ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ক্লিওপেট্রার নীল পদ্মগালিচা সংবর্ধনাই সিজারের প্রথম প্রেমের বৃন্দাবন

নীলপদ্ম- কিংবদন্তির ফুল

প্রকাশিত: ১০:০১, ২৬ আগস্ট ২০১৯

নীলপদ্ম- কিংবদন্তির ফুল

সমুদ্র হক ॥ নীলপদ্ম নিয়ে মানব হৃদয়ে অপার কৌতূহলের অন্ত নেই। নীলপদ্ম কি সত্যিই আছে! ইংরেজী ওয়াটার লিলির (শালুক) বংশোভূত ফুল তো অনেক। পুষ্পপ্রেমীরা বলেন, শালুক পরিবারের শাপলার সঙ্গে পদ্ম পরিবারের খুব একটা নিকটত্ব নেই। পাতা দেখে এদের পৃথক করা যায়। পদ্মপাতার পরিধি গোল। শালুকের মতো একদিকে খাঁজকাটা নয়। পদ্মের বৈজ্ঞানিক নাম নিলাম্বো নিউসিফেরা। পুষ্পপ্রেমী সরকারের উপসচিব রায়হানা ইসলাম তার বাসভবনে প্রকৃতিকে নিয়ে থাকেন। স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন প্রকৃতির সান্নিধ্যে থাকতে। সরকারী দায়িত্ব পালনের মধ্যেও সময় বের করে একান্ত আপন ভুবনে পুষ্প পরিচর্যা করেন। আনকমন ফুলের চারা টবে রোপণ ও নিয়মিত পরিচর্যা করে ফুল ফুটিয়ে আনন্দ পান। তার বাড়ির ছাদে ও ব্যালকনিতে নীলপদ্ম, গোলাপীপদ্ম, নীলকণ্ঠসহ অচেনা ফুল ফুটিয়ে তা ছড়িয়ে দিচ্ছেন সামাজিক যোগাযোগে মাধ্যমে। তবে তিনি নীলপদ্মকে শালুক গোত্রের ফুল মনে করেন। রায়হানা ইসলাম বলেন, প্রকৃতি ও ফুল মানব মনের সৌন্দর্যের ভাবনা বিকশিত করে। নীলপদ্ম জলের গভীরে ফোটা ফুল। বলা হয় ইজিপসিয়ান বিম। প্রাচীন মিসরে টলেমি যুগে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকা রহস্যময়ী ক্লিওপেট্রা ও নেফারতিতির চেয়েও অধিক ক্ষমতাধর, প্রতাপশালী নারী হাটশেপসুট প্রতিদিন প্রাসাদে বসে নীলপদ্মের সৌন্দর্য উপভোগ করতেন। বিশেষ জলাধার নির্মাণ করে নীলপদ্ম ফোটানো হতো তার প্রাসাদে। তার উত্তরসূরি ক্লিওপেট্রা প্রাসাদজুড়ে পদ্ম বিছিয়ে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন রোমান বীর জুলিয়াস সিজারকে। পদ্মগালিচার ওই সংবর্ধনায় পরে প্রণয়ের অভিষেক হয়। তবে তা ছিল শুধুই প্রণয়। সিজারের মৃত্যুর পর ক্লিওপেট্রা সিজারেরই সেনাপতি মার্ক এ্যান্টনিকে বিয়ে করেন। এসব ইতিহাসের সত্যতা- এ নিয়ে নানান প্রশ্ন আছে। কালের আবর্তে ঘটনা প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত দেয় নীলপদ্ম ছিল প্রাচীন মিসরের রাজশক্তির প্রতীক। প্রকৃতির ধারায় মানব মনের চিরকালীন সত্তা রোমান্টিসিজমে এসেছে পদ্ম। সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতায় রূপক বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে- প্রেমিকা বরুণাকে পাওয়ার জন্য প্রেমিক