ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রোহিঙ্গারা অনায়াসেই পাচ্ছে বাংলাদেশী পাসপোর্ট

প্রকাশিত: ১০:৫৫, ২২ আগস্ট ২০১৯

রোহিঙ্গারা অনায়াসেই পাচ্ছে বাংলাদেশী পাসপোর্ট

আজাদ সুলায়মান ॥ একের পর এক রোহিঙ্গা বাংলাদেশী পাসপোর্টে বিদেশে যেতে গিয়ে ধরা পড়ছে বিমানবন্দরে। গত চার বছরে ৩৯৮ রোহিঙ্গা হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ধরা পড়ে। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় বাংলাদেশী পাসপোর্ট। এভাবে বাংলাদেশী পাসপোর্টসহ রোহিঙ্গারা ধরা পড়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিমানবন্দরেরর নিরাপত্তা সংস্থাগুলো। তাদের বিস্ময়ভরা প্রশ্ন কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনীর ক্যাম্পগুলো থেকে কিভাবে কার সহায়তায় বাইরে বেরিয়ে এসে বাংলাদেশী পাসপোর্ট সংগ্রহ করে দেশ ছাড়ছে। এসব ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশও ইতোমধ্যে কয়েকটি চক্রের সন্ধান পেয়েছে। ওই চক্রই সুকৌশলে সুপরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গাদের হাতে পাসপোর্ট দিয়ে কামিয়ে নিচ্ছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। আরও বিস্ময়ের বিষয়, একমাত্র শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের এপিবিএন ছাড়া অন্য কোন সংস্থার হাতে এত বিপুল সংখ্যক পাসপোর্ট ধরা পড়েনি। তবে বছর কয়েক আগে মোখলেছুর রহমান যখন সিআইডির প্রধান ছিলেন তখন বেশ কিছু রোহিঙ্গার পাসপোর্ট কেলেঙ্কারি নিয়ে বিশেষ সেল গঠন করে কাজ করা হয়। বিমানবন্দর থানা ও সিআইডিতে থাকা ৩২১ মামলার তদন্তে দেখা যায়, অনায়াসেই রোহিঙ্গারা পেয়ে যাচ্ছে পাসপোর্ট। ঢাকা চট্টগ্রাম কক্সবাজারের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন ধরেই রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট দেয়ার কাজে লিপ্ত রয়েছে। তারা প্রতিটি ধাপে আলাদা আলাদা চার্জ নিয়ে পাসপোর্ট তৈরির প্যাকেজ গ্রহণ করে। এ পর্যন্ত যাদের আটক করা হয়েছে তাদের বেশ কজনের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, চার ধাপে পাসপোর্ট তৈরির প্যাকেজে রয়েছে স্থানীয় সরকার প্রতিনিধির নাগরিকত্ব সনদ, পুলিশের ভেরিফিকেশন, স্থানীয় অভিভাবক সংগ্রহ ও পাসপোর্ট অফিসের স্বীকৃতি। এই চার ধাপের জন্য নেয়া হয়- পাসপোর্ট প্রতি ন্যূনতম এক লাখ থেকে দুই লাখ টাকা। প্যাকেজ ডিলের তিনদিনের মধ্যেই অনেক রোহিঙ্গা পাাসপোর্ট পেয়েছে বলে গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে ধরা পড়েছে। এ সব বিষয়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দায়িত্বে থাকা আর্মড পুলিশের অধিনায়ক রাশেদুল ইসলাম খান বলেছেন, আগে রোহিঙ্গারা পাসপোর্ট তৈরি করত শুধু কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম ভিত্তিক একটি দুটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। এখন সেটা ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে। সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়া, লক্ষ্মীপুর, বাজিতপুর, জামালপুর ও কিশোরগঞ্জে পাসপোর্ট তৈরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে রোহিঙ্গারা। এটা খুবই উদ্বেগজনক। এদের এখনই রুখতে হবে। নইলে সেটা আরও ব্যাপক আকার ধারণ করতে পারে। সর্বশেষ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ধরা পড়া এক রোহিঙ্গা তরুণীকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদে পুিলশ জানতে পারে কিভাবে একটি চক্র এ কাজে লিপ্ত। কসবায় মরিজান (১৭) নামের ওই রোহিঙ্গা তরুণীর সঙ্গে তার সাজানো বাবা-মাকেও আটক করা হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস থেকে তাদের আটক করা হয়। আটক বাকি দুইজন হলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার বিনাউটি ইউনিয়নের নেমতাবাদ গ্রামের মোখলেছুর রহমান (৫০) ও আখাউড়া উপজেলার মনিয়ন্দ ইউনিয়নের গিরিশনগর গ্রামের লিপা বেগম (৩৮)। পুলিশ প্রাথমিক তদন্তে নিশ্চিত হয়- মরিজান কক্সবাজারের কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা। সে মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের জাকেরের মেয়ে। তবে কসবা উপজেলার বিনাউটি ইউনিয়ন পরিষদ থেকে পাওয়া জন্মসনদে মরিজানের নাম মোছাম্মৎ তানজিনা আক্তার ও বাবার নাম মোঃ মোখলেছ মুন্সী। