ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

পর্যটকের কাছে কুয়কাটা শীতের শান্ত সাগরের চেয়ে এখন অনেক বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে

বর্ষার কুয়াকাটা এক অচেনা সৈকত

প্রকাশিত: ০৯:২২, ২৪ আগস্ট ২০১৯

  বর্ষার কুয়াকাটা এক অচেনা সৈকত

কুয়াকাটা। এখন বিশ্বজুড়ে পরিচিত সমুদ্র সৈকত। রয়েছে স্বকীয়তার সুখ্যাতি। দীর্ঘ সৈকতের যে কোন স্পটে দাঁড়িয়ে সন্ধ্যায় দেখা সূর্যাস্ত এবং প্রত্যুষে গঙ্গামতী লেকপাড়ের বেলাভূমে দাঁড়িয়ে দেখা যায় অপূর্ব মনোলোভা সূর্যোদয়ের বিরল দৃশ্য। দুর্লভ এ প্র্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপেভোগ্য কুয়াকাটা সৈকতের বেলাভূমে প্রতিনিয়ত বাড়ছে পর্যটকের পদচারণা। মুখরিত থাকে দীর্ঘ সৈকত পর্যটক দর্শনার্থীর হৈ হুল্লোড় আর উৎসবে। আর এই মনোরম সৈকতের সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতিবছর বাড়ছে পর্যটকের সংখ্যা। শীতে তো থাকছে উপচেপড়া ভিড়। এখন বর্ষায় বাড়ছে পর্যটক দর্শনার্থীর আগমন। পর্যটকের কাছে কুয়কাটা শীতের শান্ত সাগরের চেয়ে এখন উত্তাল বঙ্গোপসাগর অনেক বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। যেন আসল চেহারা। কখনও ভয়াল তান্ডব। আবার কখনও শান্ত। মুহূর্তেই পাল্টে যায় চেহারা। এই গর্জন, আবার থমকে যাওয়া। আর তাই তো বর্ষায় এখানে বাড়ছে পর্যটক দর্শনার্র্থীর ভিড়। উত্তাল ঢেউরাশির সঙ্গে মেতে ওঠা। সাগরের পানিতে নেমে বিক্ষুব্ধ ঢেউয়ের সঙ্গে নাচানাচি। প্রতিদিন শত শত পর্যটক এখন বেছে নিচ্ছে বর্ষা মৌসুমকে। কারণ পাহাড়সম উঁচু ঢেউ অনবরত কিনারে এসে আঘাত হানছে বেলাভূমে। আর কিনারে আসার আগেই সেই উত্তাল ঢেউয়ের তালে তালে কখনও ডুব দিয়ে বাঁধা দেয়া। আবার কখনও ঢেউয়ের আঘাত থেকে এড়ানোর জন্য ডুব দিয়ে ক্ষণিকের জন্য নিজেকে আড়াল করা। আবার উঠে একই চেষ্টা। বার বার, বহুবার। কত শতবার এমন খেলায় মেতে ওঠা। পর্যটকের বিরামহীন এমনসব দৃশ্য এখন কুয়াকাটা সৈকত সংলগ্ন উত্তাল সাগরে দেখা যায়। এমন উপভোগ্য সুযোগ শীতে মেলে না; পর্যটক দর্শনার্থীর এমনই অভিমত। বিশেষ করে পারিবারিকভাবে একটু সময় কাটানোর জন্য বেছে নেয়া হচ্ছে বর্ষার কুয়াকাটাকে। আর সাগরের জল লোনা না থাকায় নেমে গোসল করতে আর কারও কোন সংশয় থাকে না। যে সমস্যার কথা ভাবতে হয় শীত মৌসুমে। কারণ মাত্রাতিরিক্ত লবণাক্ত পানি শরীরের জন্য খুবই ক্ষতির কারণ হতে পারে এমন আশঙ্কায়। আর পারিবারিকভাবে এসে শিশুদের নিয়ে এই আশঙ্কা থাকছে না বর্ষার সময়ে। সাগর উত্তাল। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। অনবরত হাল্কা মৌসুমী বায়ুর হানা। যেন আলাদা এক অনুভূতি এনে দেয় মনপ্রাণে। সেই সুযোগটিকে যে জানে সে হাতছাড়া করতে চাইছে না। চলে আসছে বর্ষায় কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে। দেখা মেলে ইলিশ শিকারিদের যুদ্ধ। সাগরের ভয়াল উত্তাল ঢেউ রাশির সঙ্গে এই যুদ্ধ জীবিকার। ছোট্ট ডিঙি নৌকায় চড়ে চলে যায় জেলেরা গভীর সমুদ্রে পাতা জালের কাছে। মাঝে মাঝে দূর থেকে মনে হয় এই বুঝি হারিয়ে গেল জেলের নৌকাটি, গেছে বুঝি ডুবে। কিন্তু না আবার উঁকি দিয়ে উঠছে। এক ঢেউ পেরিয়ে আরেক ঢেউ, এভাবেই এগিয়ে যায় গন্তব্যে। ভয়াল, অথচ অসম্ভব সুন্দর দৃশ্য শুধু বর্ষায় অবলোকনের সুযোগ রয়েছে। আর কখনও নয়। বিচের বেলাভূমিও থাকছে অতি স্বচ্ছ। যেন চোখে দেখা যায় কালো চিক চিক করা বালুকণাটি। খালি হাঁটার সেই আসল সুখের অনুভূতি, তাও বর্ষায় উপলব্ধি করা যায়। কুয়াকাটা সৈকতের শূন্য পয়েন্ট থেকে পুবে কিংবা পশ্চিমে যতদূর বিচের পরিধি সবটাই যেন যায় এক হয়ে। কোথাও কোন অমলিন দৃশ্য চোখে পড়বে না। যারা হঠাৎ করে প্রথমবার বর্ষায় কুয়াকাটায় বেড়াতে আসবে তাদের কাছে মনে হবে এ যেন নতুন অচেনা কুয়াকাটাকে দেখছে প্রথমবারের মতো। বিচ ঘেষা নারিকেল বীথির গাছগুলোকে দেখলে মনে হবে চিরঞ্জীব হয়ে গাঢ় সবুজের রং মিশে দাঁড়িয়ে আছে। শীতে যেসব গাছকে মনে হয় বার্ধক্যে বিবর্ণ। সেই গাছ আভা ছড়াচ্ছে সবুজের, সতেজতায়। হাঁটতে হাঁটতে একইভাবে সুপারি বাগান। ঝাউ বাগান। কড়ই বাগান। সবশেষ গঙ্গামতির নয়নাভিরাম লেক। যেটি শীতের দিনে মনে হয় সোতা খাল। আর বর্ষায় ফিরে আসে যৌবনের গান নিয়ে। অনবরত চলাচল করে মাছ ধরার ট্রলার। খালি পায়ে হাঁটলে মনপ্রাণ যায় শান্ত হয়ে। ভয় থাকে না তপ্ত বালুতে বিরক্তিকর অবস্থার। গা ঝিম ঝিম করে, মাথা পর্যন্ত উপলব্ধি করা যায়। এমন শান্ত অনুভূতি শুধু বর্ষায় বোঝা যায়। শুধু একটু শঙ্কা রয়েছে যদি, আকাশ মেঘলা থাকে হয়ত যাবে না দেখা সন্ধ্যায় পশ্চিম আকাশের সূর্যাস্ত কিংবা ভোরে সমুদ্রস্নাত সূর্যোদয়কে। কিন্তু লটারির মতো ‘যদি লাইগ্যা যায়’ তো ফাটাফাটি। একেবারে স্বচ্ছ, টলমলে ডিমের কুসুমের মতো সমুদ্রের বুক চিরে বের হচ্ছে লাল আভা। অসম্ভব সুন্দরের সেই দৃশ্য, সূর্যোদয়। শীতের কুয়াশা আচ্ছন্নের শঙ্কা নেই। তাই তো শীতের চেয়ে পর্যটকের কাছে এখন বর্ষার কুয়াকাটা অনেক বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। বাড়ছেও পর্যটক দর্শনার্থীর সংখ্যা। পাঁচ/সাত বছর আগে বর্ষায় কুয়াকাটা সৈকত খাঁ খাঁ করত। পর্যটকের পদচারনা ছিল না। চোখে পড়ত না জেলে ছাড়া কাউকে। আবাসিক হোটেল ব্যবসা পর্যন্ত অনেকের বন্ধ থাকত। কিন্তু চিত্র এখন পাল্টে গেছে। আগে বর্ষায় অত্যাধুনিক হোটেলগুলোয় কোন পর্যটক খুঁজে পাওয়া যেত না। থাকত খালি। এখন আর ওই দুরবস্থা নেই। ৫-১০টি কক্ষ ভাড়া হয় প্রত্যেক হোটেলের। আসছে পর্যটক দর্শনার্থী। বর্ষায় আবাসন সমস্যা থাকে না। এ কারণে পরিচিত পর্যটকরা বেছে নেয় বর্ষা মৌসুমকে। অনায়াসে, আগাম বুকিং ছাড়াই সিট পাওয়া যায় হোটেলে। শুধু তাই নয়। ডিসকাউন্ট পাওয়া যায় ভাড়ার ক্ষেত্রে। তাও আবার মিনিমাম ৩০ পার্সেন্ট থেকে কোন কোন ক্ষেত্রে ৪০ পর্যন্ত। রয়েছে অনেক নামকরা রিসোর্ট সেন্টার। সিকদার কিংবা ইলিশ পার্ক। একই সুযোগ খাবার হোটেলগুলোতে। শীত মৌসুমের মতো গলাকাটা দাম নেয়ার সুযোগ নেই। কারণ কাস্টমার কম। তাই আদর ও খাতিরে আপ্যায়ন করায় হোটেল কর্তৃপক্ষ। পরিবহন খাতেও বাড়তি টাকা গুনতে হয় না। পরিবহনে যাত্রী সংখ্যা শীত মৌসুমের চেয়ে কম থাকছে। এখন বর্ষায় কুয়াকাটা আসার কারণে আগের মতো বঞ্চিত হতে হয় না মিশ্রিপাড়ার রাখাইনদের বিশাল বুদ্ধ মূর্তি দর্শন থেকে। কারণ আগে ওই পথের রাস্তাটি মাটির থাকায় বর্ষায় এই সুযোগটি পর্যটকের থাকত অপূর্ণ। যা এখন পৌঁছেছে পূর্ণতায়। সড়কটি পাকা হয়ে গেছে। নির্বিঘেœ আমুদে মেজাজে আপনি সপরিবারে ঘুরে আসতে পারবেন। শুধু তাই নয়, গঙ্গামতি পর্যন্ত ঘুরে আসতে কোন সমস্যা নেই। যোগাযোগ ব্যবস্থার সমস্যা কেটে গেছে। সেখানকার লেকের ওপর দিয়ে যোগাযোগের উন্নত গার্ডার ব্রিজ করা হয়েছে। লেকটি দেখার সুযোগ রয়েছে। ইচ্ছে করলে গঙ্গামতী সৈকতের বেলাভূমে আপনি সপরিবারে বেরিয়ে যেতে পারেন। সেখানে লাল কাঁকড়াদের বিচরণভূমিতে কাটাতে পারেন অনেক সময়। কারণ তাদের সঙ্গে আপনার দৌড়ঝাঁপ করতেই হবে। কাঁকড়াদের মিছিল দেখে ধাওয়া না করেছে এমন পর্যটক নেই। এমন পাবলিক কেউ দেখেনি; গঙ্গামতীর জেলেদের ভাষ্য। তবে একটি কাঁকড়া ধরা খুবই দুরূহ কাজ। কারণ আপনার তাড়া খেয়ে কাঁকড়াগুলো ভোঁ দৌড়ে বালুর মধ্যে নিজস্ব আস্তানায় লুকোবে। যাবে যেন মুহূর্তেই অদৃশ্য হয়ে। মোটকথা এখন আর কুয়াকাটা শুধু শীতকালীন পর্যটনকেন্দ্রিক দৈন্যে আটকে নেই। ১২ মাস উপভোগ্য এক পর্যটন কেন্দ্রে রূপান্তর হয়েছে। পরিপূর্ণ পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত। তাই আপনি বর্ষা মৌসুমকে এখানকার অন্তরায় না ভেবে দ্রুত চলে আসুন কুয়াকাটায়। সুবর্ণ সুযোগকে হাতছাড়া না করে আপনার কোন সঙ্গীকেও বলে রাখুন। -মেজবাহউদ্দিন মাননু, কলাপাড়া থেকে
×