ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অনৈতিহাসিক

দেদার প্রশ্ন ॥ জবাব খুঁজবে কমিশন

প্রকাশিত: ০৯:১৪, ২৪ আগস্ট ২০১৯

দেদার প্রশ্ন ॥ জবাব খুঁজবে কমিশন

মুহম্মদ শফিকুর রহমান ॥ ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ও হতাহতের বিচার হয়েছে বিচারিক আদালতে। রায়ে ১৯ আসামির মৃত্যুদ-, ১৯ আসামির যাবজ্জীবন কারাদন্ড এবং আরও কয়েকজনের বিভিন্ন মেয়াদের সাজা হয়েছে। রায় এখন কনফারমেশনের জন্য হাইকোর্টে রয়েছে। যে ১৯ জনের বিরুদ্ধে মৃত্যুদন্ডের রায় দেয়া হয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছে ওই সময়কার খালেদা জিয়া সরকারের দুই মন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও আবদুস সালাম পিন্টু। যাবজ্জীবন দন্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে রয়েছে হাওয়া ভবন-খোয়াব ভবনের কারবারি খালেদাপুত্র তারেক জিয়া ও খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিস চৌধুরী। আদালতের বিরুদ্ধে কথা বললে কনটেমপ্ট অব কোর্ট হতে পারে, কিন্তু রায়ের ব্যাপারে তো কথা বলাই যায়। কথাটা এজন্য বললাম যে, রায়ে বাবর-পিন্টু ফাঁসির দন্ড অথচ তারেক জিয়ার যাবজ্জীবন, কেমন অসামঞ্জস্য নয় কি? হাওয়া ভবন-খোয়াব ভবনের মূল মালিক তারেক জিয়া এবং বাবর-পিন্টুও সেই হাওয়া ভবনের লোক এবং রীতিমতো মদদপৃষ্ঠ। অথচ রায়টি হলো দু’রকম। কী ঘটেছিল সেদিন? ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে ছিল আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী মিছিলের কর্মসূচী। শেখ হাসিনা মিছিলপূর্ব সমাবেশে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। একটি ট্রাককে মঞ্চ বানিয়ে তার ওপর ওঠে শেখ হাসিনা বক্তৃতা দিচ্ছিলেন এবং বক্তৃতা প্রায় শেষ, এমন সময় একটি বিস্ফোরণের শব্দ হলো। মিনিট পর আরেকটা। এভাবে একটার পর একটা করে ১৫টির মতো গ্রেনেড ছোড়া হলো। পরে জানতে পেরেছি একটি গ্রেনেডের বিস্ফোরণ হয়নি এবং সেটি বিস্ফোরিত হলে কেবল শেখ হাসিনা নন, ট্রাকের ওপরে সব কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। একজনও বাঁচতেন না। গ্রেনেডটি বিস্ফোরিত না হওয়ায় সবাই বেঁচে গেলেও বিস্ফোরিত গ্রেনেডের শব্দে শেখ হাসিনার এক কানের শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কেন্দ্রীয় নেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ নেতা-কর্মী নিহত হন। আহত হন তিন শতাধিক। যাদের মধ্যে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান, সাবেক মন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক, দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ান ও মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত, ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফ স্প্লিন্টারের যন্ত্রণা বয়ে বয়ে দুনিয়া থেকে চলে গেছেন। আহতরা আজও অসহনীয় যন্ত্রণা নিয়ে জীবন ধরে রেখেছেন। অন দ্য স্পট নিহত হন সবার প্রিয় এবং বঙ্গবন্ধু পাগল আদা চাচা। আদা চাচা যেখানেই আওয়ামী লীগের মিটিং-মিছিল হতো আদা চাচা তার মসলা দিয়ে তেলে ভাজা আদার টুকরো বিতরণ করতেন। এই মানুষটি সেদিন নিহত হন। এ কথা আজ পরিষ্কার সেদিন ওই খুনীরা সফল (আল্লাহ না করুন) হলে বাংলাদেশে এক মহাবিপর্যয় ঘটে যেত। