ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

পৃথিবীর ফুসফুস বাঁচাতে বিমান থেকে পানি ঢালবে বলিভিয়া

প্রকাশিত: ১০:৫৬, ২৫ আগস্ট ২০১৯

পৃথিবীর ফুসফুস বাঁচাতে বিমান থেকে পানি ঢালবে বলিভিয়া

জনকণ্ঠ ডেস্ক ॥ ব্রাজিলের আমাজন জঙ্গল বাঁচাতে বিমান থেকে পানি ঢালার উদ্যোগ নিয়েছে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ বলিভিয়া। তিন সপ্তাহ ধরে ‘পৃথিবীর ফুসফুস’ খ্যাত জঙ্গলটিতে জ্বলতে থাকা আগুনে ইতোমধ্যেই পুড়ে গেছে সাত হাজার ৭৭০ বর্গকিলোমিটার এলাকা। আগুন নিয়ন্ত্রণে তাই সুপারট্যাঙ্কার বোয়িং বিমান ৭৪৭-৪০০ ভাড়া করার ঘোষণা দিয়েছে বলিভিয়া। আগুন নিয়ন্ত্রণে শুক্রবার থেকেই আকাশপথে ওই সুপারট্যাঙ্কার নিয়ে অভিযান শুরু হয়েছে। খবর গ্লোবাল রিসার্চ, স্পুতনিক ও গার্ডিয়ানের। বলিভিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট আলভারো গার্সিয়া জানিয়েছেন, দেড় লাখ লিটার পানি বা অগ্নি নির্বাপক নিয়ে উড্ডয়নে সক্ষম এই সুপারট্যাঙ্কার বোয়িং বিমান। এই বিমান থেকে পুড়তে থাকা আমাজনে পানি ঢালা হবে। তার আগে বিমানবাহিনীর বিমান গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলো চিহ্নিত করে আসবে। এরপরই পানি নিয়ে উড়াল দেবে সুপার ট্যাঙ্কার বোয়িং বিমান। সুপার ট্যাঙ্কারটির সঙ্গে রয়েছে তিনটি অতিরিক্ত হেলিকপ্টার। রয়েছেন ৫০০ অগ্নিনির্বাপণ কর্মী। পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রয়োজনে আমাজন জঙ্গলে নেমে আগুন নেভানোর চেষ্টা করবেন তারা। প্রতিবেশী প্যারাগুয়ে ও ব্রাজিলের প্রতিও সীমান্তে আগুন ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে বলিভিয়া। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে থাকা অক্সিজেনের ২০ শতাংশেরই উৎপত্তি আমাজনে। গবেষকদের মতে এই বন প্রতিবছর ২০০ কোটি মেট্রিক টন কার্বন-ডাই- অক্সাইড শোষণ করে। সে কারণে একে ডাকা হয়ে থাকে ‘পৃথিবীর ফুসফুস’ নামে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির হারকে ধীর করতে আমাজনের ভূমিকাকে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। বিশ্বের দীর্ঘতম এ জঙ্গলটির আয়তন যুক্তরাষ্ট্রের আয়তনের প্রায় অর্ধেক। ব্রাজিলের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্পেস রিসার্স ২০১৩ সাল থেকে আমাজন জঙ্গলে আগুন লাগা নিয়ে গবেষণা করছে। গত মঙ্গলবার প্রকাশিত নতুন এক প্রতিবেদনে তারা জানিয়েছে রেকর্ড হারে পুড়ছে আমাজন জঙ্গল। এরইমধ্যে ব্রাজিলের রোন্ডানিয়া, আমাজোনাস, পারা, মাতো গ্রোসো অঞ্চলের কিছু অংশে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। আমাজনে আগুন লাগা কোন অস্বাভাবিক ঘটনা নয়, কিন্তু এবারের মতো আগুন আগে কখনও ছড়ায়নি জঙ্গলে। পরিবেশবাদীরা বলছেন, আমাজনকে বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত করার সরকারী নীতির কারণেই আগুন লাগানোর মহোৎসব শুরু হয়েছে। অঞ্চলটিকে ঘিরে করা কয়েকটি গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, কথিত উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির জন্য কৃষির বিস্তৃতি, বৈধ ও অবৈধ খনি এবং প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের জন্য ঘটছে অরণ্য বিনাশ। গড়ে উঠছে সংশ্লিষ্ট অবকাঠামোগত প্রকল্প। গত কয়েকদিনের আগুন কথিত উন্নয়নের জন্য অরণ্য বিনাশের গতিকেই জোরদার করছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। আমাজন ধ্বংসের আত্মঘাতী পথ বেছে নিয়েছে সরকার-ব্রাজিলিয়ান বিজ্ঞানী ॥ আমাজন ধ্বংসের মাধ্যমে ব্রাজিল সরকার আত্মঘাতী পথ বেছে নিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন দেশটির একজন শীর্ষ বিজ্ঞানী। সাও পাওলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব এ্যাডভান্স স্টাডিজের সিনিয়র গবেষক কার্লোস নোবরে মনে করছেন, এই পথ থেকে ব্রাজিল সরকারকে সরানোর একমাত্র উপায় আন্তর্জাতিক চাপ। তিনি দাবি করেছেন, প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারো সরকারের আমলে বন ধ্বংসের গতি তীব্র হয়েছে। পরিবেশ সংস্থাকে দুর্বল করে এবং খনিওয়ালা, কৃষক ও কাঠুরেদের সমর্থন দিয়ে বলসোনারোর সরকার বনাঞ্চল ধ্বংসে উৎসাহ দিচ্ছে বলে মন্তব্য করেন বিজ্ঞানী কার্লোস। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি এসব কথা বলেছেন। ব্রাজিলের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্পেস রিসার্স (আইএনপিই) বলেছে, এ বছর জুন পর্যন্ত ব্রাজিলে ৭২ হাজার ৮৪৩টি অগ্নিকাণ্ড হয়েছে। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি আগুনের ঘটনা আমাজন জঙ্গলে, যা আগের বছরের তুলনায় ৮৮ শতাংশ বেশি। পরিবেশবাদীরা বলছেন, আমাজনকে বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত করার সরকারী নীতির কারণেই আগুন লাগানোর মহোৎসব শুরু হয়েছে। সাও পাওলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব এ্যাডভান্স স্টাডিজের সিনিয়র গবেষক কার্লোস নোবরে বলেন, অরণ্য বিনাশ জোরালো হয়ে স্বাভাবিক এই আর্দ্র বনাঞ্চলকে শুষ্ক তৃণভূমিতে পরিণত হওয়ার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এর পরিণাম জলবায়ু, বণ্যপ্রাণী ও বনজীবীদের জন্য ভয়ঙ্কর হবে বলে সতর্ক করেন তিনি। এই বিজ্ঞানী বলেন, এই বছর ২০-৩০ শতাংশ বাড়ার পথে রয়েছে অরণ্য বিনাশ। গত দশ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো তা দশ হাজার বর্গকিলোমিটার ছাড়াবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই প্রবণতা গত কয়েকবছর ধরে খারাপ হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, বলসোনারোর অধীনে এতে গতি এসেছে। পরিবেশ সংস্থাকে দুর্বল করে এবং খনিওয়ালা, কৃষক ও কাঠুরেদের সমর্থন দিয়ে বলসোনারোর সরকার বনাঞ্চল ধ্বংসে উৎসাহিত করছে বলে জানান তিনি। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানকে দেয়া সাক্ষাতকারে ব্রাজিলের এই বিজ্ঞানী বলেন, ‘পরিস্থিতি খুব খারাপ। এর পরিণতি ভয়ঙ্কর হবে। এসব আগুনের অনেকাংশেরই কারণ সাংস্কৃতিক চাপ, যা মন্ত্রীরা দিচ্ছে। তারা অরণ্য বিনাশে জোর দিচ্ছে কারণ তা অর্থনীতির জন্য ভাল। এতে যারা অবৈধভাবে বন ধ্বংস করে তারা শক্তিশালী হচ্ছে’। জনমত জরিপ অনুযায়ী ব্রাজিলের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী আমাজনের সুরক্ষা চান। কিন্তু সরকার ব্যবসায়িক স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। পরিবেশগত কারণে স্থগিত হয়ে যাওয়া একটি মেগা হাইড্রো প্রকল্প চলতি সপ্তাহে আবারও শুরুর ঘোষণা দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট বলসোনারো। এছাড়া তার ছেলে কংগ্রেসে একটি বিল এনেছেন যাতে আরও দুর্বল হয়ে পড়বে আদিবাসী এলাকা ও প্রকৃতি সংরক্ষণকারী অঞ্চলের সুরক্ষা। বিজ্ঞানী নোবরে বলেন, ‘বিপদজনক ক্ষতি থেকে বন রক্ষার একটি উপায় হতে পারে বর্হিবিশ্বের প্রতিবাদ ও ভোক্তাদের নেয়া ব্যবস্থা। তিনি বলেন, ব্রাজিলের বাসিন্দাদের চেয়ে আন্তর্জাতিক চাপের ওপরে বেশি মনোযোগ দেবে ব্রাজিলের রাজনীতিবিদরা। আমি মনে করি এই কৌশলগত পথ বদলাতে অন্তর্জাতিক চাপের প্রয়োজন। ইউরোপীয় ভোক্তারা ব্রাজিলের পণ্য কিনবে কি না তা নিয়ে ব্রাজিলের কৃষিখাত খুবই উদ্বিগ্ন। আমাজনের আত্মহত্যা থেকে ব্রাজিল সরকারকে ঠেকানোর এটাই চূড়ান্ত উপায় হতে পারে’। না হলে এটি ব্রাজিল এবং জলবায়ুর জন্য মারাত্মক পরিণতি বয়ে আনতে পারে বলে সতর্ক করেন তিনি। সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত ॥ এদিকে ব্রাজিলের আমাজনে দাবানল আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক সঙ্কটের রূপ নিয়েছে। অঞ্চলটি পৃথিবীর ফুসফুস হিসেবে পরিচিত। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জায়ের বোলসোনারো শুক্রবার দাবানল নিয়ন্ত্রণে আনতে সেদেশের সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেন। আমাজনের এবারের দাবানলের তীব্রতা এখন এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। নিরক্ষীয় চিরহরিৎ বনাঞ্চল আমাজনের কয়েকশ’ দাবানলকে বোলসোনারো প্রথমে গুরুত্ব দেননি। এ নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে সমালোচনা শুরু হয়। ইউরোপীয় নেতারা ব্রাজিলের সঙ্গে প্রধান প্রধান বাণিজ্য চুক্তি বাতিলের হুমকি দেয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্রাজিলের দূতাবাসের সামনে দেশটির পণ্য বর্জনে বিক্ষোভ হয়। সামাজিক মাধ্যমে ব্রাজিলের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ও দেশটির নীতি নিয়ে বিস্তর সমালোচনা হয়। এরপর ব্রাজিলের উগ্র ডানপন্থী প্রেসিডেন্ট বোলসোনারো তার সিদ্ধান্ত পাল্টান। তিনি শুক্রবার বলেন, পরিবেশ আইন অনুসারে আমি সেনাবাহিনীর সদস্যদের আমাজনে যেতে বলেছি। এসব সেনা সদস্যের শনিবার থেকে আমাজনে শত শত দাবানল নিয়ন্ত্রণে কাজ করার কথা। আমাজনের দাবানল একটি বড় ধরনের সমস্যাÑ তা স্বীকার করে জায়ের বোলসোনারো বলেন, আমাদের যতটুকু সামর্থ্য রয়েছে তার সাহায্যে আমরা আমাজনের আগুন নেভাতে কাজ করব। আমাদের দেশে এই কাজের লোকের অভাব রয়েছে। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট বলেন, আমরা পরিবেশগত অপরাধ মোকাবেলায় শূন্য সহনশীলতা (জিরো টলারেন্স) নীতি গ্রহণ করব। তিনি বলেন, আমাজনের প্রতি আমার গভীর ভালবাসা ও আবেগ রয়েছে। এই নিরক্ষীয় চিরহরিৎ বনাঞ্চল রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। তবে সেনাসদস্যরা ঠিক কোন পন্থায় আমাজনের আগুন নেভাবে- এ বিষয়টি খোলাসা করেননি জায়ের বোলসোনারো। জায়ের বোলসোনারো ব্রাজিলের জাতীয়তাবাদী নেতা ও একজন সাবেক সেনা সদস্য। জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসার পর দেশটির বন উজাড়ের ঘটনা বৃদ্ধি পায়। দেশটির যেসব অঞ্চলে আদিবাসীরা বাস করে সেসব অঞ্চলে উল্লেখযোগ্যহারে বন উজার করা হয়। বোলসোনারো দাবি করেন, এসব অঞ্চল রক্ষা ও শিল্পায়নের স্বার্থে গাছ কাটতে হচ্ছে। তার মতে, আদিবাসীরা অকারণে দেশের খনিসমৃদ্ধ এসব জমি দখল করে রয়েছে। জায়ের বোলসোনারো ক্ষমতায় আসার এই সাত মাসে আমাজনের ১৩শ’ ৩০ বর্গমাইল বনভূমি উজার হয়েছে যা গত বছরের তুলনায় ৩৯ শতাংশ বেশি। দেশটির জাতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা শুক্রবার জানায়, চলতি বছর আমাজনে ছোটবড় চার হাজার ৩শ’ ৪১ বার দাবানলের ঘটনা ঘটেছে যা ২০১০ সাল থেকে সর্বোচ্চ। কৃষিজমি ও চারণভূমি তৈরির জন্য এসব অগ্নিকা-ের বেশিরভাগই ইচ্ছাকৃতভাবে লাগানো হয়েছে বলে মনে করা হয়। তবে এ বছর একটু আগেভাগেই আমাজনে আগুন লাগানো হয়েছে। নাসার বিজ্ঞানী ডোগ মর্টোন মনে করেন, এবারের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, কৃষি জমি ও চারণভূমি তৈরির জন্য বনের চারপাশে আগুন দেয়া হলেও তা আস্তে আস্তে বনের সংরক্ষিত এলাকায় চলে গেছে। এসবের প্রেক্ষিতে ডোগ মর্টোন বলেন, এখন এ ঘটনা একটি সঙ্কটের দিকে যাচ্ছে। এই নিরক্ষীয় চিরহরিৎ বনাঞ্চল রক্ষায় এখনই সম্ভাব্য পদক্ষেপ নিতে হবে। তিনি বলেন, ব্রাজিল পরিবেশ রক্ষায় বিশ্বের একটি প্রথম সারির দেশ। কিন্তু জায়ের বোলসোনারোর আমলে ব্রাজিল এই সুনাম হারাতে চলেছে।
×