ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বেপরোয়া রোহিঙ্গারা, নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না

প্রকাশিত: ১০:২৫, ২৬ আগস্ট ২০১৯

বেপরোয়া রোহিঙ্গারা, নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না

শংকর কুমার দে ॥ বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটিয়ে বিপর্যয়কর ও ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে চলেছে মিয়ানমার থেকে আগত লাখ লাখ রোহিঙ্গা। মিয়ানমার থেকে আগত কক্সবাজারের ৩২ রোহিঙ্গা শিবিরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর প্রতিবেদন তৈরি করেছে গোয়েন্দা সংস্থা। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ২ বছরে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে নিহত হয়েছে ৪৩ রোহিঙ্গা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে ৩২ রোহিঙ্গা। ইয়াবা ব্যবসা, মানব পাচার, খুন, ধর্ষণ, চোরাচালান ও ডাকাতিসহ নানা অপরাধে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৪৭১টি। এতে আসামি করা হয়েছে ১০৮৮ রোহিঙ্গাকে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো থেকে পালিয়ে দেশের বিভিন্নস্থানে ছড়িয়ে পড়ার পর আটক করে ক্যাম্পে ফেরত পাঠানো হয়েছে ২০ হাজার রোহিঙ্গাকে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে সহস্রাধিক রোহিঙ্গার তালিকা তৈরি করা হয়েছে, যারা সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে এ খবর জানা গেছে। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন বিলম্বিত ও অনিশ্চিত হওয়ার কারণে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে রোহিঙ্গারা। বিজিবি, র‌্যাব, পুলিশ-আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তিন সংস্থা মিলেও অপরাধপ্রবণ রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার ও মানবাধিকার নিশ্চিতের দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত ফিরে যাবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে রোহিঙ্গারা। আর তাদের উস্কে দিচ্ছে এনজিগুলো। এদিকে দিন যত যাচ্ছে স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে রোহিঙ্গারা বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। রোহিঙ্গারা জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধের ঘটনায়। এতে এলাকায় সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খল পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে। ইয়াবা ব্যবসা, মানব পাচার, খুন, ধর্ষণ, চোরাচালান ও ডাকাতিসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। রোহিঙ্গাদের উৎপাতে এলাকাবাসী যেমন উদ্বিগ্ন তেমনি প্রশাসনও উৎকণ্ঠায়। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রথমদিকে রোহিঙ্গারা ত্রাণ সামগ্রীর আশায় ছুটে বেড়াত এ ক্যাম্প থেকে সেই ক্যাম্পে। একবেলা খাবারের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। কিন্তু এখন পাল্টে গেছে দৃশ্যপট। এনজিওরা সবকিছু এখন পৌঁছে দিচ্ছে তাদের ঘরে ঘরে। একই সঙ্গে ফিরে না যাওয়ার নানা কৌশল রপ্ত করানো হচ্ছে। সঙ্গত কারণেই তারা এখন দাবি তুলছে- নাগরিক অধিকার ও মানবাধিকার নিশ্চিতের দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তারা কোন অবস্থাতেই মিয়ানমারে ফিরে যাবে না। সহজেই ঘরে বসে ত্রাণসামগ্রী পেয়ে যাওয়ায় তাদের মাথায় চেপে বসেছে নতুন ভূত। কোন কাজ ও সংসারের পিছুটান না থাকায় রোহিঙ্গারা নানা অপকর্মে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তারা রোহিঙ্গা ক্যাম্পকে ইয়াবা রাজ্য বানিয়েছে। ধর্ষণ, খুন, হামলা তাদের নিয়মিত কাজে পরিণত হয়েছে। ফলে দিন যত যাচ্ছে ততই অবনতির দিকে যাচ্ছে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৩২টি রোহিঙ্গা শিবিরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গারা এখন আর নীরিহ নেই। দিন যত যাচ্ছে ততই তারা বেপরোয়া হয়ে উঠছে। নানা অপরাধের ঘটনা ঘটাচ্ছে তারা। জেলার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে হিমশিম খাচ্ছে। এ কারণে পোশাকধারী পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোশাকে গোয়েন্দা পুলিশকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে নজরদারি করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। রোহিঙ্গারা মানবিক আশ্রয় পেয়েছে এ কথাটিই তারা বেমালুম ভুলে গেছে। তারা এখন এলাকাবাসীর জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। টেকনাফের মানুষ রোহিঙ্গাদের এহেন কর্মকা-ে অতিষ্ঠ। