ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বাঙালীর কালজয়ী এক আদর্শ

প্রকাশিত: ০৯:০৬, ২৩ আগস্ট ২০১৯

বাঙালীর কালজয়ী এক আদর্শ

১৯৭১ সালের ২৩ আগস্ট দিনটি ছিল সোমবার। আজকের বাংলাদেশে শেখ মুজিব কোন ব্যক্তির নাম বা কোন দলীয় প্রধান নয়, শেখ মুজিব এক কালজয়ী আদর্শ, এই আদর্শের আলোকে অনাগত ভবিষ্যতের অগণিত নিপীড়িত জনতা পথ খুঁজে নেবে। বিশ্বের যেখানে অত্যাচার, অনাচার, সাম্রাজ্যবাদী শোষণ-শাসন, ফ্যাসিবাদী নির্যাতন, নির্মম আঞ্চলিক বৈষম্য বিরাজমান, সে সব এলাকার মানুষের জন্য মুজিব শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার বিমূর্ত প্রতীক। কুমিল্লায় মেজর জাফর ইমামের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা দল চিয়ারা গ্রামে অবস্থানরত পাকসেনাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে পাকসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং ২৪ জন পাকসেনা নিহত হয়। কিছু পাকসেনা আহত অবস্থায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। মুক্তিবাহিনী কুমিল্লায় পাকসেনাদের জগন্নাথ দিঘি ঘাঁটি আক্রমণ করে। এই আক্রমণে পাকবাহিনীর চারটি বাঙ্কার ধ্বংস হয় ও অনেক পাকসেনা হতাহত হয়। আক্রমণ শেষে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদে নিজ ঘাঁটিতে ফিরে আসে। ২নং সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর ৪র্থ বেঙ্গলের ‘এ’ ও ‘সি’ কোম্পানি পাকসেনাদের নয়নপুর রেলস্টেশন অবস্থানের ওপর উত্তর ও দক্ষিণ দিক থেকে মর্টার ও ১০৬ রিকয়েলেস রাইফেলের সাহায্যে অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে পাকবাহিনীর কয়েকটি শক্ত বাঙ্কার বিধ্বস্ত হয় এবং অনেক পাকবর্বর হতাহত হয়। কুমিল্লায় পাকসেনাদের একটি নৌকা সেনেরবাজার ঘেঁষে আসতে থাকলে মুক্তিবাহিনীর এ্যামবুশ দল শত্রু নৌকাটির ওপর গুলিবর্ষণ করে। এতে ৭ জন পাকসৈন্য নিহত হয়। অবশিষ্ট সেনারা নৌকাটিকে তাড়াতাড়ি পশ্চিম তীরে ভিড়িয়ে নৌকা থেকে নেমে গ্রামের দিকে পালিয়ে যায়। ৭নং সেক্টরে ক্যাপ্টেন ইদ্রিস ও সুবেদার মেজর মজিদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদল পাকবাহিনীর কানসাট অবস্থানের ওপর তীব্র আক্রমণ চালায়। হামজাপুর সাব সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন ইদ্রিছ একটি কোম্পানি নিয়ে সুবেদার মেজর মজিদের সাহায্যার্থে আসেন। পরিকল্পনা অনুসারে ক্যাপ্টেন ইদ্রিছ এবং সুবেদার মেজর মজিদ প্রায় দুটি কোম্পানি নিয়ে কানসাটে অবস্থানরত প্রায় এক কোম্পানি পাকসেনার ওপর আঘাত হানেন। প্রায় চারঘণ্টা স্থায়ী এই ভয়াবহ যুদ্ধে পাকবাহিনীর প্রচুর সৈন্য হতাহত হয় ও ব্যাপক ক্ষতি হয়। উভয়পক্ষের তুমুল সংঘর্ষে কানসাট মুক্তিবাহিনীর দখলে এলেও কিছুক্ষণের মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে সাহায্যকারী দল ঘটনাস্থলে এসে পড়ায় মুক্তিবাহিনীকে কানসাট ছেড়ে চলে আসতে হয়। এ সংঘর্ষে অসংখ্য পাকসেনা হতাহত হয় বলে জানা যায়। ঢাকায় প্রাদেশিক সরকারের জনৈক মুখপাত্র বলেন, বেআইনী ঘোষিত আওয়ামী লীগের টিকিটে নির্বাচিত সব সদস্যকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ৮৮ জন এম.এন.এ. ও ৯৪ জন এম.পি.এর বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ পাওয়া যায়নি। ফলে তাদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এই সঙ্কটময় মুহূর্তে অর্পিত দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসতে তাদের দ্বিধাবোধ করা উচিত নয়। সরকার তাদের পূর্ণ নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়েছেন। লন্ডনে পিডিপি নেতা মাহমুদ আলী বলেন, ‘আমি প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে বলছি, পত্র-পত্রিকায় যা প্রকাশিত হয়েছে পরিস্থিতি ঠিক তার বিপরীত। বিচ্ছিন্নতাবাদীরা যে সব প্রশ্ন তুলেছেন তা ঠিক নয়। ২৪ বছরের পাকিস্তানী শাসনে দেশের অনেক উন্নতি হয়েছে। মিল, কলকারখানা, ডকইয়ার্ড প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তান বাঙালী অফিসারদের দ্বারা পরিচালিত হয়। কেন্দ্রেও বাঙালীরা উচ্চপদে রয়েছে। হাতিয়ার নলচিরা বাজার জামে মসজিদে এলাকার দালালরা একত্র হয়। এতে মাহমুদুর রহমানকে সভাপতি, সৈয়দ আহমদ খানকে সম্পাদক এবং মৌলভী ছালেহ উদ্দিনকে যুগ্ম সম্পাদক করে নলচিরা ইউনিয়ন শান্তি কমিটির কার্য নির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়। টাইমস ম্যাগাজিনে লেখা হয়, ‘যদিও পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতার জন্য মুজিবকে অভিযুক্ত করা হয়, প্রকৃত পক্ষে তিনি পাকিস্তানের পূর্ণ বিভক্তি চাননি এবং ততক্ষণ পর্যন্ত স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি যতক্ষণ না রক্তগঙ্গা শুরু হয়।’ নিউজ উইকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যখন সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রে গ্রোমেইকো গত সপ্তাহে নয়াদিল্লী গেলেন, স্থানীয় কূটনীতিক গোষ্ঠী বলতে গেলে খেয়ালই করেনি। কিছু ভিনদেশী দূতদের ভারতীয় কর্মকর্তাগণ আশ্বস্ত করেছিলেন এই বলে যে গ্রোমেইকোর সফরে তেমন বিশেষ কিছু ফলতে যাচ্ছেনা। তবে আগমনের এক দিনের মধ্যেই রাশিয়ার এক নম্বর কূটনৈতিক গ্রোমেইকো জানিয়েছেন যে তিনি ভারতের রাজধানীতে জরুরী এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজে এসেছেন। নয়াদিল্লীর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পতাকাখচিত টেবিলে বসে গ্রোমেইকো সফল স্বাক্ষর করেন ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যেকার বিশ বছরের শান্তি, বন্ধুত্ব, ও সহযোগিতার এক চুক্তিতে। বাহ্যিকভাবে চুক্তির কথাগুলো এত স্থুল ছিল যে, এক পশ্চিমা বিশ্লেষকের মতে, এটি কার্যত যে কোন কিছুই বোঝাতে পারে। তবে এই চুক্তির গুরুত্ব অল্পই নির্ভর করছে। এতে কি বলা হয়েছে বা এর দ্বারা কি বোঝানো হয়েছে তার ওপর। আরেকটি পরাশক্তির সঙ্গে আনুষ্ঠানিক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে ভারত তার জোটবদ্ধ না হওয়ার নীতি থেকে অনেকখানি দূরে সরে এসেছে। দৃঢ়ভাবে ভারতের সমর্থনে এগিয়ে এসে রাশিয়া পাকিস্তানকে যে কোন বেপরোয়া পদক্ষেপ নেয়ার বিরুদ্ধে সাবধান করে দিল। অবশ্য, এর মাধ্যমে মস্কো খোলামেলাভাবে চীনের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান ঘোষণা করল এবং দক্ষিণ এশিয়াতে হঠাৎ করেই শক্তির ভারসাম্য বদলে দিল। একই ধারাবাহিকতায়, এ চুক্তি এতদাঞ্চলে আমেরিকার প্রভাব প্রতিপত্তি খর্ব