ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অবকাঠামো উন্নয়ন ও ভূমি ব্যবস্থাপনার নির্ভুল ডাটাবেজ হবে

প্রকাশিত: ১১:০৭, ২৫ আগস্ট ২০১৯

অবকাঠামো উন্নয়ন ও ভূমি ব্যবস্থাপনার নির্ভুল ডাটাবেজ হবে

ওয়াজেদ হীরা ॥ দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন কার্যক্রম ও ভূমি ব্যবস্থাপনার জন্য নির্ভুল ডাটাবেজ তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এজন্য অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ডিজিটাল ভূমি জরিপ করা হবে। একইসঙ্গে সমুদ্রপৃষ্ঠের রিয়েল টাইম উচ্চতা যথাযথ নিরূপণ করতে চট্টগ্রামে হচ্ছে টাইডাল স্টেশন। সম্প্রতি এই সংক্রান্ত প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ভূপৃষ্ঠের কম্পন যথাযথভাবে পর্যবেক্ষণ এবং দুর্যোগ বিষয়ে পূর্বাভাস দিতে সক্ষম হবে। একনেক চেয়ারপার্সন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে ১১৪ কোটি ৮৯ লাখ টাকার প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়েছে। জানা গেছে, ‘জেএনএসএস কোর নেটওয়ার্ক পরিধি সম্প্রসারণ এবং টাইডাল স্টেশন আধুনিকীরণ’ নামের প্রকল্পটি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বাংলাদেশ জরিপ অধিদফতর বাস্তবায়ন করবে। এতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১১৪ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকার দেবে ১৭ কোটি ৯০ লাখ, বাকি ৯৬ কোটি ৯৯ লাখ টাকা অনুদান দেবে জাপান সরকারের উন্নয়ন সংস্থা জাইকা। এ বছরের জুলাই থেকে ’২১ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়িত করা হবে। দ্রুত শিল্পায়ন ও নগরায়ণের ফলে দেশে ভূমি ব্যবহারের ধরন পরিবর্তন হচ্ছে। একইসঙ্গে অতিবৃষ্টি, বন্যা, নদীভাঙ্গন, জলোচ্ছ্বাসসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগেও ভূমির ধরনে পরিবর্তন আসছে। এমন পরিস্থিতিতে ভূমিভিত্তিক তথ্যভা-ারসহ সারাদেশে সঠিক ডিজিটাল মানচিত্র (টপোগ্রাফিক ও থিমেটিক ম্যাপ) তৈরির উদ্যোগ নেয় জরিপ অধিদফতর। অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানান, দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে সঠিক ও নির্ভুল টপোগ্রাফিক মানচিত্রের গুরুত্ব অপরিসীম। সে লক্ষ্যে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ডিজিটাল পদ্ধতিতে আলোকচিত্র ধারণ করা হয়। পরে এসব আলোকচিত্র ব্যবহার করে টপোগ্রাফিক্যাল মানচিত্র প্রণয়ন করে জরিপ অধিদফতর। ইতোমধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী খুলনা, রংপুর ও মৌলভীবাজারে ছয়টি ‘পার্মানেন্ট গ্লোবাল নেভিগেশন স্যাটেলাইট সিস্টেম’ (জিএনএসএস) স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে ২০১১ সালে। প্রতিটি জিএনএসএস দিয়ে ৩০ কিমি ব্যাসার্ধের মধ্যে আরটিকে জিএনএসএস সার্ভে পরিচালনা করা যায়। এর চাহিদা বাড়লেও জিএনএসএস কোর নেটওয়ার্ক না থাকায় এই সেবা যথাযথভাবে দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণেই প্রকল্পের আওতায় দেশে নতুন করে আরও ৭৫ জিএনএসএস স্টেশন স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। একইসঙ্গে দেশের সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা নির্ধারণে চট্টগ্রামের আনোয়ারায় আরেকটি টাইডাল স্টেশন স্থাপন করবে অধিদফতর। জরিপ অধিদফতর সূত্র আরও জানায়, দেশের সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা নির্ধারণের জন্য বর্তমানে রাঙ্গামাটিতে একটি টাইডাল স্টেশন রয়েছে। যা দিয়ে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা যথাযথভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব হচ্ছে না। আরও একটি টাইডাল স্টেশন স্থাপন করলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা যথাযথ নির্ধারণ করা সম্ভব হবে। বিভিন্ন তথ্যসূত্রে জানা গেছে, বিশ্বব্যাপী জলবায়ুু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে সমুদ্রস্তরের উচ্চতাবৃদ্ধি দ্বারা সমুদ্রের পানির বেড়ে গিয়ে স্থলভাগ গ্রাস করে ফেলা সংক্রান্ত দুর্যোগকে বোঝায়। এই দুর্যোগ একটি বৈশ্বিক সমস্যা, যা প্রাকৃতিক এবং মানবসৃষ্ট কারণসমূহের সম্মিলিত ফল। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস এ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট (মেজর জেনারেল (অব) এএনএম মুনিরুজ্জামান এক নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তা হুমকি, বিশেষ করে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাবৃদ্ধির ফলে বৈশ্বিক শান্তি ও নিরাপত্তার ওপর যেসব ঝুঁকি তৈরি হতে পারে, তা নিয়ে বিশ্বের প্রায় সব দেশই এখন একমত। বাংলাদেশের এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়। প্রকৃতপক্ষে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির সম্মুখীন, বাংলাদেশ সেগুলোর অন্যতম। বিজ্ঞানীরা অনুমান করছেন, ২১০০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১১-৩৮ ইঞ্চি বেড়ে যেতে পারে। ইউএনএফসিসিসির তথ্যমতে, বিংশ শতাব্দীতে সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় উচ্চতা ১০-২০ সেন্টিমিটার বেড়েছে এবং ’১১ সালে নাগাদ আরও ১৮-৫৯ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বাড়তে পারে। এ বিষয়ে একাধিক গবেষণা প্রতিবেদনে বার বার ঝুঁকির কথা উঠে এসেছে। বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত তালিকায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে ঝুঁকিপূর্ণ বারো দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান দশম। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাজনিত কারণে ঢাকাও আক্রান্ত হতে পারে বলে ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড অভিমত ব্যক্ত করেছে। প্রকল্প সূত্র মতে, এর আওতায় দেশের সব জেলায় জিএনএসএস কোর্স এবং চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলায় টাইডাল স্টেশন নির্মাণ করা হবে। এতে জিএনএসএস কোর্স নেটওয়ার্ক ভূ-পৃষ্ঠের কম্পন যথাযথ পর্যবেক্ষণ এবং ভবিষ্যতে দুর্যোগের বিষয়ে পূর্বাভাস দিতে সক্ষম হবে। প্রকল্পের আওতায় জিএনএসএস কোর্স ৭৫ এবং টাইডাল এক্সেসরিজ ২ সেট কেনা হবে। সেই সঙ্গে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, সরঞ্জাম, পূর্ত কাজ, সফটওয়ার ইত্যাদিও কেনা হবে। এ বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেছেন, এটা রিয়েল টাইমে ভূ-তাত্ত্বিক মুভমেন্ট, জোয়ার-ভাটার মুভমেন্ট ইত্যাদি তাৎক্ষণিক টাইমে, অর্থাৎ এই মুহূর্তে রংপুরে, খাগড়াছড়িতে, দাকোপের অবস্থা জানা যাবে। ওই মেশিন নিজেই গ্রহণ করবে এবং বলে দেবে যে, দাকোপে একটা ভূ-কম্পন হচ্ছে, অথবা কুড়িগ্রামে পানির উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে। এটা ইতোমধ্যেই আমাদের আছে, এটাকে আরও আধুনিকায়ন করা হবে। প্রকল্পের উদ্দেশে বলা হয়েছে, দেশের অবকাঠামো পরিকল্পনা/ উন্নয়ন কার্যক্রম ও ভূমি ব্যবস্থাপনার জন্য নির্ভুল ডাটাবেজ তৈরি করতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে জরিপ করা হবে। টেক্টোনিক প্লেটের মুভমেন্ট এবং ভূমির অবনমন পর্যবেক্ষণ ও পরিমাপের মাধ্যমে সম্ভাব্য ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণে সহায়তা করা ও সমুদ্র উচ্চতার রিয়েল টাইম পর্যবেক্ষণ ও ডাটাবেজ প্রণয়ন করা হবে। প্রকল্পের ডিপিপির ওপর গত ফেব্রুয়ারিতে পরিকল্পনা কমিশনে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (পিইসি) সভা হয়। ওই সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে পরবর্তীতে এটি একনেকে পাস হয়। প্রকল্পের মতামত দিতে গিয়ে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য শামীমা নার্গিস বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ জরিপ অধিদফতর অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে নির্ভুল সার্ভে সম্পাদনের মাধ্যমে দেশের অবকাঠামো পরিকল্পনা, উন্নয়ন কার্যক্রম এমনকি ভূমি ব্যবস্থাপনাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় আরও সহায়ক ভূমিকা পালনে সক্ষম হবে।
×