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে শেখ হাসিনা দেশের হাল ধরেছেন। আল্লাহ না করুন সেদিন শেখ হাসিনার কিছু হলে বাংলাদেশ রাজনীতিশূন্য হয়ে যেত। আবার পাকিস্তানের মতো মোনায়েম খার বদলে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থাকতেন। অর্থাৎ মিলিটারিরা পরোক্ষভাবে দেশ চালাতেন। দেশে স্বৈরশাসন চলত। অগ্রগতি-উন্নয়ন তো প্রশ্নই ওঠে না। আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ ট্রাকের ওপর ‘মানবঢাল’ তৈরি করে শেখ হাসিনাকে রক্ষা করেছেন। একজন দেহরক্ষী প্রাণ দিয়েছেন। সেই বিপর্যয় থেকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন রক্ষা করেছেন বলেই আজ আমরা আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক অগ্রগতির মহাসড়কে হাঁটছি। এগিয়ে চলেছি সোনার বাংলার পথে। এর আগেও শেখ হাসিনাকে টার্গেট করে অন্তত ১৯ বার হামলা চালানো হয়। চট্টগ্রাম, নাটোর, জামালপুর, ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউ, রাসেল স্কোয়ার, জিরো পয়েন্ট, তোপখানা রোড, বঙ্গবন্ধু ভবন প্রভৃতি স্থানে গুলি-বোমা চালিয়ে তাকে হত্যা করার চক্রান্ত হয়। আল্লাহ তাকে রক্ষা করে চলেছেন এবং তিনি রাষ্ট্র ক্ষমতায় আছেন বলেই: নির্বাচিত সরকার। রাষ্ট্রপরিচালনা করছে। দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। উৎপাদন ৪ কোটি টন। মানুষের বয়সের গড় ৭৩ বছর। শিক্ষার হার ৭৩%। মাথাপিছু আয় ১৯০৯ মার্কিন ডলার। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সাঁইত্রিশ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। জিডিপি টানা ৭%-এর ওপর এবং ৮.১৩%। মূল্যস্ফীতি ৬%-এর নিচে। এখন আমাদের স্যাটেলাইন বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট। শেখ হাসিনার চ্যালেঞ্জ বাঙালীর আত্মমর্যাদার সেতু পদ্মা সেতু সমাপ্তির পথে। কাজ চলছে ঢাকার মেট্রোরেলের, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী টানেলের। বিদ্যুত উৎপাদন এখন ২১০০০ মেঃ ওঃ, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী তথা ৫০ বছর পূর্তিতে ২৪০০০ মেঃ ওঃ, আরও বিদ্যুত চাই কেবল ঘরে ঘরে নয়, একটার পর একটা, শিল্প-কারখানার, এ লক্ষ্যে রূপপুর পারণমাণিক বিদ্যুতকেন্দ্র, গড়ে ওঠেছে গভীর সমুদ্রে পায়রা সমুদ্রবন্দর, ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বড় বড় শহরে একটার পর একটি ফ্লাইওভার। যে বঙ্গসন্তান ২০০৯-এর আগে দেশ ছেড়েছেন এখন ফিরে এসে ঢাকা অচেনা মনে হবে বাংলাদেশ চিনতে পারবেন না বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্র নেতা আজ তাবৎ দুনিয়ার রোল মডেল। ২০২০ সাল থেকে অর্থাৎ ১৭ মার্চ থেকে বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকী মুজিব বর্ষ। তারপরই স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি সুবর্ণজয়ন্তী, দেশব্যাপী যেভাবে দ্রুত কর্মযজ্ঞ চলছে। মাইকেল মধু কবি বেঁচে থাকলে এখন শিখতেন ‘দাঁড়াও পথিকবর জন্ম যদি তব সাত সাগরের ওপারে তিষ্ট ক্ষণকাল চা খাও একখিলি পান খেয়ে যাও আমাদের মিষ্টি পান আছে রঙের বাহার চা আছে একটুখানি বসে যাও শরীর মন জুড়িয়ে-যাও তারপর বারবার আসবে পান খেয়ে যাবে।’ আমি বলেছিলাম না, ‘হে বঙ্গভা-ারে তব বিবিধ রতন’ এখানে তলে মাণিক্য খুঁজে পাবে। আমাদের আছে পদ্মার ইলিশ, মেঘনা-ডাকাতিয়ার গলদা চিংড়ি কী চাও পাবে তবে লুণ্ঠনের চিন্তা মাথা থেকে তাড়িয়ে দিও জেনে রেখো আমাদের রাষ্ট্রনেতা শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুকন্যা এ আমাদের কেবল অহংকার নয় আত্মবিশ্বাস আর আত্মমর্যাদার সোনালি উদ্বোধন। পাঠক, আজ বলব ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা, ৩ নবেম্বর চার জাতীয় নেতাকে হত্যা; বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে ২০০৪ সালে গ্রেনেড হামলা এবং হত্যা-সবই একই টার্গেটের ধারাবাহিকতা। কারণ, বঙ্গবন্ধুর পর শেখ হাসিনা জাতি রাষ্ট্রের দায়িত্ব নিয়েছিলেন বলেই আজ সাত সমুদ্রের ওপারের পর্যটকরা থমকে