ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ক্ষোভে ফুঁসছে স্থানীয়রা ॥ বন্দুকযুদ্ধে নিহত ২ রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী

রোহিঙ্গারা বেপরোয়া, চালাচ্ছে ফ্রি স্টাইল কর্মকাণ্ড

প্রকাশিত: ১০:৫৩, ২৫ আগস্ট ২০১৯

রোহিঙ্গারা বেপরোয়া, চালাচ্ছে ফ্রি স্টাইল কর্মকাণ্ড

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন দু’দফায় থমকে যাওযায় উখিয়া-টেকনাফের স্থানীয়রা চরম ক্ষুব্ধ। অন্যদিকে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মাঝে সৃষ্টি হয়েছে উল্লাস। মিয়ানমারের মৃত্যুকূপ থেকে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় পেয়ে এসব রোহিঙ্গা এখন ফ্রি স্টাইলে। জুটছে দেশী-বিদেশী ত্রাণ সহাযতা। এর ওপর রয়েছে বাড়তি আয় রোজগার। আশ্রিত হিসেবে ক্যাম্প থেকে আন্তর্জাতিক নিয়ম-কানুনের কোন ধারও এরা ধারছে না। ফলে দিনে দিনে এরা হয়ে উঠেছে বেপরোয়া। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার জন্য বিদেশীদের পক্ষে যেভাবে বাংলাদেশের কাছে অনুনয়বিনয় প্রকাশ করা হয়েছিল, এদের প্রত্যাবাসনে তাদের তত জোরালো পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। উল্টো কারও কারও পক্ষে বলা হচ্ছে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে পরিবেশ এখনও অনুকূলে আসেনি। ফলে বর্তমানে যে প্রশ্নটি মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে তা হচ্ছে বিপুল জনঅধ্যুষিত বাংলাদেশ আর কতদিন রোহিঙ্গাভারে জর্জরিত হতে থাকবে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মিয়ানমারের রাখাইনে ওরা বসবাস করত কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনীতে। বছরের পর বছর এমন পরিবেশে ওরা থেকেছে। যদিও নিজ দেশে ওরা ছিল পরবাসী। পান থেকে চুন খসলে খবর হতো। ওদেশের সেনাবাহিনী, সীমান্ত রক্ষী বাহিনী, পুলিশ, এমনকি বৌদ্ধ সন্ত্রাসীরা রোহিঙ্গাদের নিশ্চিহ্ন করার প্রয়াসে হেন কোন কাজ বাদ রাখেনি। ফলে মৃত্যু সর্বদা তাদের পিছু ধাওয়া করত। মহিলা-যুবতীরা হতো ধর্ষিত। যুবকদের ধরে নিয়ে যাওয়া হতো, অনেকে ফিরত লাশ হয়ে। ওদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, মিয়ানমার সরকার রাখাইন রাজ্যের এসব রোহিঙ্গাদের চলাফেরাসহ নিত্য কার্যক্রমে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করে রেখেছে। এমনকি কোন্ রোহিঙ্গা পরিবার কখন সন্তান নিচ্ছে সে খবরও প্রশাসনের কাছে অবহিতকরণ বাধ্যতামূলক রয়েছে। ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে রাখাইন রাজ্যে সশস্ত্র সেনা অভিযানের কারণে। মানবিকতার কারণে বাংলাদেশ সরকার ওদের আশ্রয় দিয়েছে। আশ্রয় পেয়ে ওদের থাকা, খাওয়া, চলাফেরা, সভা-সমাবেশ, বাড়তি আয়-রোজগারসহ যাবতীয় কার্যক্রম এমনকি আশ্রয় ক্যাম্পে সন্তান জন্মদানের বিষয়টিও চলছে ফ্রি স্টাইলে। গত দু’বছরে এদের পরিবারে লক্ষাধিক নতুন সদস্য এসেছে। সবকিছুতে ফ্রি পরিবেশ পাওয়ার জের হিসেবে রোহিঙ্গারা গত দুই বছরে বেপরোয়া হয়েছে। এখন ওরা নিজ দেশে ফিরে যেতে চায় না। নানা অজুহাত তুলে এ পর্যন্ত দু’দফায় প্রত্যাবাসন কর্ম এরা ভ-ুল করে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, হেন কোন অপকর্ম নেই যাতে এরা জড়িয়ে পড়েনি। এর মধ্যে খুনখারাবি, মাদক ও মানব পাচারে এরা রয়েছে শীর্ষে। সর্বশেষ গত ২২ আগস্ট রাতে টেকনাফের এক যুবলীগ নেতাকে তুলে নিয়ে পাহাড়ী এলাকায় নিয়ে গুলিতে হত্যা করেছে। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত দুই রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রেফতার হওয়ার পর শনিবার পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে। গত ২২ আগস্ট রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া দ্বিতীয় দফায় ভেস্তে যাওয়ার পর ওইদিন রাতে টেকনাফের জাদিমুরায় যুবলীগ নেতাকে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা তুলে নিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটায়। এ ঘটনার পর পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। স্থানীয় জনসাধারণ ক্ষুব্ধ হয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ভাংচুর চালায়। অবরোধ করে সড়ক। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে টেকনাফে অধিকাংশ এনজিও তাদের কার্যক্রম শনিবার থেকে বন্ধ রেখেছে। তবে উখিয়ায় এনজিও কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। টেকনাফে পরিস্থিতি থমথমে অবস্থায় রয়েছে। স্থানীয় জনসাধারণ যে কোন সময় বড় ধরনের সহিংস ঘটনার আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন অবস্থায় রয়েছে। এ ঘটনার নেপথ্যে প্রধান যে কারণটি উঠে এসেছে সেটি হচ্ছে এ যুবলীগ নেতা বহু রোহিঙ্গাকে পালিয়ে আসার পর আশ্রয় ও ত্রাণ সহায়তার ব্যবস্থায় জড়িত ছিল। দীর্ঘ দুই বছর সময়ে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে তিনি সক্রিয় ছিলেন। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপের সদস্যরা এ যুবলীগ নেতাকে তুলে নিয়ে পাহাড়ী এলাকায় গুলিতে হত্যা করে। তবে আরেকটি বিষয় আলোচিত হয়েছে, একটি পক্ষ রোহিঙ্গাদের দিয়ে তাকে হত্যা করিয়েছে নিজেদের স্বার্থে। তবে প্রথমোক্ত কারণটিই সর্বাধিক আলোচিত। ক্ষোভে ফুঁসছে স্থানীয়রা ॥ ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাতের পর রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযানের বর্বরতায় দলে দলে রোহিঙ্গারা যখন সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আসা শুরু করে তখন উখিয়া টেকনাফের জনসাধারণ এদেরকে আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করে খাদ্যসহ যাবতীয় ত্রাণ সহায়তা প্রদান করে। এরপর সরকার সীমান্ত উন্মুক্ত করে দিলে লাখে লাখে রোহিঙ্গা এদেশে আসা শুরু হয়। সরকারী পর্যায়ে পুলিশ, বিজিবি, বেসরকারী পর্যায়ে জনপ্রতিনিধি ও সাধারণ মানুষ এসব রোহিঙ্গার প্রাণ বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ওই সময়ে একজন রোহিঙ্গাও খাদ্যাভাব বা আশ্রয়ের অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। যে যা পেরেছেন সামর্থ্য অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের জন্য বিলিয়ে দিয়েছেন। এদের জন্য উখিয়া টেকনাফের স্থানীয় সাধারণ মানুষ বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন। এরপরও তা মানবতার কারণে জনগণ মনে নিয়েছে। ওপারে রোহিঙ্গাবিরোধী সেনা অভিযান অব্যাহত থাকায় বাংলাদেশ সরকার শেষ পর্যন্ত আশ্রিত রোহিঙ্গাদের জন্য যাবতীয় ব্যবস্থার আয়োজন করে। এতে রোহিঙ্গারা প্রাণে বেঁচে যায়। রোহিঙ্গারাই এখন দেশের জন্য হুমকি ॥ বাংলাদেশে আশ্রিত ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা এখন বড় ধরনের হুমকি হিসেবে রয়েছে। গত দুবছরে এদের জন্য উখিয়া-টেকনাফের ১০ হাজার একর জমি আবাসন খাতে নষ্ট করা হয়েছে। অর্ধকোটির বেশি গাছ কেটে আশ্রয় শিবির নির্মাণ করা হয়েছে। দুই শতাধিক পাহাড় কেটে নষ্ট করেছে এসব রোহিঙ্গা। বনভূমি করেছে উজাড়। উখিয়া টেকনাফের জনমানুষ বিভিন্নভাবে হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত। এ রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয় লক্ষাধিক মানুষ বেকারত্বের শিকার। এ দুই উপজেলায় জনসংখ্যা যেখানে সর্বোচ্চ পৌনে ৫ লাখ, সেখানে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ১২ লক্ষাধিক। অর্থাৎ জনসংখ্যার দিক দিয়ে স্থানীয়দের চেয়ে প্রায় আড়াইগুণ বেশি। দিনে দিনে বেপরোয়া ॥ ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর থেকে এরা আশ্রয় নিয়েছে নিজেদের প্রাণ রক্ষার জন্য। এই প্রাণ রক্ষার্থে যেসব উপকরণ তার সবই দিয়েছে এদেশের সরকারী ও বেসরকারী পর্যায় থেকে। পরে এদের সাহায্য-সহযোগিতায়, ত্রাণ সহায়তা প্রদানে যুক্ত হয়েছে দুই শতাধিক এনজিও। শুরু থেকে এরা সবকিছু পেয়েছে ফ্রি স্টাইলে। শুধু তাই নয়, এরা এত বেশি ত্রাণ সহায়তা পেয়েছে যে, বাড়তি ত্রাণ এরা খোলাবাজারে বিক্রিও করেছে দেদার। খেয়েদেয়ে এরা এখন তরতাজা। এ অবস্থায় ওরা এদেশ ছাড়তে চায় না। উখিয়া-টেকনাফের সাধারণ মানুষের আগামীর ক্ষতি এড়াতে সরকার এদের জন্য নোয়াখালীর হাতিয়ার ভাসানচরে যে আবাসন প্রকল্প গড়ে তুলেছে সেখানেও তারা যাবে না। মানবিক কারণে সরকার ও স্থানীয় জনসাধারণ এদের সবকিছু সহ্য করেছে। এ সহ্য করার জের হিসেবে এরা এখন বেপরোয়া। বেআইনী তৎপরতায় লিপ্ত ॥ গত প্রায় দু’বছরে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কক্সবাজার সদরসহ জেলার বিভিন্ন থানায় ৩৮০টি মামলা হয়েছে। খুনখারাবিসহ মাদক ও মানব পাচারে এরা সম্পূর্ণভাবে জড়িয়ে আছে। মাদক পাচারে রোহিঙ্গা নারীরাও বেশ এগিয়ে। এছাড়া এদেশের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে অবৈধ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশী সার্টিফিকেট নিয়ে এরা পাসপোর্টও গ্রহণ করেছে। এ পর্যন্ত বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশী পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। বিদেশে গিয়ে এরা অবৈধ তৎপরতায় ধরা খেয়ে সুনাম ক্ষুন্ন করছে বাংলাদেশের। আশ্রয় ক্যাম্পে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের তৎপরতা ॥ উখিয়া টেকনাফে যে ৩২টি আশ্রয় শিবির রয়েছে রাতেরবেলায় এসব শিবিরে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের আনাগোনা চলছে দীর্ঘদিন ধরে। এরা বিভিন্ন সংগঠনের নামে তৎপর। সর্বশেষ ভয়েস অব রোহিঙ্গা নামের একটি সংগঠনের ব্যানারে এরা প্রত্যাবাসনবিরোধী লিফলেট, প্ল্যাকার্ড প্রচার করেছে। এসব সন্ত্রাসী সাধারণ রোহিঙ্গাদের রাখাইন রাজ্যে ফিরে না যাওয়ার ব্যাপারে প্রতিনিয়ত ভীতির মধ্যে রাখতে সক্ষম হয়েছে। ফলে ফিরে যেতে ইচ্ছুকদের কেউ মুখ খুলতে না পারার এটি অন্যতম একটি কারণ। কিছু এনজিও’র প্রত্যাবাসনবিরোধী তৎপরতা ॥ রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে বর্তমানে দেশী-বিদেশী দুই শতাধিক এনজিও কাজ করছে। এদের মধ্যে অর্ধশতাধিক রয়েছে নিজেদের স্বার্থ হাসিলে এবং এর বিপরীতে ওরা রোহিঙ্গাদের এদেশে থেকে যাওয়ার পক্ষে উস্কানি দিয়ে যাচ্ছে। রাখাইন রাজ্যে পরিবেশ পরিস্থিতি এখনও তাদের অনুকূলে নয় বলে নানা প্রচার চালিয়ে আসছে। রোহিঙ্গারা পালিয়ে আসার বছরখানেকের মধ্যে বিষয়টি উদঘাটিত হওয়ার পর সরকার বেশকিছু এনজিও কার্যক্রমকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেও তা বাস্তবে কার্যকর হয়নি। কার্যকর করতে জোরালো কোন পদক্ষেপও নেয়া হয়নি। এনজিও ব্যুরো রোহিঙ্গাদের উস্কানিসহ নানা অভিযোগের ভিত্তিতে ৪১টি এনজিও কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। এছাড়া বর্তমানে যেসব এনজিও কাজ করছে তন্মধ্যে ১০৫টি এনজিও ব্যুরো নিবন্ধিত। অন্যগুলো সম্পূর্ণ বেআইনীভাবে আশ্রয় শিবিরগুলোতে কাজ করছে।
×