ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

যমুনা সার কারখানায় কোটি টাকার ইউরিয়া নষ্ট হচ্ছে অযত্নে

প্রকাশিত: ১০:২৮, ২৪ আগস্ট ২০১৯

  যমুনা সার কারখানায় কোটি টাকার ইউরিয়া নষ্ট হচ্ছে অযত্নে

আজিজুর রহমান ডল, জামালপুর ॥ এ্যামোনিয়া প্লান্টের কনভার্টার হিটারে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের কারণে বন্ধ হয়ে যাওয়া দানাদার ইউরিয়া সার উৎপাদনকারী দেশের বৃহত্তম রাসায়নিক শিল্প প্রতিষ্ঠান যমুনা সার কারখানা বিগত নয় মাসেও চালু হয়নি। কারখানা কর্তৃপক্ষ বিদেশ থেকে ইউরিয়া সার আমদানি করে কারখানার আওতাভুক্ত ১৯ জেলায় ডিলার ও কৃষক পর্যায়ে ইউরিয়া সার বিপণন চালু রেখেছে। তবে আমদানিকৃত ইউরিয়া সার মজুদ রাখার গুদাম সঙ্কটের কারণে কারখানার ভেতরে বিভিন্ন স্থানে খোলা আকাশের নিচে মজুদ রাখা কোটি কোটি টাকার ইউরিয়া সার জমাট বেঁধে এবং রোদের তীব্র তাপ ও বৃষ্টিতে গলে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। গুদামের ভেতরেও সার নষ্ট হচ্ছে। জমাট বাঁধা ও গলে যাওয়া সার কৃষকরাও কিনতে অনীহা প্রকাশ করছেন। এতে করে সার ডিলারা এসব সার উত্তোলন করে ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। অন্যদিকে আমদানিকৃত সার বিপণনে সরকারের বেশ কয়েক কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতির শঙ্কাও দেখা দিয়েছে। যমুনা কারখানা সূত্রে জানা গেছে, জেলার সরিষাবাড়ীর তারাকান্দিতে দৈনিক ১৭শ’ মেট্রিক টন দানাদার ইউরিয়া সার উৎপাদনকারী যমুনা সার কারখানা গত বছরের ১১ নবেম্বর থেকে বন্ধ রেখে রক্ষণাবেক্ষণ (ওভারহোলিং) কাজ করা হয়। রক্ষণাবেক্ষণ শেষে ১৬ নবেম্বর ভোর থেকে কারখানার সকল ইউনিট চালু করা হয়। ২৭ নবেম্বর ভোর পৌনে ছয়টার দিকে দানাদার ইউরিয়া সার উৎপাদনে যাওয়ার আগ মুহূর্তে কারখানার এ্যামোনিয়া প্লান্টের কনভার্টার হিটারে ভয়াবহ অগ্নিকান্ড সংঘটিত হয়। এতে এ্যামোনিয়া প্রক্রিয়াজাতকরণের প্রধান যন্ত্র প্রি-হিটার এবং এর সমস্ত ক্যাবল ও আশপাশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দামী যন্ত্রাংশ পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ফলে ওইদিন থেকে কারখানার উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। ওই দুর্ঘটনায় ২০০ কোটি টাকার অধিক ক্ষয়ক্ষতি হয়। প্রায় নয় মাস হয়ে গেলেও বিসিআইসি কর্তৃপক্ষ রহস্যজনক কারণে কারখানার ক্ষতিগ্রস্ত ইউনিট আজও মেরামত করেনি। ফলে কারখানাটি চালু হওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। সরেজমিনে গিয়ে কারখানার গুদাম এলাকা পরিদর্শনের সম্মতি চাইলে কর্তৃপক্ষ সেখানে যাওয়ার কোন অনুমতি দেননি। তবে কারখানা সংশ্লিষ্ট একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, কারখানা বন্ধ থাকায় বিদেশ থেকে আমদানিকৃত ইউরিয়া সার কারখানার আওতাভুক্ত ১৯টি জেলায় ডিলারদের মাঝে বিপণন করা হচ্ছে। এর মধ্যে জামালপুর, শেরপুর ও টাঙ্গাইল এবং উত্তরবঙ্গের ১৬টি জেলায় এই কারখানা থেকে ইউরিয়া সার সরবরাহ হয়ে থাকে। যমুনা সার কারখানাটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে কারখানার ৫০ হাজার মেট্রিক টন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন বাল্ক স্টোরে মাত্র ১২৭ মেট্রিক টন গুটি ইউরিয়া মজুদ রয়েছে। এই বাল্ক স্টোরে সারের বস্তা রাখার কোন নিয়ম নেই। বস্তাভর্তি ইউরিয়া সার মজুদ রাখার দুটি গুদামে মাত্র ১২ হাজার মেট্রিক টন সার মজুদ রাখা যায়। কারখানায় বর্তমানে বিদেশ থেকে আমদানিকৃত প্রায় ৭০ কোটি টাকা মূল্যের ৩৯ হাজার ৯৫৪ মেট্রিক টন ইউরিয়া সার মজুদ রয়েছে। বাকি ২৭ হাজার ৯৫৪ মেট্রিক টন সার গুদামের বাইরে খোলা আকাশের নিচে রাস্তায়, মূল কারখানার ভেতরের ইয়ার্ডে এবং প্রশাসনিক ভবনের সামনের রাস্তায় মজুদ করে রাখা হয়েছে। গুদামের বাইরে মজুদ সারের বস্তাগুলো ত্রিপল দিয়ে ঢেকে রাখা হলেও রোদের তীব্র তাপে, চলতি বর্ষায় অতিবৃষ্টিতে এবং টানা তিন মাসেরও অধিক সময় ধরে মজুদ রাখার কারণে বেশির ভাগ বস্তায় সার জমাট বেঁধে গেছে। বৃষ্টির পানি ঢুকে বস্তার সার গলে পানি হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। এতে সরকারের বেশ কয়েক কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতির শঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিসিআইসির সার ডিলার মো. ওসমান গনী অভিযোগ করে বলেন, ‘বিদেশ থেকে আমদানিকৃত ইউরিয়া সারের বহু বস্তা জমাট বেঁধে গেছে। বরাদ্দের সার উত্তোলনের সময় কারখানা কর্তৃপক্ষ জমাট বাঁধা ইউরিয়ার বস্তা নিতে বাধ্য করছেন ডিলারদের। এই সার কৃষক পর্যায়ে বিক্রি করতে খুবই সমস্যা হচ্ছে। ফলে সারের ব্যবসায় প্রত্যেক ডিলার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কারখানা কর্তৃপক্ষকে বলেও কোন কাজ হচ্ছে না। জমাট বাঁধা এবং গলে যাওয়া সার যাতে আমাদের না দেয়া হয় সেই দাবি জানাচ্ছি।’ একই অভিযোগ করে জামালপুর জেলা ট্রাক ও ট্যাঙ্কলরি মালিক সমিতি তারাকান্দি শাখার সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল আলম মানিক বলেন, ‘বর্তমানে আমদানিকৃত ইউরিয়া সারের মান অত্যন্ত খারাপ। এই সার বিদেশ থেকে কার্গোতে আসে। সেখান থেকে ট্রাকে এই কারখানায় এনে ডাম্পিংয়ের কারণে বস্তাগুলোর মান অত্যন্ত খারাপ হয়। বস্তা ফেটে বাতাস ঢুকে নষ্ট হয়ে যায়। গুদামের ভেতরে এবং বাইরে খোলা আকাশের নিচে মজুদ রাখা সারের বস্তাগুলোর অধিকাংশই জমাট বেঁধে গেছে। বাইরে রোদের তাপে এবং বৃষ্টিতে ভিজে সার গলে পানি হয়ে যাচ্ছে। ট্রাকে বস্তা তোলার সময় অনেক বস্তা থেকে টপটপ করে পানি ঝরে। সেই বস্তাগুলো পরিবর্তন করে দিতে বললেও কর্তৃপক্ষ অনীহা প্রকাশ করেন। এই সার ডিলারদের গুদামে নিয়ে গেলে তারা নিতে চান না। তারা সারের গুণগত মান খারাপ ও ওজনে কম বলে অভিযোগ করে থাকেন। বন্ধ থাকায় এই কারখানাকে ঘিরে হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন। প্রায় ৪৫০টি ট্রাক সব সময় এখানে থাকে। অধিকাংশ ট্রাক চালক ও শ্রমিকরা কাজ না পেয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।’ যমুনা সার কারখানার ব্যবস্থাপক (বাণিজ্যিক) মোঃ ওয়ায়েছুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, ‘গুদামে এবং বাইরে খোলা স্থানে এক সারিতে ওপর থেকে নিচে ৩২টি করে বস্তা রাখা হয়। ফলে টানা কয়েক মাস ওভাবে রাখা হলে নিচের দিকে কিছু বস্তা নষ্ট হতে পারে। সার জমাট বেঁধে গেলেও এর কোন গুণগত মান নষ্ট হয় না। সার ডিলার বা ট্রাক মালিকদের ঢালাও অভিযোগ সঠিক নয়। গুদামের দায়িত্বে নিয়োজিত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ট্রাকে সার তোলার সময় বস্তা নিয়ে অভিযোগ করলে সেগুলো সরিয়ে রাখা হয়।’ এ ব্যাপারে যমুনা সার কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক খান জাভেদ আনোয়ার জনকণ্ঠকে বলেন, ‘গুদামে স্থান সঙ্কুলান না হওয়ায় বাইরে কারখানার বিভিন্ন ফাঁকা স্থানে যথাযথ প্রক্রিয়ায় বিশেষ করে ত্রিপল ও পলিথিন দিয়ে ঢেকে সার মজুদ করা হয়। সেগুলো নষ্ট হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। বাইরে বেশি দিন মজুদ থাকছেও না। সার আসছে। আবার ডিলারদের মাঝে বিতরণ করা হচ্ছে। গুদামের বাইরে মজুদ ইউরিয়া সার নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এমন অভিযোগও আমার কাছে আসেনি।’ কারখানা চালুকরণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এই সার কারখানার প্রতিষ্ঠাকালীন মূল কম্পানি জাপানের মিতসুবিসির সঙ্গে বিসিআইসির চুক্তি ও যোগাযোগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে।
×