ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মৃগীরোগ ও সামাজিক কুসংস্কার

প্রকাশিত: ০৬:২২, ২৭ আগস্ট ২০১৯

মৃগীরোগ ও সামাজিক কুসংস্কার

কেস হিস্ট্রি বিয়ের কিছুদিন পরেই শ্বশুরবাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসতে হয়েছে রহিমাকে। কি তার অপরাধ? তার অপরাধ হলো- সে হঠাৎ খিঁচুনি হয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়, মুখ দিয়ে লালা পড়ে। খিঁচুনির মধ্যে প্রস্রাব করে দেয়। আর কিছু বলতে পারে না। এরকম অনেক রহিমার স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। মুখ ও শরীরে বিভিন্ন জায়গায় থাকে আগুনের পোড়া দাগ ও আঘাতের ক্ষতচিহ্ন। পানিতে গোসল করতে গিয়ে অনেক রোগীর অনাক্ষিত মৃত্যু ঘটে। কে তাদের খবর রাখে। পাড়া-প্রতিবেশীরা বলে আলগা দোষ, বাতাস লাগছে অথবা জিনে ধরছে। কারণ অসুখ হলে তো সবসময় থাকবে। নিশ্চয় বাতাস লাগছে কারণ অমাবস্যা পূর্ণিমায় বেড়ে যায় এরকম হাজারো ব্যাখ্যা থাকে ফকির-কবিরাজ, তাবিজ-কবজওলাদের কাছে। সামাজিক কুসংস্কার অনেকে মনে করে মৃগী একটি আছরের ব্যাপার/আলগা দোষের ব্যাপার/ বাতাস লেগেছে/ জিন-ভূতের ব্যাপার। এ রোগের কোন সঠিক চিকিৎসা নেই। এই রোগীর লেখাপড়া, বিয়েশাদী, সংসার- কিছু হবে না। অনেকে মনে করে মৃগী একটা প্রাকৃতিক অভিশাপ। ফলে রোগটি গোটন করে রাখে, বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে। কারণ তারা মনে করে, রোগটি জানাজানি হলে পরিবারের জন্য ক্ষতি হবে, মেয়েটির বিয়ে দিতে অসুবিধা হবে। এরকম ধারণার বশবর্তী হয়ে, চিকিৎসা না করিয়ে আরও ক্ষতি করা হচ্ছে। বিয়ের পর মেয়েটি যখন শশুরবাড়ি যায় এবং সেখানে এই রোগ আক্রমণ করে তখন মেয়েটির বিয়ে টিকিয়ে রাখাই দুষ্কর হয়ে পড়ে। সুতরাং রোগটি গোপন না করে চিকিৎসা করানোই উত্তম। মৃগী রোগ কি? মৃগীরোগ ব্রেনের ১টি অসুখ যা মাথায় কিছু নিউরোট্রান্সমিটারের তারতম্যের কারণে হয়। ছোট কোলের শিশু থেকে শুরু করে বয়স্ক মানুষ সবাই মৃগীরোগে আক্রান্ত হতে পারে তবে বাচ্চাদের মধ্যে এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি হয়। পরিসংখ্যান মতে যদিও কোন জাতীয় পরিসংখ্যান নেই তবে ধারণা করা হয় বাংলাদেশে মোট ১.৫-২.০০ মিলিয়ন লোক মৃগী রোগে আক্রান্ত হয়। এই পরিসংখ্যান শ্রীলঙ্কাতে প্রতি হাজারে নয় জন এবং ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন রকম। রোগের লক্ষণ ১. হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যাওয়া ২. শরীরের খিঁচুনি শুরু হওয়া ৩. জিহ্বা ও দাঁতে কামড় লাগা ৪. খিঁচুনির সময় প্রস্রাব- পায়খানা হয়ে যাওয়া ৫. জ্ঞান হারানোর মুহূর্তে তার চারপাশের ঘটনা বলতে পারে কিনা –এ বিষয়গুলো মৃগীরোগ নির্ণয়ে সহায়তা করে। ৬.খিঁচুনির পরে মাথা ব্যথা, শুয়ে থাকা, কিছু সময় ধরে চুপচাপ থাকা। কয়েকটি উদাহরণ এক : হঠাৎ করে যেকোন বয়সের একজন মানুষ অজ্ঞান হয়ে, চোখ-মুখ উল্টিয়ে ফেলল এবং তার সঙ্গে সারা শরীরে ঝাঁকুনি বা খিঁচুনি শুরু হয়ে গেল। এ সময় এটাও দেখবেন, উৎসাহী দুয়েক জন তার নাকের সামনে জুতা স্যান্ডেল ইত্যাদি ধরছে। দুই : কোন শিশু হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে যায়। চোখের পাতা নড়ে না। একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। বাবা মা- অনেক সময় ভাবেন এটা ছেলের কাব্যিক ভাব। ছেলে তার কবি হয়ে উঠছে। কখনও হাতে কিছু থাকলে হঠাৎ করেই পড়ে যায়। তিন : আপাতত মানসিকভাবে সুস্থ একজন লোক হঠাৎ করে অস্বাভাবিক ব্যবহার শুরু করল। মুখভঙ্গির পরিবর্তনসহ অস্বাভাবিক হাঁটাচলা শুরু করল। আবোল তাবোল কথা বলতে শুরু করল। আবার কয়েক মিনিট পর সুস্থ হয়ে গেল। চার : এরকম দেখা গেছে পানিতে গোসল করতে গিয়ে খিঁচুনি উঠে ডুবে গেছে। পাঁচ : কেউ কেউ বলে চোখেমুখে অন্ধকার দেখি, চোখে আলোর ঝিলিক দেখি এর পর আর কিছু বলতে পারি না। এরকম বিভিন্নভাবে মৃগী রোগী ডাক্তারের কাছে আসতে পারে। কাদের মধ্য বেশি হতে পারে ১. ফেবরাইল সিজার ২.