ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শক্তিশালী বন্ড মার্কেট ॥ দীর্ঘমেয়াদী পুঁজির চাহিদা মেটাতে শীঘ্রই আসছে

প্রকাশিত: ১০:৫২, ২৪ আগস্ট ২০১৯

 শক্তিশালী বন্ড মার্কেট ॥ দীর্ঘমেয়াদী পুঁজির চাহিদা মেটাতে শীঘ্রই আসছে

এম শাহজাহান ॥ দীর্ঘমেয়াদী পুঁজির চাহিদা মেটাতে শক্তিশালী বন্ড মার্কেট চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। টেকসই বন্ডমার্কেট প্রতিষ্ঠায় একটি সমন্বিত নীতিমালার প্রণয়নের কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। নতুন নীতিমালার আওতায় টাকার অঙ্কে বন্ডের ইউনিট ছোট ও পুঁজিবাজারে নিয়মিত লেনদেনের সুযোগ থাকবে। এতে বন্ড মার্কেটে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বিপুল বিনিয়োগ আসবে। এর মাধ্যমে যেকোন কোম্পানি মূলধন ঘাটতি পূরণে অন্যপক্ষের কাছ থেকে ঋণ নিতে পারবে। ফলে ব্যাংক ঋণ ও সঞ্চয়পত্রের ওপর চাপ কমবে। হ্রাস পাবে ঋণের বিপরীতে উচ্চমাত্রার সুদহার। উন্নত দেশের মতো সরকার বড় বড় প্রকল্পের বিপরীতে বাজারে বন্ড ছেড়ে অর্থ সংগ্রহ করতে পারবে। বিকশিত হবে পুঁজিবাজার। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সম্প্রতি জানিয়েছেন, দীর্ঘমেয়াদী অর্থায়নের প্রয়োজন মেটাতে বন্ড মার্কেট বিকশিত করার উদ্যোগ নেবে সরকার। এ লক্ষ্যে বন্ড মার্কেট উন্নয়নে কাজ শুরু করেছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ। নীতিমালার অভাবে দেশে এখন দেশে বন্ড মার্কেট তেমন সচল হয়নি, সীমিত আকারে বাজারে চালু রয়েছে। এগুলো লেনদেন হয় প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে। সাধারণের হাতে বন্ড আসার সুযোগ নেই। চীন, জাপান, রাশিয়া ভারত, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশের বিনিয়োগ ও অবকাঠামো উন্নয়নে বন্ড মার্কেট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বন্ডে নির্ধারিত হারে সুদ পাওয়া যায় বলে সাধারণ শেয়ারের তুলনায় এতে বিনিয়োগ ঝুঁকি নেই। দেশের মানুষের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহের সবচেয়ে ভাল ‘পণ্য’ হতে পারে বন্ড। শক্তিশালী বন্ড মার্কেটে বিনিয়োগ বাড়বে। বৃদ্ধি পাবে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান। দেশের পুঁজিবাজার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে বন্ড মার্কেট। অর্থমন্ত্রী সম্প্রতি দেশে বন্ড মার্কেট বিকশিত করার ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, আমরা এখনও অনেক ‘ফিন্যান্সিয়াল টুলসের সঙ্গে পরিচিতি হতে পারিনি। স্বল্পমেয়াদী আমানত দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্পের অর্থায়নে ব্যবহার করছি। এতে অর্থ কিভাবে ফেরত আসবে তা বোধগম্য নয়। এজন্য আমাদের প্রথম কাজ হবে বন্ড মার্কেটকে বেশি বিকশিত করা। যদি আমরা বন্ড মার্কেটের উন্নয়ন করতে পারি তবে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোয় দীর্ঘমেয়াদী অর্থায়নের ব্যবস্থা হবে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র এ বিষয়ে জানায়, মন্ত্রীর এই ঘোষণার পর বন্ড মার্কেট নিয়ে নানা পর্যালোচনা হচ্ছে। একটি সঠিক ও কার্যকর নীতিমালা প্রণয়নের কাজও হাতে নেয়া হয়েছে। শীঘ্রই এ সম্পর্কে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসবে। দেশে সীমিত আকারের বন্ড মার্কেট ॥ এদেশে বন্ড বাজারের আকার অত্যন্ত সীমিত। সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় বন্ডসমূহ বেচাকেনার কোন সুযোগ নেই। ইস্যুকৃত অধিকাংশ বন্ড রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক কর্তৃক ক্রয় ও ধারণ করা হয়েছে। খুবই স্বল্পসংখ্যক বন্ড বিশেষায়িত ও বেসরকারী ব্যাংকগুলো ক্রয় এবং ধারণ করছে। কিছুসংখ্যক ব্যক্তি এবং নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের হাতেও কিছু বন্ড রয়েছে। ফলে এরাই বাংলাদেশের বন্ড বাজারের প্রধান ক্রেতা ও সংগঠক। সরকার এসব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে বন্ড ক্রয়ের জন্য নির্দিষ্ট অঙ্কের বরাদ্দ দিয়ে তাদের জন্য বন্ড ক্রয় বাধ্যতামূলক ঘোষণা করে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে বিধিবদ্ধ সম্পদ হিসেবেও বাধ্যতামূলক বন্ড ক্রয় ও ধারণ করতে হয়। ইসু্যুকৃত এসব বন্ডের মধ্যে অধিকাংশই হন্তান্তরযোগ্য নয়। মাধ্যমিক বাজার না থাকায় বন্ড হোল্ডারগণকে সেগুলো নগদায়নের জন্য বন্ডের মেয়াদ উত্তীর্ণ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। বিনিয়োগ দীর্ঘমেয়াদের কারণে অনেকেই তাই নতুন করে বন্ড কেনায় আগ্রহী হন না। ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য ২০০৫ সাল পর্যন্ত দেশে কোন সেকেন্ডারি মার্কেট না থাকায় ইস্যুকৃত বন্ডসমূহ খুবই সীমিত আকারে বাজারজাতকরণ হয়। ইস্যুকৃত এসব বন্ডের ধারক ব্যাংকসমূহের অধিকাংশই ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক। ব্যক্তি ও অ-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক এসব বন্ড ধারনের ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও মেয়াদপূর্তি কাঠামো এবং সুদ হারের অনমনীয়তায় তাদের সাড়া ছিল খুবই কম। তবে বাংলাদেশের বন্ড মার্কেটের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ঘটনা-২০০৫ সালের ১০ জানুয়ারি থেকে সেকেন্ডারি মার্কেটে বন্ডের কেনাবেচা শুরু হওয়ায়। সে সময় বাজারে বেচাকেনার জন্য ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) মোট ১৮ বন্ড তালিকাভুক্ত হয়। এছাড়া দেশের বন্ড বাজার উন্নয়নকল্পে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রাইমারি ডিলার নিয়োগ করেছে এবং এখন পর্যন্ত ১২ ডিলার নিলামে ইস্যুকৃত বন্ডসমূহ স্বাধীনভাবে বেচাকেনা করছে। এছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ দুই হাজার কোটি টাকার বন্ড ছেড়ে সর্বশেষ অর্থ সংগ্রহ করেছে। তবে পদ্মা সেতুর অর্থায়নের জন্য ৫শ’ কোটি ডলারের ‘সভরেন বন্ড’ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলেও শেষ পর্যন্ত তা করা হয়নি। বরং সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে সরকার। এছাড়া সরকার বিভিন্ন সময়ে যেসব বন্ড ইস্যু করেছে সেগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ইস্যুকৃত মোট ৩৩ বন্ডের মধ্যে সতেরোটিই ৩ বছর মেয়াদী। মূলত জাতীয় সঞ্চয় ও বিনিয়োগে উৎসাহিতকরণ, পাট খাতের লোকসান পুনর্ভরণ, টেলিফোন খাতের উন্নয়ন, পাট ও বস্ত্র খাতের উন্নয়নে সরকারীভাবে এসব বন্ড ছাড়া হয়। ২ বছর মেয়াদী একটি মাত্র ইস্যুকৃত বন্ডের উদ্দেশ্য ছিল মওকুফকৃত কৃষিঋণ পুনর্ভরণ। তিনটি ৫ বছর মেয়াদী ট্রেজারি বন্ড ছাড়া হয়েছিল বাংলাদেশ বিমানের অর্থসংস্থানের উদ্দেশ্যে। ১০ বছর মেয়াদী বন্ড ছিল তিনটি যার দুটিই ছিল পাট খাতে অর্থসংস্থানের জন্য। অপরটির উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের ক্ষতি পুনর্ভরণ। তিনটি ১৫ বছর মেয়াদী সরকারী ট্রেজারি বন্ডের মাধ্যমে সরকার ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের পুনঃমূলধনায়ন, অনাদায়ী ঋণের জন্য প্রভিশন সংরক্ষণ এবং মওকুফকৃত কৃষিঋণের অর্থ পুনর্ভরণের ব্যবস্থা করে। ২৫ বছর মেয়াদী তিনটি ট্রেজারি বন্ডই ইস্যুর উদ্দেশ্য ছিল পাট খাতের অবসায়ন। এসব ট্রেজারি বন্ড ছাড়া ইস্যুকৃত বাকি তিন বন্ডের মধ্যে দুটি ছিল সুদমুক্ত ট্রেজারি বন্ড এবং একটি ছিল বিশেষায়িত ব্যাংকসমূহের অনুকূলে ইস্যুকৃত মেয়াদী বন্ড। এছাড়া যেকোন প্রবাসীরা প্রবাসী বন্ডে বিনিয়োগ করে ১২ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা নিতে পারেন। এর সবই বাংলাদেশ সঞ্চয় অধিদফতরের চালু করা বন্ড। ১৯৮৮ সালে চালু হওয়া পাঁচ বছর মেয়াদী ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ড, ২০০২ সালে চালু হওয়া তিন বছর মেয়াদী ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ড ও ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ড বিনিয়োগ করে এ সুবিধা পাওয়া যায়। এখন পর্যন্ত এমন তিন বন্ডে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ করেছেন প্রবাসীরা। এতে বড় হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ। এসব বন্ড পাওয়া যায় বিদেশী এক্সচেঞ্জ হাউস, দেশী ব্যাংকের বিদেশী শাখা ও বাংলাদেশের ব্যাংক শাখায়। আবার এসব বন্ডের বিপরীতে দেশী ব্যাংক থেকে ঋণও পাওয়া যায়। বিনিয়োগকৃত অর্থ চাইলে আবার বিদেশেও ফেরত নেয়া যায়। এসব বন্ডের বিনিয়োগ করে সিআইপি সুবিধা পাওয়া যায়। আবার এই আয়ে করমুক্ত সুবিধাও মেলে। সঞ্চয়পত্র অধিদফতরের তথ্যমতে, ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ড পাঁচ বছরের। এ বন্ডে ২৫ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করা যায়। মেয়াদ শেষে মুনাফা পাওয়া যায় ১২ শতাংশ। প্রতি ছয় মাস অন্তর মুনাফা তোলার সুযোগ রয়েছে। ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ড তিন বছর মেয়াদী। এ বন্ডে ৫০০ ডলার থেকে ৫০ হাজার ডলার পর্যন্ত বিনিয়োগ করা যায়। মেয়াদ শেষে মুনাফা সাড়ে ৭ শতাংশ। প্রতি ছয় মাস অন্তর সরল সুদে মুনাফা তোলা যায়। আর ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ডও তিন বছর মেয়াদী। এতে সাড়ে ৬ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা পাওয়া যায়। ৫০ হাজার ডলার পর্যন্ত বিনিয়োগ করা যায়। এছাড়া বাংলাদেশী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এবং অ-নিবাসী বাংলাদেশীদের যারা লাভ-লোকসানের ভিত্তিতে বিনিয়োগে আগ্রহী তাদের জন্য ২০০৪ সালে ইসলামী শরীয়াভিত্তিক বিনিয়োগ বন্ড চালু করা হয়। স্বল্প মেয়াদী এবং আকর্ষণীয় নমনীয় হারের কারণে ৬ মাস, এক বছর ও দুই বছর মেয়াদী এসব বন্ড বিনিয়োগকারীদের কাছে খুব আকর্ষণীয় হয় বলে জানা গেছে। সুনির্দিষ্ট নীতিমালার অভাবে বন্ড মার্কেট বড় হচ্ছে না ॥ বন্ড মার্কেট নিয়ে দেশে সুনির্দিষ্ট কোন নীতিমালা নেই। আর এ কারণে বন্ড মার্কেট বড় হচ্ছে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, কোম্পানিগুলো মূলধন সংগ্রহে ব্যাংক ঋণের ওপর অতি বেশি নির্ভরতার কারণে এই বাজার বড় হয়নি। তবে বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও অবকাঠামো উন্নয়নে বন্ড মার্কেটের বিকল্প আর কিছুই নেই। টাকার অঙ্কে বন্ডের ইউনিট ছোট ও পুঁজিবাজারে লেনদেনযোগ্য হলে বিপুল অর্থের বিনিয়োগ আসবে বন্ড মার্কেটে। কারণ বন্ড হচ্ছে এক ধরনের ঋণচুক্তিপত্র। যার মাধ্যমে কোন কোম্পানি মূলধন ঘাটতি পূরণে অন্যপক্ষের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে থাকে। উন্নত বিশ্বে পুঁজিবাজারের পাশাপাশি রয়েছে বন্ড মার্কেটের শক্ত অবস্থান। বড় প্রকল্পে অর্থয়ানের জন্য সরকারও বন্ড ছাড়ে। আর বন্ডে নির্ধারিত হারে সুদ পাওয়া যায় বলে সাধারণ শেয়ারের তুলনায় এতে বিনিয়োগ ঝুঁকি নেই বললেই চলে। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক শাহজাহান মিনা বলেন, বাংলাদেশে সত্যিকার অর্থেই কোন বন্ড মার্কেট সেভাবে গড়ে উঠেনি। যেসব পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি আইপিওর মাধ্যমে শেয়ার বিক্রির অনুমতি দিচ্ছি তারা কিন্তু ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে। তবে এই ঋণের প্রয়োজন হতো না, যদি একই সঙ্গে বন্ড ইস্যু করার কথা বলা হতো। ডিএসই ব্রোকার্স এ্যাসোসিয়েশানের সাবেক সভাপতি মোশতাক সাদেক বলেন, বন্ড মার্কেটের জন্য রুলস এ্যান্ড রেগুলেশন দরকার। ট্রেডটা ব্যাংক টু ব্যাংক, ব্যাংক টু বাংলাদেশ ব্যাংক এভাবে হয়, এটা যদি স্টক মার্কেটের মাধ্যমে হতো মার্কেট আরও সমৃদ্ধ হওয়ার সুযোগ পেত। এছাড়া সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে জনপ্রিয় করার জন্য শুরুতে ছোট ছোট ইউনিটের বন্ড বাজারে আনার কথা বলছেন বিশ্লেষকরা। এর সঙ্গে আকর্ষণীয় সুদ দেয়াও প্রয়োজন বলে মনে করা হচ্ছে। বন্ড মার্কেট উন্নয়নে কাজ করছে ডিএসই ॥ ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ বা ডিএসই বন্ড মার্কেট উন্নয়নে কাজ শুরু করেছে। এর ফলে পুঁজিবাজার আরও বিকশিত হওয়ার সুযোগ পাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। দুর্বল বন্ড মার্কেটের কারণে ব্যাংকগুলো আমানত ছাড়া অন্য কোন উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহ করতে পারছে না। বন্ড ব্যবস্থার দুর্বলতায় কর্পোরেট সেক্টর বন্ড মার্কেটের পরিবর্তে পুরোপুরি ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এতে ব্যাংক খাতের ওপর চাপ বাড়ছে। অন্যদিকে শেয়ারবজারে তালিকাভুক্ত ট্রেজারি বন্ডগুলো বছরের পর বছর পড়ে থাকলেও কোন লেনদেন হচ্ছে না। সম্প্রতি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ছাড়াও কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান বন্ড ছেড়ে অর্থ সংগ্রহ করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক, প্রাইমারি ডিলার (পিডি) ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা জানান, পর্যাপ্ত সেকেন্ডারি মার্কেট না থাকায় সরকারী বিল ও বন্ডের বেচাকেনা হচ্ছে না। এসব বন্ড ও বিলের ক্রেতা মূলত সরকারী ও বেসরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। ট্রাস্ট এ্যাক্ট ও কোম্পানি এ্যাক্ট অনুযায়ী সরকারী প্রতিষ্ঠান ও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রভিডেন্ট ফান্ডের অর্থ বন্ডে বিনিয়োগ করার কথা থাকলেও তা হচ্ছে না। এছাড়া সেকেন্ডারি মার্কেটের বিকাশে অন্যতম শর্ত পেনশন ফান্ডের টাকাও বন্ডে বিনিয়োগের বাধ্যবাধকতা আরোপে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া হয়নি। একাধিক ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগ সংশ্লিষ্টরা জানান, আইন অনুযায়ী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রভিডেন্ট ফান্ড বন্ডে বিনিয়োগ করা হচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত করতে সরকার ব্যর্থ হচ্ছে। তবে পেনশন তহবিল বন্ডে বিনিয়োগ নিশ্চিত করার ফলে অনেক দেশের সেকেন্ডারি বন্ড মার্কেট বিকশিত হয়েছে। আর ব্যাংকগুলোও পাচ্ছে বড় অঙ্কের মুনাফা। জানা গেছে, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত সরকারী ট্রেজারি বন্ডের লেনদেন আট বছরেও হয়নি। ২২১টি বন্ডের পরিশোধিত মূলধন ৫৫ হাজার ৫৬৩ কোটি টাকা। যা ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) মোট বাজার মূলধনের ২২.৫০ শতাংশ। বর্তমানে ডিএসইর বাজার মূলধন ৩ লাখ ২৮ হাজার কোটি টাকা। আর বিশাল এই খাতের লেনদেনের জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থার পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগও নেই। তবে লেনদেন না হওয়ার জন্য কিছু কারণ চিহ্নিত করেছে প্রধান শেয়ারবাজার ডিএসই। একই সঙ্গে মেয়াদ শেষ হওয়ায় প্রায় পনেরোটি বন্ড তালিকাচ্যুত করা হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে। আরও কিছু প্রতিষ্ঠানের তালিকাচ্যুত হওয়ার সময় হয়েছে। তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি না পাওয়ায় তাদের তালিকাচ্যুত করা যাচ্ছে না। সম্প্রতি বিআইবিএম আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বন্ড মার্কেটের বিদ্যমান নানা ধরনের অসঙ্গতি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং রিফর্মস এ্যাডভাইজার এসকে সুর চৌধুরী বলেন, অসঙ্গতি আছে, থাকবে। এর মধ্য দিয়েই কিভাবে মার্কেট ডেভেলপমেন্ট করা যায় সে চেষ্টা করতে হবে। উদ্ভাবনী দিক খুঁজে বের করতে হবে। এখানে চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন নিশ্চিত করা। বন্ড খেলাপীদের তালিকা সিআইবিতে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব নয়। এটা করতে গেলে সিআইবি নীতিমালা সংশোধন করতে হবে। এদিকে, এটি মূলত শেয়ারবাজার (যেখানে শেয়ার লেনদেন হয়) এখানে অন্য প্রোডাক্ট নেই বললেই চলে। শেয়ারের বাইরে কিছু মিউচ্যুয়াল ফান্ড লেনদেন হয়, তাও খুব কম। আর বন্ড ও ডিবেঞ্চারে একেবারেই লেনদেন নেই। এগুলো শুধু তালিকাভুক্তিতেই সীমাবদ্ধ। তাই বন্ড ও ডিবেঞ্চার তালিকাভুক্তির মাধ্যমে ডিএসইর বাজার মূলধনের আকার বড় হওয়া ছাড়া কোন কাজই হচ্ছে না। মার্চেন্ট ব্যাংকাররা বলছেন, আমাদের পুঁজিবাজার এশিয়ার বাজারগুলোর তুলনায় সবচেয়ে বেশি লাভজনক। তাই এখানে বিনিয়োগকারীরা আসতে শুরু করেছেন। এ অবস্থায় ভাল কোম্পানির শেয়ারের সরবরাহ ও প্রোডাক্টের ভিন্নতা আনতে হবে। জানা গেছে, ১৯৮৮ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত মাত্র তিনটি কর্পোরেট বন্ড ও চৌদ্দটি ডিবেঞ্চার ইস্যু করা হয়েছে। বন্ডগুলোর স্থিতি দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) মাত্র ০.২ শতাংশ। এছাড়া ব্যাংকগুলো ১৯ হাজার ৮২৪ কোটি টাকার মোট ৫৭টি সাব-অর্ডিনেট বন্ড ইস্যু করেছে। ২০০৫ সালে ডিএসইতে সরকারী ট্রেজারি বন্ড তালিকাভুক্ত হয়। সর্বশেষ তালিকাভুক্তির কার্যক্রম শেষ হয় ২০১১ সালের ৩০ অক্টোবর। আর বর্তমানে বাজারে মোট ৪ মেয়াদের বন্ড রয়েছে- ৫ বছর, ১০ বছর, ১৫ বছর এবং ২০ বছর। ট্রেজারি বন্ডের প্রত্যেকটিরই অভিহিত মূল্য এক লাখ টাকা। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন লেনদেন হয়নি। এমনকি ডিএসইর ওয়েবসাইটেও এসব বন্ডের তেমন কোন তথ্য নেই। তবে এর বাইরেও তিনটি কর্পোরেট বন্ড রয়েছে। এদিকে, বন্ডের লেনদেন নিয়ে ইতোমধ্যে পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন তৈরি করেছে ডিএসই। পর্যবেক্ষণে লেনদেন না হওয়ার পেছনে বেশকিছু কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় কারণ হলো অথোরাইজড ডিলাররা (এডি) এসব বন্ডের লেনদেনের জন্য প্রস্তাব করেনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের ট্রেজারি বন্ডের নিলাম হলেও শুধু প্রাইমারি ডিলাররা এতে অংশ নেয়। এছাড়া বন্ডের লেনদেনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক আলাদা একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছে। যাকে মার্কেট ইনফ্রাস্ট্রাকচার মডিউল বা এমআইএম বলা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মোঃ সিরাজুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের দেশে মার্কেটের সেভাবে উন্নয়ন হয়নি। বন্ডের ক্ষেত্রে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের একটি ভূমিকা আছে। এজন্য এ খাতে কর মওকুফের যদি সুবিধা দেয়া হয়, সেটি ভাল হবে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাজেদুর রহমান বলেন, একটি উন্নত ও কার্যকর বন্ড মার্কেট প্রতিষ্ঠা করতে ডিএসই কাজ করে যাচ্ছে। নতুন বছরের বাজেটে প্রণোদনা পাওয়া সাপেক্ষে শীঘ্রই বন্ড মার্কেটও চালু করা সম্ভব হবে।
×