ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শাহরিয়ার কবির

কাশ্মীর কোন্ পথে

প্রকাশিত: ০৮:৫৩, ২৬ আগস্ট ২০১৯

 কাশ্মীর কোন্ পথে

॥ তেরো ॥ কাশ্মীরের ইসলামপন্থীদের ২৬টি সংগঠনের রাজনৈতিক মোর্চা ‘অল পার্টি হুরিয়াত কনফারেন্সে’র শরিকদের সবার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এক নয়। জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম কনফারেন্স যেমন হরকত-উল মুজাহিদীনদের সশস্ত্র তৎপরতা বৃদ্ধির পক্ষে, উমর ফারুখের আওয়ামী এ্যাকশন পার্টি, আব্বাস আনসারীর ইত্তেহাদুল মুসলেমীন, শেখ আবদুল আজিজের আওয়ামী লীগ অপেক্ষাকৃত নমনীয় নীতি অনুসরণের পক্ষে। হুরিয়াতের অন্যতম শক্তিশালী সদস্য জেকেএলএফ প্রথমে জঙ্গীনীতি অনুসরণ করলেও পরে কিছুটা নমনীয় হয়েছে। একইসঙ্গে স্বাধীন, ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থান থেকে সরে গিয়েছে পাকিস্তানের দিকে। এসব ভিন্নমুখী দলকে এক জায়গায় রাখতে গিয়ে তরুণ মীর ওয়াইজ উমর ফারুখকে কম বেগ পেতে হয়নি। যখনই বিরোধ তীব্র হয়েছে- এই তরুণ নেতা সবাইকে আলোচনায় বসিয়েছেন। বর্তমানে জামায়াতে ইসলামীর সৈয়দ আলী শাহ গিলানী হুরিয়াতের সভাপতি হওয়াতে কাশ্মীরে জঙ্গী তৎপরতা বেড়েছে। জেকেএলএফ হুরিয়াতের সঙ্গে থাকলেও দলীয় তৎপরতা বৃদ্ধি করেছে। দলের অপেক্ষাকৃত তরুণ সভাপতি ইয়াসিন মালিক তখন শ্রীনগরে ছিলেন না। সেবার দলের অন্য নেতাদের সঙ্গে কথা হয়েছে। এই দলের মুখপাত্র বশীর আহমেদ ভাট আমাকে বলেছেন, ‘কাশ্মীরের সমস্যা হচ্ছে আমাদের অতিথিপরায়ণতা। যখনই বাইরে থেকে অতিথি এসেছে, আমরা তাদের বুকে তুলে নিয়েছি। পরে এই অতিথিরাই আমাদের বুকে ছুরি মেরেছে। রসিকতা করে বললাম, ‘আমার হাতে কোন ছুরি নেই।’ মধ্যবয়সী জেকেএলএফ নেতা আবেগমিশ্রিত কণ্ঠে বললেন, ‘আপনি এসেছেন এতে আমরা আনন্দিত। আপনার মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষ আমাদের দুর্ভোগের কথা জানবে, আন্দোলনের কথা জানবে। আমাদের জন্য এটা কম কথা নয়।’ ১৯৮৯ থেকে জঙ্গী মৌলবাদীদের সন্ত্রাসী তৎপরতার কারণে শ্রীনগরে বিদেশী পর্যটক নেই বললেই চলে। হোটেল আর হাউসবোটগুলো ফাঁকা পড়ে আছে। একজন বহিরাগত দেখলে বিশ-পঁচিশজন এসে তাকে ছেঁকে ধরছে গাইড চাই কি-না, শিকারায় ঘুরে বেড়াবে কি-না, শাল বা চামড়ার জিনিসপত্র কিনবে কি-না এসব জানবার জন্য। ইত্তেহাদুল মুসলেমীনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও প্রধান পৃষ্ঠপোষক হোজ্জাতুল ইসলাম মাওলানা মোহাম্মদ আব্বাস আনসারীর সঙ্গে শ্রীনগরে আসার পর তিন দফা আলোচনা হয়েছে। অতি অমায়িক, কাশ্মীরের শিয়া সম্প্রদায়ের এই