোড়েনের সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্কের বিপন্ন অবস্থায় গৃহ ছাড়া হওয়ার মতো দুর্ভোগেরও শিকার হতে হয়। নাম ছিল দুখু মিয়া। দুঃখের তিমিরে অবগাহন করে যাঁর জীবন তৈরিই শুধু নয়, অতিক্রম করাও। পিতৃহীন দুখুর মাতা জাহেদা খাতুনের সঙ্গে মাতৃস্নেহের শৈথিল্যে পারিবারিক বন্ধনটি কোন এক সময় একেবারে আগলা হয়ে যায়। লেটো গানের দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া, মক্তবে নিজেকে যুক্ত করাই শুধু নয় জীবিকার অন্বেষণে রুটি বেলার মতো কঠিন কর্মযোগও প্রতিনিয়ত তাড়িত করতে থাকে। কখনও বর্ধমানের চুরুলিয়া গ্রামে কিংবা বঙ্গদেশের অন্য কোথাও। লেখাপড়ার ধারাবাহিক পর্বে অনেক বিপরীত স্রোতকে মোকাবেলা করেও কিশোর বয়সে মেধা ও মননের শক্তি দৃশ্যমান হতে সময় লাগেনি। এক প্রতিভাদীপ্ত মননের বৈপ্লবিক সৃজন শৌর্য কিশোর বয়সেই ভেতর থেকে আলোড়িত করলেও ছন্নছাড়া জীবনের সুস্থিরতার অভাবে তা অন্ধকারের ছায়ায় অন্তর্নিহিত শক্তির প্রাবল্যেই দানা বাঁধতে থাকে। উপস্থিত বক্তৃতা দেয়ার ক্ষমতা, লেখনীর অনবদ্য নান্দনিকতায় স্কুল জীবনের সুবর্ণ সময়ে শিক্ষকদের নজরেও চলে আসেন। বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে অবিভক্ত বাংলা তথা পুরো ভারতবর্ষ এক অস্থিতিশীল আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক বলয়ের প্রলয় বিক্ষুব্ধ প্রতিবেশ। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ, ১৯০৬ সালের সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠাÑ এসবের প্রতিক্রিয়ায় স্বদেশী আন্দোলনের এক উন্মত্ত উন্মাদনা, উদীয়মান উদ্দীপ্ত তারুণ্য ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের যে সংঘাতপূর্ণ লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয় সশস্ত্র অভিযানে সেটাও তৎকালীন পরিবেশকে নানামাত্রিকে বেসামাল এবং লাগামহীন করে তোলে। সম্ভাবনাময় তরুণ প্রজন্ম স্বদেশ-প্রেমের উদ্দীপনায় গোপন হত্যা, অস্ত্র লুণ্ঠন, সম্পদ হরণের মতো বৈপ্লবিক উন্মাদনায় জড়িয়ে পড়ে সেটাও অবিভক্ত বাংলার সামগ্রিক পরিস্থিতিকে অস্থির আর সঙ্কটাপন্ন পর্যায়ে নিয়ে যায়। দেশের জন্য উদ্দীপ্ত তারুণ্যের এই আত্মনিবেদন, মরণকেও সগর্বে বরণ করে নেয়া সে সময়ের এক অবধারিত পর্যায়। ১৯১১ সালে ব্রিটিশ রাজশক্তি বঙ্গভঙ্গ রদ করলে পরিস্থিতি সেভাবে নিয়ন্ত্রণে এলেও সব দিক সামলানো সম্ভব হয়নি। নজরুল সেই প্রতিকূল পরিবেশের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ আবহে নিজের শৈশব-কৈশোর অতিক্রম করে জীবনের পালাক্রমে কোন সুস্থিরতার নাগালই পাননি। ইতোমধ্যে ১৯১৪ সালে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সহিংস প্রলয়। যার অনিবার্য প্রভাব এসে লাগে উপনিবেশ শাসিত ব্রিটিশ ভারতে। এক উদীয়মান তরুণ প্রত্যক্ষ করলেন সেই যুদ্ধের উদ্দমতা, দামামা। ভেতরে ছিল এক অদমনীয় তারুণ্যের বিদ্রোহী সত্তা। ফলে ছড়িয়ে পড়া সংগ্রামে নিজেকে সংযুক্ত করতে তৈরি হতে থাকেন। ১৯১৭ সালে ১৮ বছর বয়সে লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে চলে যান যুদ্ধের কারণে গড়ে ওঠা বেঙ্গল রেজিমেন্টে। সুদূর করাচীতে সৈনিক জীবনের নতুন যাত্রাপথ। লড়াইয়ের ফাঁক ফোকড়ে সঙ্গীতের মূর্ছনায় অন্তর্নিহিত বোধ অনুরণিত হতে থাকে। বিভিন্ন সময়ে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের ওস্তাদদের কাছেও যাওয়া-আসা শুরু করেন। গানের তালিম নেয়াও জীবনের এক অপরিহার্য পর্ব। সৈনিক জীবনের ১ বছরের মাথায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ স্তিমিত হয়ে আসে। তার পরেও বিদ্রোহী কবির অত তাড়াতাড়ি কলকাতা ফিরে আসা হয়নি। যুদ্ধের রেশ কাটতে আরও সময় লাগলেও কবি নিজেই তখন সেখানে অনেক কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। শুধু তাই নয় সৃষ্টির উদ্যোম তাঁকে উদ্বেলিত করতে থাকে নতুন স্রোতের অদম্য শক্তিতে। ১৯২০ সালে করাচী থেকে ফিরে আসা নজরুল লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা, সৃজন শৌর্যের অভাবনীয় ক্ষমতায় মাত্র এক বছরের মধ্যেই লিখে ফেললেন সাড়া জাগানো কাব্যিক দ্যোতনা ‘বিদ্রোহী’ কবিতা। সমকালীন সাহিত্যের আঙ্গিনা ছিল রবীন্দ্রনাথের একাধিপত্যে এক বিস্তৃত সাম্রাজ্য। যাকে অতিক্রম করা সময়ের কবি-সাহিত্যিকদের আয়ত্তের বাইরে। ’৩০-এর দশকের কল্লোল যুগের কবিরা তখন কবি গুরুকে স্পর্শ করা নয় বরং এমন পর্বতপ্রমাণ প্রতিভাকে পাশ কাটানোর চেষ্টায় পাশ্চাত্য সভ্যতার কাব্যিক আবহকে পুঁজি করার চেষ্টায় নিমগ্ন হলেন। নিজস্ব কৃষ্টি ঐতিহ্যিক ধারায় মনন চর্চায় রবীন্দ্রনাথের পাশাপাািশ দাঁড়ানো একেবারে সবার সাধ্যের মধ্যেই ছিল না। যুগোত্তীর্ণ এমন সৃজন ব্যক্তিত্বকে সম্ভ্রমে, সম্মানে, পূজায় আরতি দিয়ে এই উদীয়মান নজরুল যেভাবে সৃষ্টির সুখের উল্লাসে মনন শৌর্যকে নিবেদন করলেন তা তাক লাগিয়ে দিল শুধু বিশ্ব কবিকে নয় অবিভক্ত বাংলার পুরো সাহিত্যিক জগতকে। বাংলার সাহিত্যের আকাশে যে জ্বলজ্বলে নক্ষত্র তার আগমনী বার্তা জানাল তার জন্ম একেবারে বাংলার মাটিতে, শেকড়ের সুগভীর চেতনায় তার চেয়েও বেশি মানুষ আর মানবতার উদাত্ত জয়গানে। রবীন্দ্রভক্ত, অনুরাগী নজরুল কবি গুরুর সৃজন দ্যোতনায় ডুবে গেলেন, সঙ্গীতের সুবিশাল আঙ্গিনায় রবীন্দ্র অনুভবে নিজেকে পূর্ণ করলেন। কিন্তু সৃষ্টিশীল তাড়নায় যে কাব্য ও সুরের মূর্ছনা ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হলো তা রবীন্দ্র ভুবন থেকে অন্য মাত্রায়। ভিন্ন আঙ্গিকে। কাব্য লক্ষ্মীর বৈপ্লবিক সাধনায় রবীন্দ্র কবিতার গীতিময়তার ছাপ লক্ষণীয় না হলেও আপন বৈশিষ্ট্যে, নিজস্ব বৈভবে তা বাংলা সাহিত্যকে কাঁপিয়ে দিল। মানবতার জয়গান গেয়ে, শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে, উন্নত মস্তকে যে বিপ্লবী ধ্বজা ওড়ালেন ‘বিদ্রোহী’ কবিতার ছত্রে ছত্রে তা বাংলার কাব্য ভুবনে শুধু নতুনই নয় অনধিগম্যও বটে। প্রায় শতবর্ষকে স্পর্শ করার ক্রান্তিলগ্নে এই অদম্য কবিতাটি আজও অত্যাচার, নিপীড়ন, মানবতা আর মনুষ্যত্বের জয়গানে কবিতাটির আবেদন এক অভাবনীয় সৃষ্টির