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেশ কয়েকটি এনজিও নিজেদের আখের গোছাতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে যেমন বাধা দিচ্ছে তেমনি রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে যেতে এবং মিয়ামারে ফিরে যেতে অনাগ্রহ তৈরিতে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করছে। তাদের মূল উদ্দেশ্য হলো রোহিঙ্গারা যেন মিয়ানমারে ফিরে না যায়। সঙ্গে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশেও উৎসাহিত করছে তারা। আর রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে এসব এনজিও দীর্ঘ সময় দাতাসংস্থার অর্থ লুটপাট অব্যাহত রাখতে কোন কোন এলাকায় নতুন করে ক্যাম্প নির্মাণের চেষ্টা চালাচ্ছে। এতে স্থানীয়দের নিয়ে বাধা দেয়া হয়েছে। মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত এই শরণার্থীদের সাদরে গ্রহণ করে, খাবার আর আশ্রয় দিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছিল বাংলাদেশ ও সরকার। কিন্তু রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর দ্বিতীয় চেষ্টাও ব্যর্থ হওয়ায় আবালবৃদ্ধবনিতা সব বয়সী মানুষের মধ্যেই উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, আতঙ্ক আর রোহিঙ্গাবিরোধী মনোভাব বাড়ছে, যা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটার আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে। পুলিশ সদর দফতরের এক কর্মকর্তা বলেন, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার সময় সরকারের পক্ষ থেকে হোটেল, রাস্তা, যানবাহনে সর্বক্ষণিক নজরদারি ও তল্লাশির ব্যবস্থা রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ত্রিশটি ক্যাম্পে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তার নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে ঢুকে পড়া এসব রোহিঙ্গা প্রতিদিন ক্যাম্প ছেড়ে পালাচ্ছেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিনিয়ত রোহিঙ্গা আটক হচ্ছে। কাজের খোঁজ ছাড়াও শরণার্থী শিবিরের মানবেতর জীবন থেকে মুক্তি পেতে ও ধনী হওয়ার আশায় স্থানীয় দালাল চক্রের সহযোগিতায় বিদেশ পাড়ি দেয়ার ইচ্ছায় অনেক রোহিঙ্গা ক্যাম্প ছেড়ে যাচ্ছেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়া রোহিঙ্গারা মাঝেমধ্যে আটক হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দালালরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে কাঁটাতারের বেড়া দেয়ার কথা থাকলেও তা এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। রোহিঙ্গারা যাতে দেশের মূল জনস্রোতে মিশে যেতে না পারে সেজন্য টেকনাফ থেকে উখিয়া পর্যন্ত বসানো হয়েছে বেশ কয়েকটি চেকপোস্ট। পুলিশ, বিজিবি ও অন্যান্য সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা এসব চেকপোস্টে তল্লাশি চালান। তবে এত সতর্কতার পরও রোহিঙ্গারা ছড়িয়ে পড়ছে অন্যান্য এলাকায়। জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন পেশায়। উখিয়ার ফলিয়াপাড়া সড়ক দিয়ে প্রতিদিন ভোরে রোহিঙ্গাদের কাজের সন্ধানে বের হতে দেখা যায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একশ্রেণীর সদস্য টাকার বিনিময়ে তাদের অবাধে বাইরে যেতে দেন বলে অভিযোগ রয়েছে। রোহিঙ্গারা আসার পর বোরকার বিক্রি বেড়ে গেছে। ক্যাম্পের নারীরা বোরকা পরেন। বোরকা পরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চলে যাওয়ার সুবিধা আছে। গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, গত মাসে নিরাপত্তার বিষয়টি সামনে রেখে সরেজমিনে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো পরিদর্শন করেছেন বিজিবির মহাপরিচালক, পুলিশের আইজি, র‌্যাবের ডিজি-আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তিন প্রধান। মিয়ানমার থেকে আসা শরণার্থী হিসেবে আশ্রিত রোহিঙ্গরা দেশের বিভিন্নস্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানোসহ নানা ধরনের অপরাধী কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়তে না পারে সেজন্য তাদের সরেজিমনে পরিদর্শন করাই উদেশ্য। সরিজমিন রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করা তিন বাহিনীর প্রধানরা হলেন- বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোঃ সাফিনুল ইসলাম, ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ (আইজিপি) ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী ও র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) মহাপরিচালক ড. বেনজীর আহমেদ। রোহিঙ্গারা শরণার্থী ক্যাম্প থেকে পালিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্নস্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে বহুমুখী অপরাধে জড়িয়ে পড়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিনষ্ট করছে, তা কিভাবে মোকাবেলা করা যায় তা সরেজমিনে পরিদর্শন করে সরকারের কাছে সুপারিশ করাই তিন বাহিনী প্রধানের সরেজমিনে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনের লক্ষ্য। কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর নিরাপত্তার দায়িত্বে কাজ করছে বিজিবি, র‌্যাব, পুলিশ। এ জন্যই বিজিবি, র‌্যাব, পুলিশ-এই তিন বাহিনীর প্রধান একসঙ্গে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন।
×