নেতা থাকেন পুরনো শহরের নাওয়াই কাদেলের খানকায়ে শোকতার কাছে এক গলিতে। তাদের দলের তরুণ নেতা জহুর আহমেদ হুরিয়াত কনফারেন্সের প্রেস সম্পাদক। জহুর ঠিকানা বলে দিয়েছিল। তারপরও আমার গাড়ির ড্রাইভার সুলতানকে ঠিকানা খুঁজে বের করতে এক ঘণ্টারও বেশি সময় লেগেছে। সুলতান বিব্রত হয়ে বলেছে, পুরনো শহরে গাড়ি নিয়ে আসা হয় না। শ্রীনগরের পুরনো শহরের বাড়িগুলো ইট বা পাথরের বানানো, মেঝে কাঠের, ওপরের ছাদ টিনের। ধনীদের বাড়ির ছাদ টালির কিংবা পাকা হলেও বানানো হয়েছে চারচালা বা আটচালা টিনের ঘরের মতো, যাতে শীতকালে বরফ না জমতে পারে। শ্রীনগর তিন হাজার বছরেরও বেশি পুরনো শহর। ঐতিহাসিক কলহনের মতে খ্রিস্টপূর্ব ১১৮২ অব্দে সম্রাট অশোক শ্রীনগরের জনবসতির পত্তন করেন। পুরনো শহরে কোন গাছপালা নেই। বাড়িগুলো প্রায় সবই একটার গায়ে আরেকটা লাগানো, বাইরের দেয়ালে বেশির ভাগই পলেস্তারা দেয়া হয়নি। কাঠের জানালাগুলো ছোট ছোট। কোন কোন বাড়ির সামনে খানিকটা রোয়াকের মতো, তরুণরা বসে জটলা করছে কিংবা ছয়-সাতজন চুপচাপ বসে আছে, চেহারায় বিষণ্ণতা আর হতাশার ছাপ। পুরনো শহরে ভিখিরিও চোখে পড়েছে। বোরকা পরা বৃদ্ধার সামনে রেহেলে রাখা কোরান শরিফ। তরুণী ভিখিরি সারা শরীর কালো বোরকায় ঢাকা, নেকাব তোলা চেহারায় কাশ্মীরের স্বর্গীয় লাবণ্য। অল্পবয়সী বালকরা কোথাও রাস্তার পাশে ম্লান মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কোথাও দেয়াশলাই বা ছোটখাটো জিনিস ফেরি করছে। বালক, তরুণ, যুবা, প্রৌঢ়, বৃদ্ধ সবার মুখেই বিষণ্ণতার ছায়া। নতুন শহরের নামী-দামী স্কুলে ছেলেমেয়েরা ছাড়া কম বয়সীদের ভেতর উৎফুল্ল, সজীব চেহারা তখন খুব কমই দেখেছি। অথচ শ্রীনগরের ভুবনখ্যাত নৈসর্গিক সৌন্দর্য অটুট রয়েছে। বিষণ্ণতার নেকাব সরিয়ে নিলে নারীপুরুষ নির্বিশেষে কাশ্মীরীরা নিঃসন্দেহে উপমহাদেশের সবচেয়ে লাবণ্যময় ও সুদেহী গোত্রের ভেতর পড়বে। মাওলানা আব্বাস আনসারীর বাড়ি পর্যন্ত গাড়ি নেয়া যায়নি। কোথাও গলি এত সরু যে দুজন মানুষ পাশাপাশি হাঁটতে পারবে না। মাওলানা সাহেবের বাড়ির সামনে অবশ্য রাস্তা খানিকটা প্রশস্ত, লোহার গেটও প্রশস্ত, ভেতরে গাড়ি রাখার জায়গা আছে। পরে সুলতান আবিষ্কার করেছে গাড়ি নিয়ে অন্য রাস্তা দিয়ে আসতে হয় এখানে। নাওয়াই কাদেলের বিবর্ণ কাঠ-পাথরের বাড়িগুলোর ভেতর মাওলানা আনসারীর বাড়িটা একটু বেমানানই মনে হয়। ভেতরে বাইরে ঝকঝকে রং করা, লোহার গেট দিয়ে ঢুকলেই গাড়ি বারান্দা। সরু সিঁড়ি উঠে গেছে বৈঠকখানার দিকে। ঘরজুড়ে শতরঞ্জি বিছানো, দেয়ালে আয়াতুল্লাহ খোমেনীসহ ইরানী নেতাদের ছবি। প্রথম দিন মাওলানা আনসারীর