ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বঙ্গবন্ধুকে আমি যেমন দেখেছি

প্রকাশিত: ০৮:৫৪, ২৬ আগস্ট ২০১৯

 বঙ্গবন্ধুকে আমি যেমন দেখেছি

(গতকালের পর) বঙ্গবন্ধু মামলার এজাহারে মোহিতুল উল্লেখ করেন, কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম তা খেয়াল নেই। হঠাৎ টেলিফোন মিস্ত্রি আমাকে উঠিয়ে জাগিয়ে তুলে বলেন, প্রেসিডেন্ট সাহেব আপনাকে ডাকছেন। সময় তখন ভোর সাড়ে ৪টা কী ৫টা। চারদিকে আকাশ ফর্সা হয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধু ফোনে আমাকে বললেন, সেরনিয়াতের বাসায় দুষ্কৃতকারী আক্রমণ করেছে। আমি জলদি পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ফোন করলাম। অনেক চেষ্টার পরও লাইন পাচ্ছিলাম না। তারপর গণভবন এক্সচেঞ্জে লাইন লাগানোর চেষ্টা করলাম। বঙ্গবন্ধু ওপর থেকে নিচে নেমে এলেন। আমার কাছে জানতে চাইলেন পুলিশ কন্ট্রোল রুমে কেউ ফোন ধরছে না কেন? আমি ফোন ধরে হ্যালো হ্যালো বলে চিৎকার করছিলাম। বঙ্গবন্ধু আমার হাত থেকে রিসিভার নিয়ে বললেন আমি প্রেসিডেন্ট বলছি। এ সময় দক্ষিণ দিকের জানালা দিয়ে একঝাঁক গুলি এসে ওই কক্ষের দেয়ালে লাগল। তখন অন্য ফোনে চিফ সিকিউরিটি মহিউদ্দিন কথা বলার চেষ্টা করছিলেন। গুলির তান্ডবে কাঁচের আঘাতে আমার ডান হাত দিয়ে রক্ত ঝরতে লাগল। জানালা দিয়ে আসা অনর্গল গুলি থেকে বাঁচতে বঙ্গবন্ধু শুয়ে পড়লেন। আমিও শুয়ে পড়ি। কিছুক্ষণ পর সাময়িকভাবে গুলি বন্ধ হলে বঙ্গবন্ধু উঠে দাঁড়ান। উপর থেকে কাজের ছেলে সেলিম ওরফে আবদুল বঙ্গবন্ধুর পাঞ্জাবি ও চশমা নিয়ে আসে। সেগুলো পরে বঙ্গবন্ধু বারান্দায় দাঁড়ান। বঙ্গবন্ধু চিৎকার করে বলেন- আর্মি সেন্ট্রি, পুলিশ সেন্ট্রি এত গুলি চলছে তোমরা কী কর? এ সময় শেখ কামাল বলল, ‘আর্মি ও পুলিশ ভাই আপনারা আমার সঙ্গে আসুন। কালো পোশাক পরা একদল লোক এসে শেখ কামালের সামনে দাঁড়াল। আমি (মোহিতুল) ও ডিএসপি নূরুল ইসলাম খান শেখ কামালের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। নূরুল ইসলাম পেছন দিক থেকে টান দিয়ে আমাকে তার অফিস কক্ষে নিয়ে গেল। আমি ওখান থেকে উঁকি দিয়ে বাইরে দেখতে চেষ্টা করলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে আমি গুলির শব্দ শুনলাম। এ সময় শেখ কামাল গুলি খেয়ে আমার পায়ের কাছে এসে পড়লেন। কামাল ভাই চিৎকার করে বললেন, আমি শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল, ভাই ওদেরকে বলেন।’ মোহিতুল ইসলাম এজাহারে বলেন, ‘আক্রমণকারীদের মধ্যে কালো পোশাকধারী ও খাকি পোশাকধারী ছিল। এ সময় আবার আমরা গুলির শব্দ শোনার পর দেখি ডিএসপি নূরুল ইসলাম খানের পায়ে গুলি লেগেছে। তখন আমি বুঝতে পারলাম আক্রমণকারীরা আর্মির লোক। হত্যাকা-ের জন্যই তারা এসেছে। নূরুল ইসলাম যখন আমাদের রুম থেকে বের করে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছিলেন তখন মেজর বজলুল হুদা এসে আমার চুল টেনে ধরল। বজলুল হুদা আমাদের নিচে নিয়ে গিয়ে লাইনে দাঁড় করাল। কিছুক্ষণ পর নিচে থেকে আমরা বঙ্গবন্ধুর উচ্চকণ্ঠ শুনলাম। বিকট শব্দে গুলি চলার শব্দ শুনতে পেলাম আমরা। শুনতে পেলাম মেয়েদের আত্মচিৎকার, আহাজারি। এরই মধ্যে শেখ রাসেল ও কাজের মেয়ে রুমাকে নিচে নিয়ে আসা হয়। রাসেল আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘আমাকে মারবে না তো।’ আমি বললাম, ‘না তোমাকে কিছু বলবে না।’ আমার ধারণা ছিল অতটুকু বাচ্চাকে তারা কিছু বলবে না। কিছুক্ষণ পর রাসেলকে তার মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে রুমের মধ্যে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এরপর মেজর বজলুল হুদা বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের গেটে দাঁড়িয়ে থাকা মেজর ফারুককে বলে, ‘অল আর ফিনিশড।’ সত্যিই কি ফিনিশড? না, বরং বঙ্গবন্ধুর দেহ চলে গেছে ঠিকই। কিন্তু তা নীতি-আদর্শ উজ্জীবিত হয়েছে নতুন মোড়কে, নতুন উদ্যোমে। ॥ তিন ॥ স্মৃতিচারণ প্রসঙ্গে ফিরে আসি। দলীয় কোন্দলের জেরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহাম্মদ মুহসীন হলে কোহিনুরসহ ৭ ছাত্রলীগ নেতাকে গুলি করে হত্যা করা হয় ১৯৭৪ সালের ৪ এপ্রিল। মাহবুব উদ্দিন বীর বিক্রম ছিলেন তখন ঢাকার পুলিশ সুপার। হত্যাকান্ডের রহস্য উদ্ঘাটন করতে গিয়ে তিনি দেখলেন, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম প্রধান নিজে এই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে। বিষয়টি তিনি (মাহবুব উদ্দিন) তৎকালীন অতিরিক্ত আইজিপি (এসবি) ই এ চৌধুরীকে অবহিত করলে তাৎক্ষণিক তা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীকে জানানো হয়। বঙ্গবন্ধু তখন মস্কোতে চিকিৎসাধীন। বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত ও ঘনিষ্ঠ এই সহচর (মনসুর আলী) সাহসিকতার সঙ্গে পুরো পরিস্থিতি মোকাবেলা করেন। সিনিয়র কেবিনেট কলিগের সঙ্গে পরামর্শ করে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকসহ অন্য নেতাকর্মীদের গ্রেফতারের উদ্যোগ নেন তিনি। যে পরিকল্পনা, সেই কাজ। হত্যার পরদিনই (৫ এপ্রিল) শফিউল আলম প্রধানকে গ্রেফতার করা হয় ঢাকা কলেজের বিপরীতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের নিচে ‘সীতারাম মিষ্টান্ন ভান্ডার’ থেকে। পর্যায়ক্রমে অন্য আসামিরাও গ্রেফতার হয়। সে সময় পাবনা জেলা ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে আমিই প্রথম বিবৃতি দিয়ে এই সাহসী পদক্ষেপের জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানাই। পরে রাজশাহী জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নুরুল ইসলাম ঠান্ডু ও সাধারণ সম্পাদক মফিজ উদ্দিনও আমার পথে হাঁটে। প্রধানকে গ্রেফতারে অভিনন্দন জানানোয় মনিরুল হক চৌধুরীর নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ পাবনা জেলা ছাত্রলীগের কমিটিকে বিলুপ্ত করে; যা পরদনি ‘দৈনিক বাংলার বাণী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। চিকিৎসা শেষে বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে এলে তাকে সব ঘটনা জানানো হয়। পুরো বিষয়টি জানার পর ছাত্রলীগ নেতাকে গ্রেফতারের জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সিনিয়র মন্ত্রীদের সাধুবাদ জানান বঙ্গবন্ধু। শুধু তাই নয়, সে সময় প্রধানের মুক্তি দাবিতে অনশনরত ছাত্রলীগ কর্মীদের আধা ঘণ্টার মধ্যে অনশন ভাঙার নির্দেশ দেন। অনশন না ভাঙলে গ্রেফতারের হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন তিনি। বাধ্য হয়ে তারা অনশন ভাঙেন। অবশ্য জিয়াউর রহমান ক্ষমতাসীন হওয়ার পর দন্ডপ্রাপ্ত এই শফিউল আলমকে মুক্তি দিয়েছিলেন। তার পরবর্তী রাজনৈতিক জীবন তো সবারই জানা। এদিকে আমার জেলা ছাত্রলীগ কমিটি বিলুপ্ত হওয়ায় স্বাভাবিকভাবে ক্ষুব্ধ ছিলাম। বিষয়টি সরাসরি