ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কথাশিল্পী রিজিয়া রহমানের চলে যাওয়া

প্রকাশিত: ১৩:৩৯, ২৩ আগস্ট ২০১৯

কথাশিল্পী রিজিয়া রহমানের চলে যাওয়া

বিশিষ্ট সাহিত্যিক রিজিয়া রহমান আর নেই। গত শুক্রবার রাজধানীর এ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি চিরদিনের মতো বিদায় নেন। ৮০তে পা দেয়া এই অভিজ্ঞ শিল্প ব্যক্তিত্ব বার্ধক্যজনিত হরেক রকম জটিলতায় জীবনের শেষ সময়গুলো কাটান। ১৯৩৯ সালে জন্ম নেয়া এই নারীর শৈশব-কৈশোর অতিক্রান্ত হয় কলকাতায়। সময়টা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা পর্ব। অস্থির সময়ের উন্মুক্ত যুদ্ধের বিক্ষুব্ধ আবহে নিজের বাল্য জীবনের ক্রান্তিলগ্নে বাবার সঙ্গে বাংলাদেশে চলে আসেন। ফলে লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয়েছে পিতার কর্মস্থল ফরিদপুরে। পিতা আবুল খায়ের মোহাম্মদ সিদ্দিক ছিলেন পেশায় একজন চিকিৎসক। বাবার আদুরে কন্যাকে সম্বোধন করা হতো জোনাকী নামে। সেই জোনাকীই বাংলার সাহিত্য গগনে আলো বিকিরণ করে নিজেকেসহ মাতৃভাষার ভা-ারকে দ্যুতিময় করেছেন। চিকিৎসক বাবার চাকরির কারণে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হয়। ফলে জোনাকীর লেখাপড়ায় নিরবচ্ছিন্ন গতি সেভাবে দৃশ্যমান না হলেও উচ্চ শিক্ষাকে নিজের আয়ত্ত আনতে শেষ অবধি পেরেছিলেন। ইতোমধ্যে ১৯৫২ সালে স্নেহময় বাবার চিরতরে চলে যাওয়া কোন এক কিশোরীর জীবনে যে ভাঙ্গা-গড়ার পালাক্রম শুরু হয় রিজিয়া রহমান ছিলেন তারই যথার্থ নজির। এরপর মাতুলালয়ে মামার কর্মস্থল চাঁদপুরে এসে পুনরায় বিদ্যার্জনের পর্বটা শুরু হয়। এখানেই এক মাধ্যমিক স্কুলে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হলেও মাধ্যমিক পাস করেন প্রাইভেটে। এর পরেই বিয়ের সানাই বেজে ওঠে। বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হলেন খনিজ ভূতত্ত্ববিদ মোঃ মিজানুর রহমানের সঙ্গে। স্বামীর কর্মস্থল পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে তাকে চলে যেতে হয়। সেখানে কোয়েটা সরকারী কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়াশোনা শুরু করলেও শেষ অবধি বিভিন্ন অসঙ্গতির কারণে পরীক্ষা দেয়াই হয়নি। পরবর্তীতে ইডেন কলেজে এসে উচ্চ মাধ্যমিক এবং স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন। জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত, চড়াই-উতরাইয়ের পালাক্রমে কোন এক সময় নিজেকে যোগ্য হিসেবেও প্রমাণ করলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী দেয়া এই পরিশ্রমী নারী ব্যক্তিত্ব কিভাবে তার সৃজনসত্তার পথযাত্রাকে অবারিত করেন সেও এক গৌরবময় ঘটনাপরম্পরা। ষাটের দশকে শিল্পসত্তায় সমৃদ্ধ এই সৃজন প্রতিভা তার লেখনীকে নানাভাবে পাঠককে উপহার দিতে থাকেন। সময়টা ছিল পাকিস্তানী শাসনের এক বিভীষিকাময় অধ্যায়ের অশুভ সঙ্কেত। একজন সচেতন সৃজন রূপকার হিসেবে সমকালীন সমাজ, নারী স্বাধীনতা, মাতৃভাষার প্রতি গভীর মমত্ববোধ সঙ্গে দেশপ্রেমের এক অনির্বাণ শিখা তার ক্ষুরধার লেখনীকে সব সময় উজ্জীবিত করে যেত। সময়ের জয়গান গেয়ে ঐতিহ্যকেও ধারণ করতে পারতেন যা যুগোত্তীর্ণ কোন মননশিল্পী চিরস্থায়ী আকাক্সক্ষা। নারীর লেখকের