সঙ্গে সাধারণভাবে তার দল সম্পর্কে এবং কাশ্মীরের পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোচনা করেছি। দ্বিতীয় দিন কথা ছিল, ভিডিওতে তার বক্তব্য রেকর্ড করব। যথাসময়ে গিয়ে শুনি তিনি বাড়িতে নেই। শহরের বাইরে কোথায় শিয়া-সুন্নি দাঙ্গা হয়েছে, তিনি সেখানে গেছেন। দুই ঘণ্টা বসে থেকেও সেদিন তাঁর দেখা পাইনি। তিনি না থাকলেও আপ্যায়নের কোন ত্রুটি ছিল না। কাশ্মীরী চায়ের সঙ্গে কেক আর কয়েক রকমের বিস্কুট ছিল। কাশ্মীরে তন্দুরির খাবারের প্রচলন বেশি। চায়ের সঙ্গে জনপ্রিয় খাবার হচ্ছে তিলের প্রলেপ দেয়া এক ধরনের বনরুটি, বেশ উপাদেয় খেতে। অন্তঃপুর সংলগ্ন বৈঠকখানার দরজা পর্দায় ঢাকা। পর্দার আড়ালে থেকে একজন অন্তঃপুরবাসিনী খাওয়ার তদারক করছিলেন। মাওলানা সাহেবের গ্রাম থেকে আসা এক কর্মী আপ্যায়ন করছিল। বয়স ছাব্বিশ-সাতাশ হবে, মুখে চাপদাড়ি, নাম গুল মোহাম্মদ। বলল, ব্যবসা করে, শাল বোনার। গুল মোহাম্মদ গ্রামের লোকদের দিয়ে শালের ওপর হাতের কাজ করায়। কাজের ঘনত্ব অনুযায়ী একজন কারিগর মাসে দু/তিনটা শাল করতে পারে। তবে সূক্ষ্ম ভরাট কাজ হলে একটা শালের ওপর কাজ করতে ছয় মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত সময় দরকার। গুল মোহাম্মদ যে ধরনের শাল বিক্রি করে তার জন্য কারিগরদের দেয় পাঁচ/ছয় শ’ টাকা। সারা মাসে শাল বিক্রি করে ওর লাভ হয় পাঁচ/ছয় হাজার টাকা। একজন কারিগর মাসে দুটো শাল বুনে যে টাকা পায় তাতে কি ওর সংসার চলে? গুল মোহাম্মদ বলল, শুধু শাল বুনে সংসার চালানো কঠিন। অনেকের ফলের বাগান অথবা চাষের জমি আছে। কাশ্মীরের আপেল, আঙুর, নাশপাতি, আখরোট, বাদাম সারা ভারতে বিখ্যাত। হোটেলে যেখানেই খেয়েছি অতি সুগন্ধী বাসমতি চালের ভাত প্রাণ জুড়িয়ে দেয়। মাওলানা আনসারীর সঙ্গে দেখা হয়েছে পরদিন সকালে। খুবই দুঃখ প্রকাশ করলেন গ-গোলে আটকে যাওয়ার জন্য। বললেন, দাঙ্গায় একজন শিয়া মারা গেছেন। তার শেষকৃত্য সেরে ফিরতে রাত হয়েছে। তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, শিয়া-সুন্নি দাঙ্গা কি প্রায়ই হয়? মাওলানা আনসারী বলেছেন, ‘আগে প্রায়ই হতো। আপনি তো জানেন, ব্রিটিশ আমল থেকেই শাসকরা কখনও হিন্দু-মুসলমান, কখনও শিয়া-সুন্নি; কখনও অন্য মাজহাবের ভেতর দাঙ্গা-ফ্যাসাদ লাগিয়ে নিজেদের গদি নিরাপদ রেখেছে। আমার ব্রত হচ্ছে এসব সাম্প্রদায়িক হানাহানি বন্ধ করে সকল কাশ্মীরীকে স্বাধীনতার জন্য ঐক্যবদ্ধ করা। তাঁকে বললাম, ‘সকল কাশ্মীরীকে স্বাধীনতার জন্য আপনারা কোথায় পাচ্ছেন? পাকিস্তানের দখলে রয়েছে কাশ্মীরের এক তৃতীয়াংশ। তাদের নেতা সরদার আবদুল কাইয়ুম খান বলেছেন, কাশ্মীরকে ভারতের কবজা থেকে মুক্ত করে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত করবেন। আপনাদের হুরিয়াতেও অনেকে তাই মনে করেন। অথচ আপনাদের মুখ্যমন্ত্রী ফারুখ আবদুল্লাহ, যিনি জম্মু-কাশ্মীরের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দলের প্রধান- মনে করেন ইতিহাস যা নির্ধারণ করে দিয়েছে কাশ্মীরের জন্য, সেটা মেনে নেয়াটাই হচ্ছে কাশ্মীরীদের জন্য মঙ্গলজনক।’ মাওলানা আব্বাস আনসারী শান্ত গলায় বললেন, ‘স্বাধীনতাকামী কাশ্মীরীদের প্রতিনিধিত্ব একমাত্র আমরাই করি। সরদার কাইয়ুম বা ফারুখ আবদুল্লাহ যদি কাশ্মীর সমস্যা সংক্রান্ত আলোচনার টেবিলে বসতে চান, তাঁদের বসতে হবে পাকিস্তান ও ভারতের পক্ষে। স্বাধীনতাকামী কাশ্মীরীদের পক্ষে কথা বলার কোন অধিকার তাদের নেই।’ ‘হুরিয়াতের বর্তমান চেয়ারম্যান আলী শাহ গিলানীর দল জামায়াতে ইসলামীই তো মনে করে সমগ্র্র কাশ্মীর পাকিস্তানের অংশ হওয়া উচিত।’ ‘সেটা তাদের দলীয় চিন্তা হতে পারে। কুল জামাত হুরিয়াত কনফারেন্স তা মনে করে না।’ ‘আপনি স্বাধীনতার কথা বলেছেন, কিন্তু হুরিয়াতের অন্য শরিকরা স্পষ্টভাবে স্বাধীনতার কথা তো বলছেন না। তাঁরা বলছেন আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আদায়ের কথা।’ ‘আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের অর্থ- কাশ্মীরী জনগণই নিজেদের ভাগ্য স্থির করবে। তারা পাকিস্তানের সঙ্গে থাকবে, না ভারতের সঙ্গে থাকবে, না পরিপূর্ণ স্বাধীন থাকবে- এটা হতে হবে গণভোটের মাধ্যমে।’ ‘গণভোট কে পরিচালনা করবে? কাশ্মীরের একটি অংশ পাকিস্তানের দখলে, অপর অংশ ভারতের। গণভোটের জন্য কোন দেশের সংবিধান আপনারা মানবেন?’ ‘পদ্ধতি আমরা নির্ধারণ করব পাকিস্তান ও ভারতের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় আলোচনায় বসে। গণভোট জাতিসংঘে তত্ত্বাবধানে হতে পারে।’ ‘শাবির শাহ্র ডেমোক্র্যাটিক ফ্রিডম পার্টির নেতারা বলেছেন, এনজিওদের তত্ত্বাবধানেও হতে পারে।’ ‘আগে গণভোটের অধিকার তো আদায় করি! তারপর দেখা যাবে কিভাবে গণভোট হবে।’ ‘আপনি আলোচনার কথা বলছেন, অথচ আপনাদের হুরিয়াত কনফারেন্স মুজাহিদীনদের জঙ্গী তৎপরতাকে উৎসাহিত করছে। জঙ্গীদের তৎপরতা অব্যাহত থাকলে আলোচনা কীভাবে সম্ভব?’ ‘জঙ্গী তৎপরতার জন্য আমরা দায়ী নই। ’৮৭ সালের নির্বাচনের পর যখন আমরা বুঝেছি ব্যালটের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয় তখনই বুলেটের আশ্রয় নিতে হয়েছে। সিন্দুক ভরে ভোট দিয়েছি, কাজ হয়নি তাই বন্দুক তুলে নিয়েছি। এটা অন্যায় কিছু নয়। আলোচনার জন্য সামরিক ও রাজনৈতিক চাপ দুইই দরকার।’ (ক্রমশ.)
×