অতীতে/ বর্তমানে পরিবারের কারও এ রোগ থেকে থাকলে। ৩. ব্রেইন টিউমার ৪. বেনই টিউমার ৫. হেড ইনজুরি ৬. বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ৭. স্ট্রোক ৮. শরীর লক্ষণ মিনারেল ও ভিটামিনের ঘাটতি ৯. বড় অসুখ যেমন ডায়াবেটিকস ইত্যাদি মৃগীরোগ উঠলে আশপাশের লোকদের কী করণীয়? মৃগীরোগীর মুখে অনেকেই চামড়ার জুতা, গরুর হাড়, লোহার শিক ইত্যাদি চেপে ধরে। এসব স্রেফ কুসংস্কার, এসবে আসলে কোন কাজ হয় না। বরং ক্ষতিই হয়। মৃগী- হঠাৎ শুরু হয়ে আবার এমনিতেই থেমে যায়। সাধারণত এ ধরনের এ্যাটাক আধ মিনিট বা ১ মিনিট থাকে। এজন্য কোন কিছু করার দরকার নেই, অনেকে অস্থির হয়ে রোগীর হাত-পা চেপে ধরে, মাথায় পানি দেয়, অস্থির হয়ে মুখে ওষুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করে। আসলে এসব কিছুই করার দরকার নেই। রোগটা নিজে নিজেই থেমে যাবে। তারপর সাধারণত রোগী ঘুমিয়ে পড়ে। কারও কারও অবশ্য মাথাব্যথা হয়। তবে করণীয় হলো, রোগটি যেমন করছে, করতে দেয়া। শুধু দেখতে হবে যে রোগীর আশপাশে ধারালো অস্ত্র, যন্ত্রপাতি, আগুন ইত্যাদি যেন না থাকে। যাতে সে আঘাতপ্রাপ্ত না হয়। জোরে ঠেসে ধরলেই বরং ক্ষতি হতে পারে। রাস্তার পাশে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাওয়ার উচিত। যদি দেখা যায় যে, ৫-১০ মিনিটেও মৃগী থামছে না, বা পর পর, ঘন ঘন আক্রান্ত হচ্ছে তবে রোগীকে কাছের হাসপাতালে বা ক্লিনিকে স্থানান্তর করা দরকার। যেখানে ডাক্তাররা সঠিক ব্যবস্থা নেবেন। রোগীর জন্য পরামর্শ ১. নিয়মিত ওষুধ সেবন করুন। ২. নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ নিন। ৩. সময়মতো ঘুমান। ৪. উত্তেজনা প্রশমন করুন। ৫. পানিতে নামবেন না। ৬. খিঁচুনির মাত্রা পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসা পর্যন্ত আগুনের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকুন। ৭. গাড়ি চালানো থেকে বিরত থাকুন ৮. গাছে উঠবেন না ৯. ভ্রমণে সঙ্গে ওষুধ রাখুন ১০. ধুমপান বর্জন করুন ১১. রোগীর সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শের ফটোকপি ও বাসার ফোন নম্বর সার্বক্ষণিক সঙ্গে রাখুন শিক্ষকদের করণীয় ১. মৃগী রোগের লক্ষণ সম্পর্কে ভাল জ্ঞান থাকা দরকার যাতে স্কুলে কোন বাচ্চার এই সমস্যা হলে তড়িৎ গতিতে বুঝতে পারে। ২. পূর্বেই ধারণা থাকা উচিত কাছেই কোন হাসপাতালে বা চিকিৎসকের কাছে পাঠাতে হবে। ৩. দীর্ঘদিন ঔষধ খাওয়ার গুরুত্ব ছাত্রছাত্রীদের বুঝানো উচিত। ৪. অন্য ছাত্রছাত্রীদের মাঝে মৃগী রোগের সামাজিক কুসংস্কার নিয়ে আলোচনা করা যাতে তারা সোচ্চার হতে পারে এবং সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারে। ৫. এই সকল শিশুকে আলাদা চোখে না দেখা, তাদের সকল ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে পড়াশোনার সুযোগ করে দেয়া। মহিলাদের বিশেষ পরামর্শ ১. মৃগী রোগে আক্রান্ত মহিলা যাদের বয়স ৫০ এর নিচে অর্থাৎ রিপ্রোডাক্টিভ এজ তাদের মাসিকের সময় খিঁচুনির পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে। চিকিৎসকের পরিভাষায় এদের বলে কেটামেনিয়াল সিজার। ২. গর্ভাবস্থায় রোগীর মধ্যে থাকে অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, ভীতি ও প্রশ্ন। বাচ্চা নিতে পারবে কিনা? মৃগী রোগের ঔষধ খেতে পারবে কিনা? হ্যাঁ। চিকিৎসকের পরামর্শক্রমে মৃগী রোগীদের বিয়ে, সংসার, কর্মজীবন, লেখাপড়া ও বাচ্চা নেয়া কোন বাধা নেই। সব শেষে সকলের প্রতি উপদেশÑ সামাজিক কুসংস্কার থেকে বেরিয়ে এসে নিয়মিত চিকিৎসা নিন সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করুন। ডা. মোঃ দেলোয়ার হোসেন সহকারী অধ্যাপক, মনোরোগ বিভাগ, আনোয়ার খান মর্ডাণ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
×