ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ঘন সবুজ মাঠ সোনালি দিনের স্মৃতি, টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম

প্রকাশিত: ১১:০৪, ২৫ আগস্ট ২০১৯

ঘন সবুজ মাঠ সোনালি দিনের স্মৃতি, টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম

মোরসালিন মিজান ॥ আহারে কী দিন ছিল পাটের! ধানের পরেই পাট। সোনালি আঁশের কত গল্প শোনা যেত একসময়! স্কুলের গন্ডি পার হতে হলে একবার না একবার লিখতেই হতো- জুট ইজ দ্য গোল্ডেন ফাইবার অব বাংলাদেশ। কিন্তু হায়! আজ আর এমন রচনার প্রয়োজন হয় না। কোথায় যেন হারিয়ে গেছে কথাগুলো। এ কারণেই হয়ত মেহেরপুরের কয়েকটি পাট প্রধান অঞ্চল ঘুরে দারুণ অনুভূতি হলো। তার আগে উল্লেখ করা প্রয়োজন, একসময় পাট বাণিজ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল একচেটিয়া। ১৯৪৭-৪৮ সাল পর্যন্ত এ দেশ থেকে বিশ্ববাজারে প্রায় ৮০ ভাগ পাট রফতানি হতো। নানা সমস্যার কারণে ১৯৭৫-৭৬ সালের দিকে অবস্থা বদলাতে থাকে। বর্তমানে বিশ্ব চাহিদার শতকরা মাত্র ২৫ ভাগ পাট বাংলাদেশ থেকে বাইরে যায়। এ অবস্থায়ও দেশের কিছু কিছু এলাকায় পাট চাষ অব্যাহত আছে। ফরিদপুর, টাঙ্গাইল, যশোর, ঢাকা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, জামালপুর প্রধান পাটচাষ অঞ্চল। প্রচুর পাট হয় মেহেরপুরেও। গত কয়েকদিন আগে জেলার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে মনে হয়েছে, পাট কেন্দ্রিক ব্যস্ততা ফুরিয়ে যায়নি এখনও। যেদিকে চোখ যায়, সবুজ। মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা পাটের সবুজ যেন ছুঁয়ে দিচ্ছে আকাশকে। গাংনী উপজেলা থেকে মেহেরপুরে সদরের দিকে যাওয়ার দীর্ঘপথ। পথের দুই ধারে পাটের ক্ষেত। আর কিছু দেখা যায় না। পাট আর পাট শুধু। কোন কোন জমির পাট কাটা শেষ হয়েছে। কোনটিতে সবে শুরু। জমি থেকে মহিষের গাড়ি কিংবা ট্রাক্টরে করে বাড়ি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে পাট। পাট বলতে, কাঁচি দিয়ে সদ্য কাটা পাটগাছের আঁটি। রাস্তা থেকে সামান্য নিচে নামলেই পাটের ক্ষেত। পাট কাটার ফাঁকে কয়েকজন চাষী সেখানে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। একজনের নাম মোঃ ইউনুস। তিনি জানান, এই অঞ্চলে বহুকাল ধরেই পাট চাষ হচ্ছে। ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছেন তারা। বাপ দাদার পর এখন তারা নিজেরা করছেন। গত চৈত্রে গম কেটে পাট বুনেছিলেন। আষাঢ় মাস থেকে কাটা শুরু হয়েছে। ভাদ্র মাসের পুরোটা ধরেই চলবে। বর্তমানে দেশী তোশা পাট ও ভারতীয় জাতের পাট চাষ হচ্ছে বলে জানান তিনি। আমিন নামের আরেক কৃষক জানান, একদিকে পাট কাটা চলছে অন্যদিকে চলছে জাক দেয়া, বাকল ছাড়ানো ও শুকোতে দেয়ার কাজ। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও এ কাজে ব্যস্ত এখন। বাড়তি লোকও নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ১০০ থেকে ১২০ দিনের মধ্যে পাট পরিপক্ক হলেও, পুরো প্রক্রিয়াটি অনেক পরিশ্রমের বলে জানান তিনি। পলাশীপাড়া নামক একটি গ্রামের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় গাড়ি থামাতেই হলো। ছোট্ট গ্রামের পুরোটাজুড়ে পাট কেন্দ্রিক ব্যস্ততা। তোড়জোড়। রাস্তার ধারে মরা খাল। ঘোলা জল। তাতেই চলছে জাক দেয়ার কাজ। এখানে কথা হয় সাফিয়া খাতুনের সঙ্গে। হাঁটু জলে নুইয়ে পাট জাক দেয়ার কাজ করছিলেন তিনি। জানালেন, কাঁদা জলে ভাল করে পাট ডুবিয়ে রাখতে হয়। একটু ভেসে থাকলে হবে না। আবার বেশি সময় রাখলে পচে যাবে। সবদিক বিবেচনায় রেখে কাজ করতে হয় বলে জানান তিনি। খালের পাশে বাড়ির বেড়ায়, কালভার্টের রেলিংয়ে অর্ধভেজা পাট। শুকনো অংশ দুপুরের রোদে কী সুন্দর চিকচিক করছে। আর কাঁচা রাস্তার ওপরে, বাড়ির আঙ্গিনায় শুকোতে দেয়া পাটখড়ি তো কদমের ফুলের মতো ফুটে আছে। পাটখড়ি জ্বালানির চাহিদা মেটায়। ঘরের বেড়া ও ছাউনি তৈরি করা হয়। দৃশ্যগুলোতে নতুন কিছু নেই। কিন্তু এতকাল পর দেখতে গিয়ে সোনালি সেইদিনের কথা মনে পড়ে যায়। আজকেরদিনে পাট চাষ বিশেষ লাভজনক নয়। তবে এই অঞ্চলের কৃষকেরা লাভ লস ভুলে চাষাবাদ অব্যাহত রেখেছেন। তাদের একজন আব্দুস সালাম। যুবক বয়সী কৃষক জানান, এবার ৮ বিঘা জমিতে পাট চাষ করেছেন তিনি। ফলনও ভাল। এখন পাট কাটা, বাড়ি আনা ও জাক দেয়ার কাজে প্রচুর সময় দিতে হচ্ছে। ফজরের নামাজের সময় থেকেই কাজে নেমে পড়তে হচ্ছে। তবে দিন শেষে লাভ হবে না লস, তা নিয়ে সংশয় আছে তার। লাভ হতে পারে। লসও হতে পারে। কোনবার লাভ হয়। কোনবার লস হয় বলে জানান তিনি। এই সংশয় সন্দেহের কারণে অনেকেই পাট চাষ কমিয়ে দিয়েছেন। উদাহরণ হতে পারেন তোহিদুল ইসলাম। বয়সে প্রবীণ। কথা প্রসঙ্গে বললেন, ২০০৫ সালেও ১০ থেকে ১২ বিঘা জমিতে পাট চাষ করেছি আমি। নিজের জমিতে করেছি। লিজ নিয়েও করেছি। এখন চাষ করছি ৪ বিঘা জমিতে। পাটের দাম পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ করেন তিনি। আরেক কৃষক সুজন মিয়া জানান, ১ বিঘা জমিতে ১০ মনের বেশি পাট হয় এখন। দাম পাওয়া যায় ১৫ হাজার টাকার মতো। কিন্তু তাদের খরচ সে তুলনায় বেশি হয়ে যায়। মেহেরপুর জেলা কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালে ২৩ হাজার ৭৫৫ হেক্টর জমিতে পাটের চাষ হয়। ২০১৬ সালে ২৭ হাজার ২১০ হেক্টর জমিতে পাটের চাষ হয়। ২০১৭ সালে পাট চাষ হয় ২৫ হাজার ৮৪৫ হেক্টর জমিতে। ২০১৮ সালে ২০ হাজার ৭৯০ হেক্টর জমিতে পাটের চাষ হয়। চলতি বছর মেহেরপুরের তিনটি উপজেলায় ১৯ হাজার ৯২০ হেক্টর জমিতে পাট চাষ করা হয়েছে। এভাবে পরিমাণ কখনও কমছে। কখনও বাড়ছে। তবে চাষ বন্ধ হয়নি।
×