দাঁড়াচ্ছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব ও অপ্রতিরোধ্য অগ্রাযাত্রাকে স্তব্ধ করে দেয়ার জন্যই ওইসব হত্যাকা- এবং মোট ২১ বার শেখ হাসিনার ওপর এত হামলা। ওইসব হত্যাকা- বা সিরিয়াল কিলিং এবং এ চেষ্টার বিচার হয়েছে। কিন্তু হত্যাকা-ের পেছনের কুশীলবরা এখনও পর্দার অন্তরালে রয়ে গেছে। এদের মুখোশ উন্মোচন করার জন্যই তদন্ত কমিশন করা জরুরী। প্রয়োজনে বাংলাদেশের চীফ জাস্টিসের নেতৃত্বে কমিশন করা যায় কিনা ভেবে দেখা যেতে পারে। বিকল্প প্রস্তাবও আছে যে, জাতীয় সংসদের স্পীকারের নেতৃত্বে পার্লামেন্টারি তদন্ত কমিশন গঠন করা যায় কি-না ভেবে দেখা যেতে পারে। চক্রান্তকারীদের মুখোশ উন্মোচন করা না গেলে তারা বসে থাকবে না, তারা চক্রান্তের ছোবল মারার চেষ্টা করবে। এরই মধ্যে অনেক প্রশ্ন সামনে এসেছে। প্রশ্ন পরিষ্কার হলে উত্তর খুঁজে পাওয়া দুরূহ হবে না। প্রশ্ন : ১. বঙ্গবন্ধু হত্যার আগে ফারুক-রশিদ মিলিটারি জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে তার ক্যান্টনমেন্টের বাসভবনে যায় এবং তাদের অভিপ্রায়ের কথা প্রকাশ করলে জিয়া বলেছিলেন (যা অনেকের মুখে মুখে) ‘I am a senior army Officer, I cant involve directly. It you are serious go ahead... GB cant involve directly অর্থ indirectly আছি কিংবা go ahead’-এর পরের কথা হলো ‘তোমরা আগে আমি পেছনে।’ ২. জিয়া তখন আর্মি ডেপুটি Chief of Staff, তার তো কাজ ছিল সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপতি তথা তার সুপ্রীম কমান্ডার অব আর্ম ফোর্সেসকে ইনফর্ম করা এবং ফোর্স নিয়ে নিরাপত্তা দেয়া। তিনি এই দুই কাজের একটাও করেননি। ৩. স্বাধীনতার পর জিয়া যখন খালেদা জিয়াকে ঘরে তুলছিলেন না তখন খালেদা জিয়া ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে আসেন। বঙ্গবন্ধু জানতে পেরে জিয়াকে ডেকে খালেদাকে তার হাতে তুলে দেন নিজের মেয়ে বলে। তখন জিয়ার জন্য Deputy Chief of Army Staff-এর পদও সৃষ্টি করা হয়। ফারুক-রশিদরা দেখা করার সময় খালেদা জিয়া কি ক্যান্টনমেন্টের বাড়িতে ছিলেন না? থাকলে তিনি কেন বঙ্গবন্ধুকে জানালেন না? ৪. ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পর খালেদা জিয়া দৈনিক প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানকে ডেকেছিলেন। মতি ভাই তার কাগজে এবারের ২১ আগস্ট ‘এমন নৃশংস ঘটনা আর চাই না’ শিরোনামে ফ্রন্ট পেজে একটি মন্তব্য প্রতিবেদন লেখেন। তাতে এক জায়গায় তিনি উল্লেখ করেন ‘...এক পর্যায়ে খালেদা জিয়া উত্তেজিত ভাষায় বলেছিলেন, আওয়ামী লীগকে কিছু করতে দেয়া হবে না, প্রয়োজনে শায়েস্তা করা হবে। এবং কিছুতেই ৯৬ সালের অবস্থা তৈরি করতে দেয়া হবে না।’ ৫. এরই ধারাবাহিকতায় দেখা যায়, এখানেই শেষ নয়। সংসদে তিনি বলেন, শেখ হাসিনা ভ্যানিটি ব্যাগে করে গ্রেনেড নিয়ে সমাবেশে যান এবং তা-ই বিস্ফোরিত হয়। খালেদা জিয়াকে তখন টেবিল চাপড়ে আনন্দ প্রকাশ করতে দেখা গেছে। ৬. বিচারপতি জয়নুল আবেদীনকে দিয়ে বশংবদ ওয়ানম্যান তদন্ত কমিশন গঠন করেন, যিনি রিপোর্টে ভারতের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, পাশের দেশ থেকে এসে গ্রেনেড হামলা করা হয়েছে। ৭. তারেক জিয়ার হাওয়া ভবনে বসে যখন গ্রেনেড হামলার চক্রান্ত হয় তখন কি খালেদা জিয়া জানতেন না? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্যই তদন্ত কমিশন গঠন করা জরুরী। প্রথম আলো এবং সম্পাদক মতিউর রহমান, মতি ভাইকে ধন্যবাদ যে, তিনি তদন্তের অনেক সূত্র তার ২১ আগস্টের ‘মন্তব্য প্রতিবেদনে’ তুলে ধরেছেন। ঢাকা ২৩ আগস্ট ২০১৯ লেখক : সংসদ সদস্য, সাবেক সভাপতি ও সাঃ সম্পাদক জাতীয় প্রেসক্লাব। [email protected]
×