মহিমা। ১৯২১ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সে আগত যৌবনের আবেগাচ্ছন্ন চেতনায় তারুণ্যের যে উদ্দীপ্ত শক্তি তার প্রতি সময়ের প্রজন্মের আগ্রহ এখনও অভাবনীয়, যুগান্তকারী। স্নেহাস্পদ নজরুলের এমন সৃজনসৌধের পরিচয় পেয়ে এই টগবগে যুবককে প্রাণঢালা আশীর্বচনে ভাবিয়ে দিলেন, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শুধু তাই নয় পরের বছর অর্থাৎ ১৯২২ সালে নজরুল যখন অনশনব্রতে কারাগারে রবীন্দ্রনাথ তখন ‘বসন্ত’ নাটকটি এই বিপ্লবী যুবককে উৎসর্গ করলেন। শুধু তাই নয় কবি হিসেবেও নজরুলকে স্বীকৃতি দিয়ে দিলেন। পরের বিশটা বছর নজরুল আর পেছনে ফিরে তাকানোর অবকাশই পেলেন না। সৃষ্টি সুখের উল্লাসে লিখে যেতে লাগলেন সময়ের বার্তা, জীবনের প্রত্যাশিত আকাক্সক্ষায় সব মানুষের মিলনসৈৗধ। অসহায়, নিপীড়িত গোষ্ঠীর প্রতি সীমাহীন দায়বদ্ধতায় কাব্যলক্ষ্মীর আরাধনায় নিজেকে উজাড় করে দিলেন। ঔপনিবেশিক নির্মম যাতনা, অচলায়তন সমাজ ব্যবস্থার ভেতরে গেড়ে বসা অপসংস্কার, উদ্দীপ্ত তারুণ্যের অভাবনীয় শৌর্যের বন্দনাই শুধু নয়, মূল শেকড়ের অনুরণনেও ঝঙ্কার তুললেন তার ব্যতিক্রমী সাহিত্যের আঙ্গিনায়। নিজস্ব ক্ষমতা আর সৃজনবৈচিত্র্যে নিজেকে শুধু শক্তভাবে দাঁড়ই করালেন না, অভানীয় সম্পদে বাংলা সাহিত্যের ভা-ারকেও পূর্ণ করে দিলেন। সৃষ্টির অবারিত স্রোতধারায় উল্লসিত হয়ে ভেসে বেড়ালেন। তখনও ৩০-এর কোঠা পার হননি। আপন মহিমায়, নান্দনিক দ্যোতনায়, সৃষ্টি সুখের উল্লাসে যা ভক্তদের উপহার দিলেন সেই অমূল্য বৈভব আজ অবধি বাংলা ও বাঙালীর অনন্য সম্পদ। ধর্মীয় উন্মাদনাকে জোরালোভাবে প্রতিহত করলেন- জাতপাতের আকাশ-পাতাল ফারাককে তীব্র বাক্যবাণে প্রতিরোধ জানালেন। শুধু তাই নয় আপন সংস্কৃতির বেড়াজালে সমর্পিত হলেন। ঐতিহ্যিকে, চিরায়ত বোধকে সাহিত্যের উপজীব্য করতে দ্বিধাহীন হলেন। তেমন অন্যরকম বৈশিষ্ট্যে, নবসৃষ্টির তাড়নায় যা কিছু সৃজন দ্যোতনায় ঋব্ধ হলো তা আজও অপরাজেয়, অপ্রতিহত, অনধিগম্য। তারুণ্যের জয়গান গাওয়া এই উদ্দীপ্ত তরুণ জীবনভর সামাজিক আবর্জনাকে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করার যে দায়ভাগ কাঁধে নিয়েছিলেন ভেতরের অন্তর্নিহিতবোধ থেকে সে সচেতন, বৈপ্লবিক অভিব্যক্তি তা বিন্দুমাত্র চ্যুত হতে দেখা যায়নি। নজরুল ছিলেন প্রথাসিদ্ধ সামাজিক বিরুদ্ধ বলয়ের এক অপ্রতিহত শক্তি, অপ্রতিরোধ্য সৃজনসাধক সময় আর যুগের এক অগ্রগণ্য নায়ক। যার অশৈশব জীবনের পালাক্রমই তাঁকে অবস্থার প্রেক্ষিতে তৈরি করে নেয়। নিজেকে গড়ে তুলতে যে ক্ষমতা, দক্ষতা, প্রতিভা এবং মনন শৌর্যের অব্যাহত পর্যায়ে নিজেকে এগিয়ে নেয়া সেও যেন এক শৈল্পিকসৌধের ‘অনবদ্য জীবন’ গাঁথা। যেখানে অতি সাধারণ এক কিশোর সামাজিক প্রতিবেশের সঙ্গে লড়াই করতে করতে অনন্য বিদ্রোহী সত্তায় উদ্ভাসিত হতেও সময় নেন না। অসাধারণ নজরুল হওয়ার এই স্বাভাবিক, সাবলীল গতি প্রবাহে বাংলা ও বাঙালীর যে অসামান্য সম্পদ অর্জন তা কালকে অতিক্রম করে আর কত দূর যাবে তার জবাব দেবে সময়।
×