ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কাল উখিয়া টেকনাফে আশ্রিতদের শোডাউন

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সঙ্কট আরও ঘনীভূত

প্রকাশিত: ১০:৫০, ২৪ আগস্ট ২০১৯

 রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সঙ্কট  আরও ঘনীভূত

মোয়াজ্জেমুল হক ॥ মিয়ানমারে সেনা নির্যাতনে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় পেয়েছে বাধাহীন। কিন্তু এখন যাওয়ার প্রশ্নে অর্থাৎ প্রত্যাবাসনে তুলে ধরছে নানা অজুহাত। নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার প্রশ্নে এ পর্যন্ত দু’দফায় রোহিঙ্গারা তাদের যে মনোভাব প্রদর্শন করেছে তাতে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সকল মহল বিস্মিত। এরা নিজ দেশে ফিরে যেতে যেমন চাইছে না, তেমনি সরকার নোয়াখালীর ভাসানচরে তাদের বসবাসের জন্য যে একক জোন সৃষ্টি করেছে সেখানেও তারা যাবে না। উখিয়া টেকনাফের আশ্রয় ক্যাম্পে থেকে ওরা নিজেদের ইচ্ছামাফিক তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে চায়। মিটিং মিছিল করছে ফ্রি স্টাইলে। অসামাজিক কার্যকলাপ, চোরাচালানসহ হেন কোন অপকর্ম নেই যেখানে রোহিঙ্গাদের সংশ্লিষ্টতা নেই। আগামীকাল ২৫ আগস্ট এদেশে আশ্রয় নেয়ার দুই বছর পূর্তিতে রোহিঙ্গাদের পক্ষে বড় ধরনের শোডাউনের কর্মসূচী নেয়া হয়েছে বলে মাঝিদের মারফত জানা গেছে। রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরে না যাওয়ার বিষয়ে মাঠে রয়েছে এখন দুটি সংগঠন। এর একটি ভয়েস অব রোহিঙ্গা। অপরটি রোহিঙ্গা আরাকান সোসাইটি। রোহিঙ্গাদের এসব সংগঠন এখন নতুন নতুন দাবি উত্থাপন করছে। নাগরিকত্ব, জমিজমা ফেরত প্রদান, নিপীড়ন নির্যাতনের বিচারসহ অন্যান্য দাবির সঙ্গে নতুন যুক্ত করা হয়েছে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে থাকা ১ লাখ ২৮ হাজার সদস্যকে মুক্ত করে দেয়া। এছাড়া রাখাইন রাজ্যে জাতিসংঘ বাহিনী মোতায়েন করা। রোহিঙ্গাদের পক্ষে উত্থাপিত এসব দাবির একটিও বাংলাদেশের পক্ষে পূরণ করার কোন অবকাশ নেই। এর সবই মিয়ানমার ও বিশ্ব ফোরাম অর্থাৎ জাতিসংঘের ওপর বর্তায়। অথচ, এসব অজুহাত দিয়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ ছাড়তে চাইছে না। কেন চাইছে না নানা মহলের নানা মতো রয়েছে। কারও মতে ষড়যন্ত্র, কার মতে কিছু এনজিও সংস্থা নিজেদের স্বার্থে ইন্ধন, আবার কারও মতে রোহিঙ্গাদের যেসব সংগঠন রয়েছে সেসব সংগঠনের সন্ত্রাসীদের পক্ষে ফিরে না যাওয়ার জন্য অবিরাম হুমকি প্রদর্শন। রোহিঙ্গা সূত্র মতে, এমনিতেই রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেয়ার সামগ্রিক বিষয়টি ছিল সঙ্কটে। এখন বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের প্রস্তুতিতে চীনের মধ্যস্থতায় জাতিসংঘের ইউএনএইচসিআরের প্রত্যক্ষ সহায়তায় এ প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় সঙ্কট আরও ঘনীভূত হয়েছে। এ প্রক্রিয়া আবার কখন সচল হবে তা সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। তবে শরণার্থী ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিশনার (আরআরআরসি) কার্যালয় থেকে শুক্রবার বিকেলে জানানো হয়েছে, তারা আশাবাদী। এ লক্ষ্যে ট্রানজিট ক্যাম্পে পৌঁছানোর জন্য যে যানবাহন নিয়োজিত করা হয়েছিল সেগুলো সেখানে রাখা হয়েছে। একজন রোহিঙ্গাও স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসনে আগ্রহী হলে তাকে সীমান্ত এলাকা পর্যন্ত পৌঁছে দেয়া হবে। এ পর্যন্ত দুদফায় প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ভেস্তে গেছে রোহিঙ্গাদের কারণে। গত বছরের ১৫ নবেম্বর এবং দ্বিতীয় দফায় গত ২২ আগস্ট প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় উভয় দেশ সকল প্রস্তুতি গ্রহণ করার পরও একজন রোহিঙ্গাকেও প্রেরণ করা যায়নি। আরআরআরসি আবুল কালাম শুক্রবার জানিয়েছেন, রাখাইন থেকে যে সকল রোহিঙ্গা পালিয়ে এসেছে তাদের ফিরিয়ে নেয়ার প্রশ্নে বাংলাদেশ-মিয়ানমার চুক্তি হওয়ার পর এ পর্যন্ত ৫৫ হাজার রোহিঙ্গার তথ্য সে দেশের সরকারকে যাচাই-বাছাইয়ের জন্য দেয়া হয়েছে। তাদের পক্ষ থেকে ১০৩৮ পরিবারের মধ্য থেকে ৩৩৯ পরিবারের ৩ হাজার ৪৫০ সদস্যের ক্লিয়ারেন্স পাওয়া গেছে। তাদের মতামত নিচ্ছে ইউএনএইচসিআর। গত ২০ ও ২১ আগস্ট মতামত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় কোন রোহিঙ্গা সদস্য ফিরে যেতে আগ্রহ প্রকাশ করেনি বলে তিনি নিশ্চিত করেন। এপরও ২২ আগস্ট পূর্ব নির্ধারিত প্রত্যাবাসনের দিনক্ষণে দিনভর অপেক্ষা করা হয় যদি কেউ আসে। কিন্তু বিকেল ৪টা পর্যন্ত কেউ না আসায় প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া আটকে যায়। সীমান্তের নাইক্ষ্যংছড়ির ওপারে ঘুমধুম সীমান্তে বাংলাদেশ-মিয়ানমার মৈত্রী সেতুর সে দেশের অংশে মিয়ানমার পক্ষের লোকজনও উপস্থিত ছিল। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হওয়ার পরও কোন রোহিঙ্গাকে পৌঁছাতে পারেনি এপারের পক্ষ থেকে। ফলে তারাও ফিরে যায়। এদিকে, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া আটকে যাওয়া, ভেস্তে যাওয়া বা থমকে যাওয়া যেভাবেই বলা হোক না কেন রোহিঙ্গারা তাদের নিজ দেশে ফিরে না যাওয়ার প্রশ্নে এখন অটল অবস্থান গ্রহণ করেছে। এখন তাদের নানা অজুহাত। শুধু তাই নয়, আগামী ২৫ আগস্ট তাদের এদেশে ফিরে আসার দ্ইু বছর পূর্তিতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্যরা বড় ধরনের শোডাউনের প্রস্তুতি নিয়েছে বলেও জানা গেছে। দ্বিতীয় দফায় প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া আটকে যাওয়ার ফলে স্থানীয় প্রশাসন যেমন আশাহত, তেমনি স্থানীয় জনসাধারণ সাংঘাতিকভাবে ক্ষুব্ধ। রোহিঙ্গাভারে জর্জরিত উখিয়া টেকনাফের সকল পর্যায়ের মানুষ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রোহিঙ্গারা আসার পর থেক্ েঅপরদিকে, সেনা নির্যাতনে রাখাইন রাজ্য থেকে পালিযে আসা বাংলাদেশে আশ্রয় পেয়ে রোহিঙ্গাদের সার্বিক অবস্থা দিনে দিনে ভালই হয়েছে। গত প্রায় দুই বছর