হওয়ার প্রতিফলন। আর সেই অর্থে, ইন্দো-সোভিয়েত চুক্তি পিকিং আর ওয়াশিংটনের মধ্যে বিরাজমান সুসম্পর্কে আজ অবধি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক বিপর্যয় বলে গণ্য করা যেতে পারে। খবর রটেছিল যে, সরকারের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সংসদে ডানপন্থীদের পাহাড় সমান চাপের মুখে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতাকামীদের প্রতি কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রসারিত করতে উদ্যত হয়েছিলেন। এমন একটি পদক্ষেপ যা পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান ‘যুদ্ধ ঘোষণার সমতুল্য’ বলে সতর্ক করেছিলেন। এরকম জরুরী পরিস্থিতিতে, মস্কো-দিল্লী চুক্তির প্রতি আগ্রহ পুনরুজ্জীবিত হয়ে ওঠে। আর মস্কোতে প্রায় দুই সপ্তাহ গোপন আলাপ-আলোচনার পর, আন্দ্রে গ্রোমেইকো নয়াদিল্লী পাড়ি জমান। এই চুক্তির অনেকটুকু জুড়ে রয়েছে প্রযুক্তিগত সহায়তা এবং সংস্কৃতি বিনিময়ের অঙ্গীকার। কিন্তু গুরুত্ত্বপূর্ণ অংশ, অনুচ্ছেদ ৯, স্বাক্ষরকারী দেশের ওপর তৃতীয় পক্ষের হামলা হলে তাৎক্ষণিক পারস্পরিক পরামর্শের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। একজন পর্যবেক্ষক বলেন, ‘ভারত নিশ্চিত করতে চেয়েছিল যাতে যুদ্ধ শুরু হলে গোলাবারুদের সরবরাহ ঠিক থাকে।’ আমাদের জন্য এটা নতুন যুগের সূচনা, একজন ভারতীয় কর্মকর্তা তার উচ্ছ্বাস ব্যক্ত করেন, জাপান এক পরাশক্তিতে পরিণত হতে পেরেছে কারণ মার্কিনীরা তাকে সুরক্ষা দিয়েছিল। আমরা যেহেতু রাশিয়ার ছাতার নিচে আশ্রয় পেয়েছি, আমাদের ক্ষেত্রেও তাই হতে পারে। মিসেস গান্ধী জনসমক্ষে নিশ্চয়তা দিয়েছেন যে, ভারতের নিরপেক্ষ অবস্থানের ওপর এই চুক্তি প্রভাব ফেলবে না; বাস্তবতা হচ্ছে প্রথম বারের মতো ভারত এবং বিশ্বের অন্য একটি পরাশক্তি এমন একটা চুক্তির সমঝোতায় পৌঁছেছে যাতে স্বতন্ত্র সামরিক আভাস রয়েছে। দিল্লীতে একজন পশ্চিমা কূটনীতিক বিশ্লেষণ করেন, ‘এবার রাশিয়ানরা যে অভূতপূর্ব সাফল্য পেল, এভাবে তারা এখানে আরো অনেক মিত্র পেতে পারে। আমেরিকার চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের সাম্প্রতিক প্রচেষ্টা ভারতের রাশিয়ান শিবিরের দিকে ধাবিত হওয়ার জন্য আংশিকভাবে দায়ী। মুক্তাঞ্চল থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশ পত্রিকার ১ম বর্ষঃ ১২শ’ সংখ্যায় শত্রুর বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য দেশবাসীর প্রতি বাংলাদেশ সরকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমাদের যে সংগ্রাম তা হলো সর্বাত্মক মুক্তির সংগ্রাম। এই সংগ্রামে জয়ী হতে হলে বাংলাদেশের সংগ্রামী জনতার নয়নমণি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনানুসারে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। জনসাধারনকে বলা হচ্ছে, আপনারা সামরিক সরকারকে কোন প্রকার ট্যাক্স দিবেন না। আপনাদের ভোটে নির্বাচিত বাংলাদেশ সরকারই একমাত্র বৈধ সরকার। নির্দেশনামায় বলা হয়েছে, খেলাধুলা, আমোদ প্রমোদ বর্জন করুন। আপনিও একজন মুক্তিযোদ্ধা, মনে রাখবেন আপনার সক্রিয় সহযোগিতা আমাদের বিজয়কে আরও নিকটবর্তী করে তুলবে। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×