ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক আঘাত থেকে সুরক্ষায় ব্যবস্থা

প্রকাশিত: ১১:০৬, ২৫ আগস্ট ২০১৯

শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক আঘাত থেকে সুরক্ষায় ব্যবস্থা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ শিক্ষার্থীদের শারীরিক আঘাত ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করা, অশালীন বা অসৌজন্যমূলক আচরণ অর্থাৎ ‘স্কুল বুলিং’ থেকে সুরক্ষা দিতে নতুন একটি নীতিমালা করতে যাচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ লক্ষ্যে আগামী এক মাসের মধ্যেই ‘স্কুল বুলিং নীতিমালা-২০১৯’ জারি করা হবে। এটি কার্যকর হলে স্কুলে অনাকাক্সিক্ষত যে কোন আইসিটি ডিভাইস বহন, ছবি তোলা, ভিডিও করা নিষিদ্ধ হবে। শিক্ষার্থীদের মূল্যবোধ শেখানোর লক্ষ্যকে সামনে রেখে হাইকোর্টের আদেশের আলোকে তৈরি হচ্ছে এ নীতিমালা। তবে এর মাধ্যমে স্কুলে ফেসবুক নিষিদ্ধ হচ্ছে বলে যে খবর ছড়িয়েছে তাকে শতভাগ ভুল তথ্য বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। হাইকোর্টের নির্দেশের প্রায় দুই বছর পর নীতিমালাটি চূড়ান্ত করতে কাজ করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ। নীতিমালা চূড়ান্ত করতে শনিবার রাজধানীর জাতীয় শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যনবেইস) ভবনে স্কুল বুলিং নীতিমালা প্রণয়ন কমিটি বিভিন্ন স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে বৈঠক করেছে। বৈঠকে নতুন নীতিমালার প্রতিটি বিষয়ে সকলেই ইতিবাচক মত দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন কমিটির আহ্বায়ক ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (মাধ্যমিক) জাবেদ আহমেদ। তিনি বলেছেন, আমরা আমাদের খসড়া নীতিমালা নিয়ে বিভিন্ন স্টেক হোল্ডারের সঙ্গে আলোচনা করেছি। তাদের মতামত নিয়েছি। আলোচনায় অংশ নিয়ে সকলেই নীতিমালার বিষয়ে শতভাগ ইতিবাচক মত দিয়েছেন। সকলেই পজেটিভ। এ মতামত পর্যালোচনা করে আগামী এক মাসের মধ্যেই চূড়ান্ত করে নীতিমালা জারি করা হবে। আমরা দ্রুত এ কাজটি করতে চাই। আদালতের নির্দেশে নীতিমালায় এটি করা হয়েছে। খসড়া নীতিমালায় স্কুল বুলিং বলতে বোঝানো হয়েছে, ‘স্কুল চলাকালীন বা শুরুর আগে ও পরে, ক্লাস রুমে, স্কুলের ভেতরে, প্রাঙ্গণে বা স্কুলের বাইরে কোন শিক্ষার্থী দ্বারা অন্য শিক্ষার্থীকে শারীরিক আঘাত করা বা মানসিক বিপর্যস্ত করা, অশালীন বা অপমানজনক নামে ডাকা, অসৌজন্যমূলক আচরণ করা, কোন বিশেষ শব্দ বার বার বলে উত্ত্যক্ত বা বিরক্ত করা’। সাধারণত স্কুলে মৌখিক, শারীরিক ও সামাজিক-এ তিন ধরনের বুলিং হয়ে থাকে। মৌখিক বুলিং হচ্ছে- কাউকে উদ্দেশ্য করে এমন কিছু বলা বা লেখা, যা খারাপ কোন কিছুর প্রতি ইঙ্গিত বহন করে। যেমন-উপহাস, খারাপ সম্বোধন বা ডাকা, অশালীন শব্দ ব্যবহার করা বা হুমকি দেয়া। শারীরিক বুলিং বলতে কাউকে আঘাত করা, হাত দিয়ে চড়-থাপ্পড় বা পা দিয়ে লাথি মারা, ধাক্কা মারা, খোঁচা মারা, ঘুষি মারা, কারও জিনিসপত্র জোর করে নিয়ে যাওয়া বা ভেঙ্গে দেয়া, মুখ বা হাত দিয়ে অশালীন বা অসৌজন্যমূলক অঙ্গভঙ্গি করা। আর সামাজিক বুলিং বলতে বোঝানো হয়েছে- সামাজিক স্ট্যাটাস, এক বা দলগত বন্ধুত্ব বা পারস্পরিক সম্পর্ক, ধর্মীয় পরিচিতি বা বংশগত অহঙ্কারবোধ থেকে কোন শিক্ষার্থীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা বা তা করতে প্ররোচিত করা বা কারও সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে বারণ করা, কারও সম্পর্কে গুজব ছড়ানো, প্রকাশ্যে কাউকে অপমান করা, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র জাত তুলে কোন কথা বলা ইত্যাদি। কিন্তু কি আছে নীতিমালায়? জানা গেছে, নীতিমালায় বুলিং প্রতিরোধের উপায় হিসেবে পারিবারিক শিক্ষা, অভিভাবক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের করণীয় নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। খসড়া নীতিমালায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের করণীয় নির্ধারণ করে বলা হয়েছে, বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের মূল্যবোধ শেখানোর দিকে বেশি নজর দিতে হবে। আইসিটি ডিভাইস বহন, ছবি তোলা, ভিডিও করা নিষিদ্ধ করার কথা বলা হয়েছে। নীতিমালায় নিয়ম ভঙ্গকারীদের জন্য শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। এমনকি নিয়ম ভঙ্গ করলে ‘টিসি’ দেয়া হবে এমন বার্তা সবার মধ্যে পৌঁছে দেয়ার কথা খসড়া নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে। তবে কোন বিষয়ে কোন শিক্ষার্থীকে শারীরিকভাবে আঘাত করা যাবে না। প্রয়োজনে কাউন্সিলিং করতে হবে। অভিভাবকদের ডেকে বোঝাতে হবে। বুলিং রোধে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ, করিডোর, ক্লাসরুমে সিসি ক্যামেরা বসানোর পাশাপাশি মনিটরিং করতে হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষক, কর্মচারীদের মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। স্কুল বুলিং আইন অমান্য বা ক্রিমিনাল ক্রাইম না হলেও স্কুল কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনে পুলিশের সাহায্য নিতে পারেন। শিক্ষকদের কোন চাপমুক্তভাবে নিয়ম-শৃঙ্খলা বজায় রাখার পর্যাপ্ত ক্ষমতা দিতে হবে। শিক্ষক যুক্তিসঙ্গত উপায়ে তা হ্যান্ডেল করবেন। বুলিংয়ের শিকার ও বুলিং করা উভয়ের কাছে লিখিত নেয়ার ব্যবস্থা করা উত্তম। এক্ষেত্রে কেউ সাক্ষী থাকলে তার থেকেও লিখিত রিপোর্ট নেয়া যাবে। বুলিংয়ের শিকার ও বুলিং করা উভয়কে আলাদাভাবে বা একসঙ্গে প্রতিরোধ কমিটি প্রয়োজনীয় কথা বলবে। বর্তমানে সাইবার বুলিং বলতে যেমন বাজে মেসেজ পাঠানো, কোন গোপন বিষয় মিডিয়ায় প্রকাশ করে দেয়া, অনলাইনে হুমকি দেয়াকে বোঝানো হয়। বিষয়টিকে মাথায় রেখে খসড়া নীতিমালায় সাইবার বুলিং ঠেকাতে শিক্ষার্থীদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারে নিরুৎসাহী করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বুলিংয়ের শিকার ও বুলিং করা উভয়কে যতœসহকারে কাউন্সিলিং করে তাদের আচরণ পরিবর্তন করতে হবে। বুলিং করা শিক্ষার্থী ও ভিকটিম উভয়ের জন্য ফাইল মেইনটেন করতে হবে, যাতে তাদের রেকর্ডগুলো পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক হয়। স্কুলের যে কোন পরিস্থিতিতে প্রয়োজনে অভিভাবকদের সঙ্গে মিটিং করতে হবে এবং সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। স্কুলে কোন কর্মকা-ে ধর্ম-গোত্র ইত্যাদি যে কোন বিষয়ে যেন বৈষম্য তৈরি না হয় সেদিকে নজর দিতে হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা যাতে শারীরিক ও মানসিকভাবে আঘাত না পায় সে বিষয়ে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। দলগত বুলিং শিক্ষার্থীদের পরস্পরকে আলাদা থেকে যতটা সম্ভব বিচ্ছিন্ন রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে সেকশন পরিবর্তন করার প্রস্তাব করা হয়েছে। অভিভাবকদের করণীয় বিষয়ে বলা হয়েছে, সন্তানকে স্কুলের নিয়ম-কানুন মেনে চলা, অন্য শিক্ষার্থী বা বন্ধুদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার জন্য নিয়মিত উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সন্তানকে সর্বোচ্চ ভালবাসার মধ্য দিয়ে লালন-পালন করতে হবে। তাদের মধ্যে মূল্যবোধ শেখাতে হবে, যাতে তারা বুলিংকারী না হয়ে ওঠে। নিজ সন্তানকে বুলিংকারী বা বুলিংয়ের শিকার যাই হোক না কেন, পূর্বাপর কিছু না জেনে অভিভাবকরা ঝগড়া-বিবাদে জড়িয়ে পড়া থেকে বিরত থাকতে হবে। সন্তানদের সামনে পিতা-মাতা কারও সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হবেন না। বুলিংকারী শিক্ষার্থীর বিষয়ে স্কুল কোন পদক্ষেপ নিলে অভিভাবকরা তার বিরোধিতা না করে স্কুলকে সহযোগিতা করার কথা নীতিমালায় বলা হয়েছে। এ নীতিমালায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফেসবুক ব্যবহার ও রাজনীতি নিষিদ্ধ করার কথা বলা হয়েছে-গণমাধ্যমে প্রকাশিত এমন সংবাদে তীব্র আপত্তি জানিয়েছে। নীতিমালা প্রণয়ন কমিটি। কমিটির আহ্বায়ক ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব জাবেদ আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেছেন, ফেসবুক নিষিদ্ধ করা হচ্ছে এ সংবাদ পুরোপুরি মিথ্যা। গণমাধ্যমে এ সংবাদ কোথা থেকে লেখা হয়েছে আমি জানিনা। স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে বৈঠকেও এ নিয়ে আলোচনা হয়নি। এটা ভুল তথ্য। এমন কিছু নীতিমালায় কোথাও নেই। আমাদের কি সেই সুযোগ আছে নাকি যে ফেসবুক নিষিদ্ধ করব। কে ফেসবুক ব্যবহার করবে আর কে করবে না তা ঠিক করার ক্ষমতা আমাদের আছে নাকি? এমন খবরের কোন মানে আছে?
×