আগে এবং তারও আগে যেসব রোহিঙ্গা এদেশে পালিয়ে এসেছে তাদের একজনও যেমন না খেয়ে মরেনি, তেমনি আশ্রয়হীনও থাকেনি। নিজ দেশে অর্থাৎ রাখাইন রাজ্যে ওদের বসবাস করতে হয় সরকারের নানা শর্তের বেড়াজালে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের চোখ রাঙ্গানিতে। অথচ, এদেশে আশ্রয় পেয়ে ওরা থাকছে একেবারে স্বাধীন পরিবেশে। মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক যে চাহিদাগুলো রয়েছে এগুলোর সবই তাদের কাছে বাংলাদেশ সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে পৌঁছে দিচ্ছে এবং এর সবই ফ্রি। এর ওপর রয়েছে বহু রোহিঙ্গার বাড়তি রোজগার। এরা আশ্রয় শিবিরে প্রতিনিয়ত রেশন সামগ্রীও যেমন নিচ্ছে, আবার সময় বুঝে বাড়তি রোজগারও করছে। বিভিন্ন সূত্রে আরও জানা গেছে, বর্তমানে যে ৩২ শিবিরে এরা রয়েছে এখানে ওদের চলাফেরা ও কাজেকর্মে কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। শুধু তাই নয়, এসব শিবিরে বিয়ে শাদী থেকে শুরু করে এমনকি মিছিল মিটিংও এরা করার সুযোগ পাচ্ছে। এ পরিবেশ মিয়ানমারে তারা অতীতেও পায়নি, আগামীতেও পাবে না। সঙ্গত কারণে বিভিন্ন সূত্রে জানানো হযেছে, মূলত এসব কারণেই প্রত্যাবাসনের ঘোষণা এলেই তারা বেঁকে বসে, উত্থাপন করে নানা দফা পেশ করে। সর্বশেষ গত ২২ আগস্ট ফিরে না যাওয়ার বিপরীতে একগ্রুপ দিয়েছে পাঁচদফা, আরেক গ্রুপ দিয়েছে চারদফা। এসব দফার একটিও বাংলাদেশের পক্ষে সমাধানের বিষয় নয়। এসব দাবি উত্থাপনে একদিকে স্বার্থান্বেষী মহলগুলোর প্রত্যাবাসনবিরোধী ইন্ধন, অপরদিকে, নিজেদের সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর অহরহ হুমকি রয়েছে বলে এন্তার অভিযোগ। এসব অপতৎপরতার মুখে থেকে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গারা তাদের নিজস্ব কোন মতামত ব্যক্ত করতে না পেরে শিখানো বুলিতেই কথা বলছে বলে বিভিন্ন সংস্থার অভিযোগ। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিরুদ্ধে কারা তৎপর, কারা প্ল্যাকার্ড, লিফলেট সরবরাহ করছে, কারা ইংরেজীতে পোস্টার লিখে তাদের হাতে পৌঁছাচ্ছে এসবের বিরুদ্ধে জোরাল তদন্ত করে তা উদঘাটন করে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের সময় এসে গেছে। তবে ইতোমধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইতোমধ্যে বলেছেন, রোহিঙ্গাদের এদেশে থাকার প্ররোচনা দিলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। লাখে লাখে রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয়গ্রহণের পর এ সংখ্যা এখন ১২ লাখে উন্নীত। এদের আশ্রয়ের জন্য সরকারের নির্দেশে এখন ৩২টি শিবির চালু রয়েছে। আবার শিবির থেকে পালিয় হাজার হাজার রোহিঙ্গা দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে রয়েছে। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর যারা পালিয়ে এসেছে তারা শরণার্থীর মর্যাদা পায়নি। এদের মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা হিসাবেই সরকার চিহ্নিত করেছে।
×