দুঃসাধ্য সাধন করে একশ’ আটটি নীলপদ্ম সংগ্রহ করেছিল। রামায়ণে রামচন্দ্র দুর্গাপূজায় দেবীকে একশ’ আটটি নীলপদ্ম অঞ্জলি দেয়ার সময় একটি কম পড়লে চোখ তুলতে উদ্যত হন। দেবী মুগ্ধ হয়ে রামের চোখ রক্ষা করেন। সেই থেকে পদ্মকে সুন্দর চোখের সঙ্গেও তুলনা করা হয়। কণ্ঠশিল্পী শ্যামল মিত্রের একটি গানের কথা ‘ওই পদ্ম চোখের নীল যমুনায় আমি ঝাঁপ দিয়েছি...।’ পদ্মের অনেক নাম। পদ্মকমল, শতদল, মৃণাল, পঙ্কজ, চরণ কমল, করকমল আরও কত কি। বগুড়ার সবুজ নার্সারির স্বত্বাধিকারী আবদুল মান্নান থাইল্যান্ড থেকে নীলপদ্মের চারা বীজ সংগ্রহ করে আনেন। মাটির চারিতে (বড়পাত্র) পানি ভরে জলাধার তৈরি করেন। তলদেশে কিছু পলি মাটি দেন। কিছুদিন পর নীলপদ্ম চোখ মেলে। মান্নান জানালেন বিশেষ প্রক্রিয়ায় যে কোন সময় রোপণ করা যায়। এক বছরের মধ্যে ফুল ফোটে। এ জন্য দরকার চারির মতো টব। উদ্যানতত্ত্ববিদ মাসুদার রহমান জানান, পদ্মের প্রেম পানির সঙ্গে। পদ্ম ও শাপলা দূর থেকে একই রকম মনে হয়। কাছে গেলে ধরা পড়ে পার্থক্য। পদ্ম ও শাপলার ইংরেজী নাম লোটাস। বিভ্রাট ঘটে পদ্মের নামে। পদ্মের ইংরেজী কয়েকটি নাম খুঁজে পাওয়া যায় এরকম লিলিনাইল, ইজিপসিয়ান লিলি, দ্য ফ্লাওয়ার অব এ্যানসিয়েন্ট ইজিপসিয়ান। এগুলোকে প্রকৃত নাম বলা যায় না। সাধারণ পদ্ম সাদা লাল ও নীল। আমাজান লিলি পদ্মেরই একটি জাত। চর্যাপদে সৃষ্টির সূচনায় আছে পদ্মের পাপড়ি ৬৪। আরেকটিতে বলা হয় ৪৪। ফুলের মধ্যের অংশের পুষ্পরেণুর শাখা হলদেটে। প্রকৃতিতে পদ্মের নিষ্ঠা সূর্যের সঙ্গে আর শাপলার সম্মোহন চাঁদের সঙ্গে। মহাজ্ঞানী বুদ্ধের একটি সূত্রের নাম পদ্মসূত্র। সিদ্ধার্থের সাধনায় সে সব কিছুই আছে মনিপদ্মে। এই মনিপদ্মেরই একটি রূপ নীলপদ্ম। বৈদিক যুগেরও আড়াই হাজার বছর আগে প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে পদ্মের উল্লেখ আছে। খ্রীস্টপূর্ব প্রায় তিন হাজার বছর আগে সিন্ধু সভ্যতার পরিচয়বাহী মৃৎপাত্রে পদ্মের নক্সা পাওয়া যায়। প্রাচীন নানা স্থাপনা ও পাত্রে দেখা যায় পদ্মফুলের অজস্র চিত্র। পুষ্পকলির আবির্ভাবের সঙ্গে জীবজগতের যৌবন সন্ধিক্ষণের তুলনা করা হয়। ফরাসী সম্রাট নেপোলিয়ন বলেছিলেন, ফুল বিলুপ্ত হতে থাকলে সে জায়গা মনুষ্য বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে। গ্রীক উপাখ্যানে প্রেমের দেবী ভেনাসের জন্মের সঙ্গে আছে ফুলের সম্পর্ক। পৌরাণিক কাহিনীর ব্রহ্মা প্রথমে গোলাপের কথা বলেন, পরে স্বীকার করেন পৃথিবীতে পদ্মই শ্রেষ্ঠ। সেই আদিকাল থেকে ফুল মানব জীবনকে সুন্দরের ধারায় এগিয়ে নেয়।
×