সীমাবদ্ধ প্রত্যয়ের অতিক্রম করে এই সাহসী কথাসাহিত্যিক নিজেকে তুলে ধরেছেন একজন মানুষ হিসেবে। সমাজের বিচিত্র অলিগলিতে বিচরণ করা এই প্রতিভাময়ী শিল্পী দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকেও তার সাহিত্যের মূল শক্তিতে সমর্পণ করেছে। আর অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীদের প্রতিও ছিল তার সচেতন দায়বদ্ধতা। ‘রক্তের অক্ষর’ উপন্যাস সেই নির্যাতন, নিগ্রহের করুণতম আখ্যান। মাতৃভাষাই ছিল তার শিল্পচর্চার গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। সেই বোধে তার রং থেকে বাংলা গ্রন্থটি আজও ঐতিহ্যকে ভাবসম্পদের এক অবিমিশ্র মিলন। গ্রামবাংলার তাঁতশিল্পের ঐতিহ্যিক ধারাও রিজিয়া রহমানের কাহিনীর অনুষঙ্গ হয়েছে। শুধু তাই নয় ক্ষয়িষ্ণু এই শিল্পের কারিগরি তাঁর মনন ও সৃজন দ্যোতনাকে দ্যুতিময়ও করেছে। একজন স্বনামধন্য, সচেতন সাংবাদিক হিসেবেও তার কৃতিত্ব বহুল আলোচিত। ‘ত্রিভুজ’ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে তার কর্মজীবনের শুভ সূচনা হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তা সম্প্রসারিত হতেও সময় লাগেনি। জাতীয় জাদুঘরের পরিচালনা বোর্ডের ট্রাস্টি ও জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রের কার্যপরিচালক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয়ে যে দক্ষতা এবং বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন তার মূল্যও কোনভাবেই কম নয়। এ ছাড়াও বাংলা একাডেমির কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য হিসেবেও সচেতনতা এবং দায়বদ্ধতার পরিচয় রেখে গেছেন সফলভাবে। শুধু পুরস্কার কিংবা সম্মাননা দিয়ে কোন বিজ্ঞ মানুষের বৃহৎ ও মহৎ কর্মসাধনা বিচার করা হয় না। তার পরেও যখন শ্রেষ্ঠত্বের বিচারে কোন শিল্পী তার স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হন, তার সৃজন শৌর্য যখন জ্ঞানী-গুণী প-িতদের বিবেচনায় শীর্ষে ওঠে আসে তখন তো পুরস্কার তার কর্মসাধনাকে আলোকিত করে দেয়। রিজিয়া রহমানও সেই মাপেরই এক শৈল্পিক সত্তা যিনি কিনা তার সৃজনসম্ভারে নিজেকে অনেক ওপরে নিয়ে গেছেন। ফলে অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা বিচিত্র ও বর্ণাঢ্য জীবনকে অভিষিক্ত করেছে। ‘বাংলা একাডেমি পুরস্কার’, ‘একুশে পদক’ ‘অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার’ ‘নাসির উদ্দিন স্বর্ণপদক’Ñ এসব অসামান্য প্রাপ্তিও তার সাহিত্যিক জীবনকে নানামাত্রিকে ভরিয়ে তুলেছে। তার তিরোধান আমাদের জন্য এক বড় ধরনের শূন্যতা। কেউ কারও আসন পূর্ণ করতে পারে না। প্রত্যেকেই তার জায়গা তাকেই করে নিতে হয়। শক্তভাবে নিজের অবস্থান তৈরি করা এই বিরল সৃজন ব্যক্তিত্ব তার শিল্পীসত্তায় যে চিরস্থায়ী বোধ সবাইকে উপহার দিয়ে গেলেন মরণের পরও তার আবেদন কোনভাবেই কমবে না। মানুষ মরণশীল। সবাইকে একদিন চলে যেতে হবে। কিন্তু কিছু মানুষ তো শারীরিকভাবে অন্তর্ধান হলেও মানসিক সম্পদে সবাইকে পূর্ণ করে রাখেন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়Ñ জীবনের যাত্রাপথে যাত্রীদল চলে, বিরাম বিরতিহীন কে বা মনে রাখে। তবু তারি মাঝে ক্ষণিক দাঁড়ায়ে স্মৃতির ফলকে যারা পদচিহ্ন রাখে, তারা মনে থাকে।
×