ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মোঃ সাহাবুদ্দিন চুপ্পু

বঙ্গবন্ধুকে আমি যেমন দেখেছি

প্রকাশিত: ১২:০৩, ২৫ আগস্ট ২০১৯

বঙ্গবন্ধুকে আমি যেমন দেখেছি

৮ এপ্রিল ১৯৬৬। দুপুর বেলা। দেড় কি পৌনে দুটো বাজে। পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রব বগা মিয়ার বাসায় এলেন বঙ্গবন্ধু। উদ্দেশ্যÑ ৬ দফার প্রচারণা জনসভায় যোগ দেবেন, তার আগে দুপুরের জল-খাবার। যতটুকু দেখেছি ও জেনেছিÑ ছয় দফাকে স্বাধীনতার সিঁড়ি ভাবতেন জাতির পিতা। বলতেন- ‘ছয় দফায় যে পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে পাঁচ কোটি শোষিত-বঞ্চিত আদম সন্তানের কথাই প্রতিধ্বনিত হইয়াছে, তাতে আমার কোন সন্দেহ নেই।’ অধিকার আদায়ের এ চিন্তা থেকেই ৬ দফার আন্দোলন দেশব্যাপী প্রচার করতে শুরু করেন বঙ্গবন্ধু। সেই ধারাবাহিকতায় পাবনায় (টাউন হল) সমাবেশ করতে আসা। চাচায় বাসায় আসছে বিধায় জাতীয় নেতা বঙ্গবন্ধুকে দেখতে গেলাম। বিশেষ সাক্ষাতের সুযোগ হলো। বগা চাচা বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহকর্মী এম মনসুর আলী, এম এইচ কারুজ্জামানসহ অন্য নেতাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। বঙ্গবন্ধু তার স্বভাবসুলভ আদরের ‘তুই’ সম্বোধন করে বেশ কিছু দিক-নির্দেশনা দিলেন। সর্বশেষ বললেনÑ ‘মাঠে (সভাস্থল) আয়।’ উপস্থিত জেলা ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ আকবর মজিদ, শফিকুল আজিজ মুকুল, আব্দুস ছাত্তার লালুদেরও বললেনÑ আমাকে যেন সভাস্থলে নিয়ে যায়। সদ্য এসএসসি পাস করেছি, পরিচয়ে তখনও কলেজের তকমা পাইনি। রাজনীতির কতটুকুই বা বুঝি? কিন্তু ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি দীর্ঘদেহী এই মানুষটির স্নেহমাখা ‘মাঠে আয়’ স্বরে কী যেন লুকিয়ে ছিল। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিলাম- কেউ না নিলেও একা একা জনসভায় যাব। কিন্তু সেটি আর করতে হলো না। সবার সঙ্গেই টাউন হলে গেলাম। বঙ্গবন্ধু ও কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের বক্তৃতা শুনলাম। হঠাৎ খেয়াল করলাম, মনের অজান্তেই মুগ্ধ শ্রোতা থেকে গগণবিদারী স্লোগানদাতা হয়ে গেছি। মাধ্যমিকেই বঙ্গবন্ধুর প্রতি অনুপ্রাণিত ছিলাম। কিন্তু ঘণ্টাখানেকের ব্যবধানে আমি যেন তাঁর ছাত্রলীগের অন্যতম সক্রিয় কর্মী। সেই সক্রিয় প্রবেশ কিছুক্ষণ আগেই বঙ্গবন্ধুর ‘মাঠে আয়’ নির্দেশের মধ্য দিয়ে ঘটল। মূলত রাজনীতিতে আমারা সক্রিয় ভাবটা ওই মুহূর্ত থেকেই। এরপর আর পেছনে তাকাইনি। তাকাতে হয়নি। কয়েক মিনিটের সাক্ষাতে পিতা মুজিব যেভাবে রাজনৈতিক অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন; সেটাই যে আমাকে এডওয়ার্ড কলেজ ছাত্রলীগের জিএস, অবিভক্ত পাবনা জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি এবং জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে ছয় বছর দায়িত্ব পালনে উৎসাহ যুগিয়েছে; তাতে কোন সন্দেহ নেই। পাবনার সেই আটই এপ্রিল ১৯৬৬’র পর বেশ কয়েকবার নাতিদীর্ঘসময় বঙ্গবন্ধুর সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয়েছে। যতবার দেখা হয়েছে, ততবারই তার কাছ থেকে নতুন কিছু শিখেছি। বঙ্গবন্ধু চলে গেছেন ৪৪ বছর আগে। দীর্ঘ এ সময়ে স্বৈরশাসন, বিএনপি-জামায়াতের দুঃশাসন এবং ওয়ান ইলেভেন এসেছে। রাজনৈতিক জীবনেও অনেক উত্থান-পতন দেখেছি, কত কিছু শিখেছি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সংস্পর্শে থাকার সেই মুহূর্তগুলো ভুলতে পারিনি। জীবদ্দশায় পারবও না। এগুলো আমার কাছে জীবন চলার ‘ফুয়েল’। ‘সেই ফুয়েল’ আজও আমাকে শক্তি জোগায়। শক্তি দেয় এ কারণে যে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ আজও বাংলাদেশসহ বিশে^র কোটি কোটি মানুষ ধারণ করে। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের উন্নয়নে যে স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন, কন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরে সেই স্বপ্ন আজ বাস্তবায়িত হচ্ছে। সাত দশকে পা দেয়া আওয়ামী লীগের হাত ধরে দেশ উঠেছে উন্নয়নের মহাসড়কে, পৌঁছেছে স্বল্প উন্নয়নের দেশ থেকে উন্নয়নশীলে। ইতিহাস সেরা প্রকল্প পদ্মা সেতু হচ্ছে, দুর্বার গতিতে মেট্রোরেলসহ বড় বড় প্রকল্প। সবমিলিয়ে বলা যায়, শেখ হাসিনার হাত ধরে অনেকটাই এগিয়ে গেছে দেশ। এখন উচিতÑ দল-মতো নির্বিশেষে বাংলাদেশের সেই উন্নয়নকে সর্বাঙ্গীণ দৃষ্টিকোণ থেকে এগিয়ে নেয়া। শেখ হাসিনার পতাকাতলে সমাবেত হওয়া। ॥ দুই ॥ স্বাধীনতার পর কয়েকবার বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সম্মুখ সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছিল আমার। যার একটি ঘটনা আজও আমাকে অনুপ্রেরণা দেয়। সালটা ১৯৭২, ফেব্রুয়ারি মাস। বন্যা কবলিত মানুষকে বাঁচাতে পাবনার কাশিনাথপুর/নগরবাড়ীতে ‘মুজিববাঁধ’ উদ্বোধন করতে আসেন তিনি। আমি তখন জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি। যথারীতি জনসভার আয়োজন হলো। স্বাগত বক্তব্যের দায়িত্ব পড়ল আমার ওপর। বক্তৃতা দিলাম। ডায়াস থেকে যখন মুখ ঘুরিয়ে চলে যেতে উদ্যত হয়েছি, ঠিক তখনই বঙ্গবন্ধু আমার হাত ধরে ফেললেন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দাঁড়িয়ে গিয়ে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। কপালে চুমু এঁকে বললেনÑ ‘তুই তো ভাল বলিস’। বঙ্গবন্ধুর বুকে লেপ্টে আছি; কী বলব কী বলা উচিত, বুঝতে পারছিলাম না। মুহূর্তের জন্য হতবিহ্বল হয়ে গেলাম। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম জাতির পিতার দিকে। পরে দুই-একটি কথা বলে স্টেজের সাইডে গেলাম। পরে এই ভেবে উৎসাহী হলাম যে, মাত্র ১৮মিনিট বক্তৃতায় যিনি সাত কোটি মানুষকে এক সুতোয় গেঁথেছিলেন, লাখ লাখ মানুষকে রাস্তায় নামিয়েছেন; সেই মানুষটি যখন আমার ভাষণের প্রশংসা করলেন, তখন সেটা নিঃসন্দেহে ছোট ব্যাপার নয়। বঙ্গবন্ধুকে ‘গার্ড অব অনার’ প্রদানের মধ্য দিয়ে যথারীতি অনুষ্ঠান শেষ হলো। বঙ্গবন্ধু হেলিকপ্টারে উঠতে যাচ্ছেন, এমন মুহূর্তে আমার কাছে জানতে চাইলেন- ঢাকা যাব কি-না? আগে-পাছে চিন্তা না করে রাজি হয়ে গেলাম। প্রথমবারের মতো হেলিকপ্টার ভ্রমণের সুযোগ হলো, তা-ও রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। ঢাকায় হেলিকপ্টার থামল পুরনো বিমানবন্দর তেজগাঁওয়ে। আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে ডাকলেন বঙ্গবন্ধু। নির্দেশ দিলেন- ‘ওকে (আমাকে) বাসায় নিয়ে খেতে দাও, তারপর খরচ দিয়ে পাবনা পাঠিয়ে দিও’। ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি সাংগঠনিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে আরেকবার পাবনা আসেন বঙ্গবন্ধু। জনসভার আয়োজন তখন স্টেডিয়ামে। জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে সেবারও বক্তৃতা দেয়ার সুযোগ হলো। বক্তৃতা শেষে বঙ্গবন্ধু ঠিক পূর্বের ন্যায় আমাকে জড়িয়ে ধরেন। মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করেন, আমি যেন ভবিষ্যতে আরও উন্নতি করি। এজন্য বলি, ১৫ আগস্ট আমার কাছে শোক দিবস তো বটেই, সেই সঙ্গে এক বিদনাবিধূর হৃদয় ভাঙার দিন। এ শোক এক দিনের নয়, অনন্তের। এ শোক শুধু বাঙালীর নয়, গোটা বিশ^বাসীর। ১৬ আগস্ট হত্যাকা-ের সংবাদ শুনে সাবেক জার্মান চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্ডেট (Willy Brandt) তো বলেই ফেললেন- ‘শেখ মুজিবকে হত্যার পর বাঙালী জাতিকে আর বিশ^াস করা যায় না।’ ফিদেল ক্যাস্ট্রো লিখলেন, শেখ মুজিবের মৃতুতে বিশ্বের শোষিত মানুষ হারাল তাদের একজন মহান নেতাকে, আমি হারালাম একজন অকৃত্রিম বিশাল হৃদয়ের বন্ধুকে। মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত এতটাই দুঃখ পেয়েছিলেন যে, আক্ষেপ করে বলেছিলেন ‘তোমরা আমারই দেয়া ট্যাঙ্ক দিয়ে আমার বন্ধু মুজিবকে হত্যা করেছ! আমি নিজেই নিজেকে অভিশাপ দিচ্ছি’। বঙ্গবন্ধু ছিলেন স্বভাব নেতা। কি শৈশব, কৈশোর কিংবা মত্ত যৌবন- সবখানেই এক কালজয়ী মহাপুরুষ ছিলেন তিনি। ইতিহাসের বাঁকঘোরানো রাজনীতিবিদ ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। বঞ্চনা, অধিকার থেকে যে জাতিকে তিনি একাত্তরে স্বাধীনতা এনে দিলেন; সেই জাতিই যে তাকে পাঁচ বছরের জীবন নিয়ে নেবেÑ সেটা কি জানতেন! কী হয়েছিল সেই ভোরে? অন্যান্য দিনের মতোই রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান ১৪ আগস্ট রাত ৮টা নাগাদ বাড়িতে (ধানমন্ডি ৩২ নম্বর) ফেরেন। খাওয়া-দাওয়া শেষে ঘুমোতে যান রাত ১২টার দিকে। বাড়ির নিচ তলার একটি কক্ষে কর্মরত ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত সহকারী এএফএম মুহিতুল ইসলাম। যিনি রাত তিনটা নাগাদ ঘুমাতে যান। চলবে...
×