ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পরিমাণে বাড়লেও এবার খেলাপী ঋণের হার কমেছে

তিন মাসে খেলাপী বেড়েছে দেড় হাজার কোটি টাকা

প্রকাশিত: ০৯:২৯, ২৩ আগস্ট ২০১৯

তিন মাসে খেলাপী বেড়েছে দেড় হাজার কোটি টাকা

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ ঋণ খেলাপীদের নানা সুবিধার ঘোষণার মধ্যেই ব্যাংক খাতের মোট খেলাপী ঋণ বেড়েছে। তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপী ঋণ বেড়েছে দেড় হাজার কোটি টাকা। মোট খেলাপী ঋণ এক লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে, যা এ যাবতকালের রেকর্ড। পরিমাণে বাড়লেও এবার খেলাপী ঋণের হার কমেছে। ব্যাংকাররা বলছেন, সাধারণত বছরের প্রথম ও দ্বিতীয় প্রান্তিক অর্থাৎ মার্চ ও জুনে খেলাপী ঋণ কিছুটা বাড়ে। এর কারণ ডিসেম্বরে বছর শেষের হিসাব হয় বিধায় ব্যাংকগুলো পুনর্তফসিল বাড়িয়ে দেয়। ঋণ আদায়েও বাড়তি চেষ্টা থাকে। এর বাইরে অন্য কারণও রয়েছে। যেমন- এ বছর ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঘোষিত ঋণ পরিশোধের বিশেষ সুবিধা নেয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন। এ কারণে মোট খেলাপী ঋণ বেড়েছে। যদিও যেসব সুবিধা ঘোষণা করা হয়েছে তা এখনও কার্যকর হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিক শেষে (মার্চ-জুন) মোট খেলাপী ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ১২ হাজার ৪২৫ কোটি ১৭ লাখ টাকা, যা ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের ১১ দশমিক ৬৯ শতাংশ। এর আগের প্রান্তিক অর্থাৎ মার্চ মাস শেষে খেলাপী ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১০ হাজার ৮৭৩ কোটি ৫৪ লাখ টাকা, যা ওই সময়ের বিতরণ করা ঋণের ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ। জানতে চাইলে একটি বেসরকারী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, অনেক গ্রাহক ডিসেম্বরে ঋণ পুনর্তফসিল করেছিলেন। কিন্তু পরের তিন মাস নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করতে পারেননি। নতুন করে তারা খেলাপী হয়ে পড়ায় প্রথম প্রান্তিতে মোট খেলাপী ঋণ বেড়েছে। আবার দ্বিতীয় প্রান্তিতে এসে অনেকাংশেই কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গবর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, মার্চ প্রান্তিকের পর জুন প্রান্তিকেও খেলাপী ঋণ বাড়ার অন্যতম কারণ হলো, গত ডিসেম্বর প্রান্তিকে ব্যাংকগুলো অনেক খেলাপী ঋণ কৌশলে লুকিয়ে রাখে। কারণ ডিসেম্বর মাস ব্যাংকের বার্ষিক হিসাবের সমাপনী প্রান্তিক হওয়ায় খেলাপী ঋণ কম হলে ব্যাংকের লাভ। লুকিয়ে রাখা এসব খেলাপী ঋণ জুন প্রান্তিকে হিসাবে ঢুকেছে। তিনি আরও বলেন, ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা দুর্বলতার কারণে অনেক বছর ধরেই খেলাপী ঋণ বাড়ছে। এটা কমানোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণকে খেলাপী হিসেবে শ্রেণীকৃত করার সময়সীমা বাড়িয়েছে। যদিও নিয়ম শিথিলের এই প্রভাব মার্চ প্রান্তিকে পড়েনি। আগামী সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে পড়বে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক যা করেছে তা একটা ভুল পদ্ধতি। এতে প্রকৃত অর্থে খেলাপী ঋণ কমবে না বলে তিনি মনে করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বেসরকারী ব্যাংকগুলোতে খেলাপী ঋণের পরিমাণ অনেক বেড়েছে। তিন মাসের ব্যবধানে বেসরকারী ৪০ ব্যাংকে খেলাপী ঋণ ১ হাজার ৯৭৪ কোটি টাকা বেড়েছে। জুন শেষে বেসরকারী ব্যাংকে মোট খেলাপী ঋণ ৫১ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা, যা এসব ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের ৭ দশমিক শূন্য ১৩ শতাংশ। গত মার্চ শেষে বেসরকারী ব্যাংকে খেলাপী ঋণের পরিমাণ ছিল ৪৯ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা, যা ওই সময়ে তাদের বিতরণ করা ঋণের ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। জুন শেষে রাষ্ট্র মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মোট খেলাপী ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৩ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা, যা তাদের বিতরণ করা ঋণের ৩১ দশমিক ৫৮ শতাংশ। এর আগের প্রান্তিকে এসব ব্যাংকের মোট খেলাপী ঋণ ছিল ৫৩ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকা, যা ওই সময়ের বিতরণ করা ঋণের ৩২ দশমিক ২০ শতাংশ। সে হিসেবে গত মাসে খেলাপী ঋণ কমেছে ১৩৫ কোটি টাকা। জুন শেষে বিদেশী ৯ ব্যাংকের খেলাপী ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৫৭ কোটি ৬২ লাখ টাকা, যা ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের ৫ দশমিক ৪৮ শতাংশ। গত মার্চ শেষে এসব ব্যাংকে মোট খেলাপী ঋণ ছিল ২ হাজার ২৫৬ কোটি ৫১ টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৬ দশমিক ২০ শতাংশ। আর দুই বিশেষায়িত ব্যাংকের (কৃষি ও রাকাব) খেলাপী ঋণের পরিমাণ ৪ হাজার ৬৯৮ কোটি ৮৩ লাখ টাকা, গত মার্চ শেষে যা ছিল ৪ হাজার ৭৮৭ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। ব্যাংক দুটির বিতরণ করা ঋণের ১৯ দশমিক ১৭ দশমিক ৮২ শতাংশ খেলাপী। ব্যাংক খাতে উচ্চমাত্রার খেলাপী ঋণ নিয়ে অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা মহলে ব্যাপক সমালোচনা রয়েছে। আ হ ম মুস্তফা কামাল অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই খেলাপী ঋণ কমানোর বিষয়ে ব্যাপক সরব। খেলাপী ঋণ কমাতে এরইমধ্যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। গত ২১ এপ্রিল বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ শ্রেণীকরণ ও প্রভিশনিং বিষয়ে নতুন নীতিমালা জারি করে। এতে খেলাপী হওয়ার সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত ১৬ মে তারিখে ঋণ পুনর্তফসিল ও এককালীন ঋণ পরিশোধ সংক্রান্ত বিশেষ নীতিমালা জারি করে। এর মাধ্যমে মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ৯ শতাংশ সুদে ১০ বছরে (এক বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ) পরিশোধের সুবিধা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। সার্কুলারে বলা হয়, ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বরভিত্তিক মন্দমানের শ্রেণীকৃত ঋণের ক্ষেত্রে এই সুবিধা দেয়া যাবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকৃত অর্থেই খেলাপী ঋণ কমানোর ওপর জোর দিতে হবে। এ জন্য ঋণ বিতরণে স্বচ্ছতা দরকার। গ্রাহককে যথাযথভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে। ব্যাংকের পরিচালক বা রাজনৈতিক প্রভাবে গ্রাহকের বিচার করলে হবে না। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পুরোপুরিভাবে স্বাধীনতা দিতে হবে।
×