ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শংকর লাল দাশ

বঙ্গোপসাগরে বরিশালের কামান রহস্য !

প্রকাশিত: ১৩:৪১, ২৩ আগস্ট ২০১৯

বঙ্গোপসাগরে বরিশালের কামান রহস্য !

‘বরিশালের কামান’ বঙ্গোপসাগর গভীরের এক অজানা রহস্য। উপকূলের মানুষের মাঝে এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে অসংখ্য প্রবাদ-প্রবচনের সৃষ্টি হয়েছে। মানুষ ভয়ে আতঙ্কিত হয়েছে। কমবেশি গবেষণাও হয়েছে। আঞ্চলিক ইতিহাসের রচয়িতারাও এ নিয়ে লেখালেখি করেছেন। কিন্তু তারপরেও কয়েক শ’ বছরেও সে রহস্যের কিনারা হয়নি। যদিও গত তিন-চার দশকে সে শব্দের ভয়াবহতা অনেক কমে গেছে। এখন কোন কোন বছরে এ শব্দ প্রায় শোনা যায় না বললেই চলে। তারপরও এ নিয়ে রহস্যের যেন শেষ নেই। বঙ্গোপসাগর যুগ যুগ ধরে উপকূলের মানুষের কাছে রহস্যের খনি। নানা বিষয় নিয়ে এসব রহস্য একের পর এক ডালপালা ছড়িয়েছে। এর কোনটা ভীতি ছড়িয়েছে। আবার কোনটা রোমাঞ্চের সৃষ্টি করেছে। তেমনই একটি রহস্য গভীর সমুদ্রে কামানের মতো বিকট গর্জনের শব্দ। আষাঢ়-শ্রাবণে আকাশ থেকে নেমে আসা অজ¯্র ধারার বারি বর্ষণের সঙ্গে বঙ্গোপসাগরের গভীর থেকে উঠে আসতো সে গর্জন। গোটা বর্ষাকাল জুড়ে সে শব্দ ছড়িয়ে যেত উপকূলের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। এমনকি একটা সময়ে বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন অখ- চব্বিশ পরগনা এলাকাতেও সে শব্দ শোনা যেত বলে কোন কোন আঞ্চলিক ইতিহাসে তথ্য রয়েছে। সাতক্ষীরা, যশোর, খুলনা থেকে শুরু করে পূর্ব প্রান্তের উপকূলীয় চট্টগ্রাম, এমনকি বর্তমান মায়ানমারেও সে শব্দ পৌঁছে যেত। উপকূলের বহ প্রবীণ মানুষের সঙ্গে আলাপ করে এবং বিভিন্ন আঞ্চলিক ইতিহাস থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, যশোর, খুলনা এবং চব্বিশ পরগনা জেলা থেকে মনে হতো, গভীর বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব কোণ থেকে থেমে থেমে ভেসে আসছে কামানের মতো গুরুগম্ভীর অথচ ভয়াবহ বিকট গর্জন। আবার বরিশাল অঞ্চল থেকে মনে হতো, সোজা দক্ষিণ থেকে বঙ্গোপসাগরের গভীর হতে ওই শব্দ উঠে আসছে। চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে মনে হতো পশ্চিম-দক্ষিণ কোণ থেকে আসছে শব্দ। যেহেতু বরিশালের সোজা দক্ষিণ থেকে শব্দ আসছে, তাই উপকূলের বাসিন্দারা এ শব্দকে ‘বরিশালের কামান’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। ইংরেজ শাসকরা বলতো ‘ ইধৎরংযধষ এঁহং’। পুরো বর্ষাকাল জুড়ে এ শব্দ শোনা যেত। শব্দের ভয়াবহতা উপকূলের মানুষের মাঝে বিভিন্ন ধরনের প্রবাদ-প্রবনের সৃষ্টি করেছিল। অনেকে মনে করতো-গায়েবি বা দৈব আওয়াজ। অনেকের কাছে এটি ছিল লঙ্কা দ্বীপে রাবন রাজের বিশাল তোরণদ্বার খোলা বা বন্ধ করার শব্দ। আবার অনেকের কাছে এটি ছিল কোন এক ইমামের আগমন বার্তা। পীর-মুর্শিদদের নিয়ে নানা কল্পকাহিনীতো ছিলই। এ শব্দের সময়ে জেলেরা গভীর সাগরে খুব কম যেত। উপকূলের নারীরা শব্দের আওয়াজ শুনিয়ে শিশুদের ঘুম পাড়াত। রাতের বেলা মানুষ বিশেষ প্রয়োজন না হলে ঘরের বাইরে যেত না। উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে-শব্দটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রাতের বেলাতেই বেশি শোনা যেত। আর তা উপকূলে এক ধরনের ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করতো। শব্দের এ রহস্য খুঁজতে গিয়ে কেউ কেউ বলেছেন, বরিশালের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের গভীরে রয়েছে ‘সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড’। যার তলদেশের গভীরতা দেড়-দুই হাজার ফুট কিংবা আরও বেশি। অতলস্পর্ষী এ গভীরতায় পূর্ব-পশ্চিম দিক হতে বিপরীতমুখী ¯্রােতের সংঘাতে এ আওয়াজের সৃষ্টি হয়। অনেকে বলেছেন, মায়ানমার উপকূলের ভূ-গর্ভে একটি সুপ্ত আগ্নেয়গিরি রয়েছে। এর সঙ্গে ওই আওয়াজের সম্পর্ক রয়েছে। আবার কেউ কেউ বলেছেন, এটি বায়ুম-লের কোন বৈদ্যুতিক ব্যাপার। গভীর সমুদ্রে বরিশালের কামান নিয়ে বিভিন্ন জনদের এমন ধরনের বিভিন্ন ধারণা থাকলেও বাস্তবতা হচ্ছে-আওয়াজের উৎস কিংবা এর সঠিক কারণ আজও নির্নয় করা যায়নি। এটি উপকূলের মানুষের কাছে আজও এক গভীর রহস্য। যা কেবল বর্ষাতেই বিকশিত হয়। যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শব্দ অনেকটাই স্থিমিত হয়ে এসেছে। কোন কোন বছরে একেবারেই শোনা যায় না।
×