বঙ্গবন্ধুকে জানানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। প্রায় একমাস পর অর্থাৎ চুয়াত্তরের মে মাসে প্রথম সপ্তাহে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাত পেলাম। যাতে সহায়তা করলেন শ্রদ্ধেয় এম মনসুর আলী। বঙ্গবন্ধু সেদিন রমনা পার্কের গেট ও বেইলী রোডের মুখে অবস্থিত রাষ্ট্রীয় ভবন ‘সুগন্ধা’য় অবস্থান করছিলেন। আমরা সেখানে সকাল ৯টায় পৌঁছি। তোফায়েল আহমেদ তখন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব। বলে রাখা ভাল, দেশে তখন তথাকথিত মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ চলছিল। সেই দুর্ভিক্ষকে ঘিরে জাহাজযোগে দেশ-বিদেশ থেকে ত্রাণ আসছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র থেকে ত্রাণ নিয়ে আসা দুটি জাহাজ ডুবে যাওয়ায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন বঙ্গবন্ধু। এটা আন্দাজ করতে পেরেই তোফায়েল আহমেদ সেদিন কথা না বলার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। আমরাও চলে আসতে উদ্যত হই। ঠিক তখনই বঙ্গবন্ধু আমাদের ডাক দেন। তিনি তখন বারান্দায় থাকা বেতের চেয়ারে বসে পত্রিকা পড়ছিলেন। যাই হোক, আমরা বঙ্গবন্ধুর কাছে এগিয়ে গেলাম। তিনি আমাদের দেখে প্রথমেই বলেন- ‘ষড়যন্ত্র আর ষড়যন্ত্র। আমার মনটা খুবই খারাপ, পিএল ৪৮০’র অধীনে চট্টগ্রাম অভিমুখে আগমনরত দুটি গমভর্তি জাহাজ একই সময়ে ভারতের বোম্বাই উপকূলে সমুদ্র গর্ভে ডুবে গেছে। আমি কি এ ষড়যন্ত্র বুঝি না? দেশের উত্তরাঞ্চলে খাদ্য সঙ্কট চলছে, এই সময় একত্রে দুটি জাহাজডুবি আমার সরকারকে বিপদের সম্মুখীন করা।’ অত্যন্ত আবেগতাড়িত হলেন বঙ্গবন্ধু। একজন বীর দেশপ্রেমিকের কণ্ঠে এ কথা শুনে আমরা আমাদের অভিযোগ থেকে দূরে থাকব বলে সিদ্ধান্ত নিই। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তো নিজ কর্মীদের বুঝতে পারেন, তিনি ছাড়লেন না। আসার মূল কারণ জানতে চাইলেন। পরে কমিটি বিলুপ্ত হওয়ার খবরটি তাকে সবিস্তারে জানাই। বঙ্গবন্ধু রাগান্বিত কণ্ঠে বলে উঠলেন- ‘ছাত্রলীগ কার?’ হতবিহ্বল অবস্থায় বললাম, আপনার। তিনি আমাদের বললেন- তোরা পাবনায় ফিরে যা এবং স্বাভাবিক কাজকর্ম কর। আমি দেখব কে তোদের বিরত করে? বলা বাহুল্য, এরপর আমাদের জেলা ছাত্রলীগের কার্যক্রমে আর কোন বাঁধা আসেনি। সে ধারবাহিকতায় পাবনা জেলা যুবলীগের সভাপতিও হয়েছিলাম আমি। ১৯৭৫ সালের জুন মাসে বাকশাল গঠন হয়। উদ্দেশ্য ছিল- দল-মত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মানুষের অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান ও চিকিৎসা নিশ্চিত করা। বলা যায় আর্থ-সামাজিক মুক্তিই ছিল এর উদ্দেশ্য। এ লক্ষ্যে প্রথমে বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটি ও পরে জেলা গভর্নরসহ জেলা কমিটিগুলো গঠিত হয়। বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য হওয়ায় তিনি আমাকেও এর সদস্য করেন। পদায়ন করেন পাবনা জেলা বাকশালের যুগ্ম-সম্পাদক হিসেবে। সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ছিলেন এখানকার সাধারণ সম্পাদক। বঙ্গবন্ধু স্ব-হস্তে প্রণয়ন করেছিলেন এই কমিটির তালিকা, পরে বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীর মুখে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক আমার নামটি লেখার গল্প শুনেছিলাম। এর চেয়ে বড় পাওয়া কী হতে পারে? চলবে...
×