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক মোঃ জামাল হোসেন বলেন, ঘটনার দিন দুপুরে পাসপোর্ট করার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে আমার কাছে আসে ওই রোহিঙ্গা কিশোরী। তার সঙ্গে কথা বলার সময় সন্দেহ হলে জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করে সে রোহিঙ্গা নাগরিক। পাসপোর্ট করার সময় যেন আমরা সন্দেহ না করি সেজন্য সাজানো বাবা-মাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে। পরে তিনজনকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়েছে। এখন প্রশ্ন ওঠেছে- মরিজান কিভাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তানজিনা ও মোখলেছ মুন্সীর সন্ধান পেল। এ বিষয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পুলিশ জানিয়েছে, কক্সবাজারের জনৈক বাংলাদেশী নাগরিক হাসানই মরিজানকে নিয়ে আসেন কসবা। এখানে ওই দুজনকে মাত্র ত্রিশ হাজার টাকার বিনিময়ে বাবা মা সাজিয়ে পাসপোর্ট অফিসে নিয়ে আসে। এ জন্য তাকে দেয়া হয় চল্লিশ হাজার টাকা। এ টাকা মরিজানের। টোটাল প্যাকেজের অংশ। বাংলাদেশী পাসপোর্ট পাইয়ে দেয়া বাবদ দুই লাখ টাকায় মরিজানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ করে দেয় হাসান। এ সম্পর্কে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পাসপোর্ট অফিসের একটি সূত্র জানিয়েছে, মরিজানের প্যাকেজের চার ধাপের মধ্যে দুই ধাপ ছিল কক্সবাজারে। বাকি দুই ধাপ ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার। সে হাসান নামের এক দালালের মাধ্যমে প্রথমে রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে আসে। তাকে নিরাপদে রামু হয়ে চট্টগ্রামে নিয়ে আসা হয়। সেখান থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া। এজন্য মরিজানকে ক্যাম্প থেকে বের করা বাবদ ত্রিশ হাজার টাকা ও কসবা পৌঁছে দেয়া বাবদ আরও বিশ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হয় হাসানকে। এরপর কসবা উপজেলার বিনাউটি ইউনিয়নের নেমতাবাদ গ্রামের মোখলেছুর রহমান ও আখাউড়া উপজেলার মনিয়ন্দ ইউনিয়নের গিরিশনগর গ্রামের লিপা বেগমকে বাবা মা সাজিয়ে পাসপোর্ট অফিসে হাজির করানো বাবদ দিতে হয় ৫০ হাজার টাকা। এ জন্য তাকে ভুয়া বাবা মায়ের কাছে সাতদিন রেখে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার স্থানীয় ভাষা, আচার-আচরণ শেখার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এ দায়িত্ব পালন করেন ভুয়া বাবা মা। এরপর আরও এক লাখ টাকা নেয়া হয় পুলিশ ভেরিফিকেশন ও পাসপোর্ট অফিসের নামে। এই দুই লাখ টাকার প্যাকেজ মূল্য হাসান আগেই নিয়ে নেয় মরিজানের পরিবারের কাছ থেকে কক্সবাজারে থাকতেই। প্যাকেজের চার ধাপের মধ্যে তিন ধাপ পেরিয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ে যখন পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে হাজির হয় তখন ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের মুখে সে ঘাবড়ে যায়। এতেই তার কপাল পুড়ে। পাসপোর্ট অফিসের সংশ্লিষ্ট কর্তার সন্দেহ হলে তার বাবা মাকেও ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তাতেই বেরিয়ে আসে থলের বিড়াল। এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পাসপোর্ট অফিসের সঙ্গে ঠিকমতো চুক্তি করতে ব্যর্থ হয় হাসান। যে কারণে মরিজান ধরা পড়ে। তবে সে পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে কক্সাবাজারে থাকতেই নিয়ে নেয় ৫০ হাজার টাকা। যদিও জরুরী ভিত্তিক একদিনের পাসপোর্টে পুলিশ ভেরিফিকেশন তাৎক্ষণিক লাগেনা। পাসপোর্ট নেয়ার পর এ ক্ষেত্রে পুিলশ ভেরিফিকেশন রিপোর্ট সংগ্রহ করতে হয়। বড় চক্র ন্যাশনাল সার্ভারে ॥ রোহিঙ্গাদের হাতে পাসপোর্ট যাওয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম ভূমিকা পালন করছে জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যভা-ারে (ন্যাশনাল সার্ভার) সক্রিয় একটি শক্তিশালী জালিয়াতচক্র। এখানে বার বার ধরা পড়ছে এনআইডি জালিয়াতির ঘটনা। তারপরও থামছেনা। সর্বশেষ চট্টগ্রামের হাটহাজারিতে ভুয়া নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে এক রোহিঙ্গা নারীর জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি এবং তার তথ্য নির্বাচন কমিশনের তথ্যভা-ারে সংরক্ষিত থাকার বিষয়টি প্রকাশ পায়। এর আগে বরিশাল অঞ্চলের এক ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধনের আবেদন নির্বাচন কমিশন বাতিল করে দেয়ার পরও আবেদনটি কে বা কারা সংশোধন করে দেয়। এছাড়া নোয়াখালী এলাকার এক ভোটারের নিবন্ধন ফরমে ঠিকানা, বাবা-মায়ের এনআইডি নম্বর, ভোটার শনাক্তকারী ও সুপারভাইজারের স্বাক্ষর না থাকার পরও তিনি ভোটার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন। জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের পরিচালক (অপারেশন্স) ইসির যুগ্মসচিব আবদুল বাতেন কমিশনের কঠোর নির্দেশনা থাকার পরও এনআইডি জালিয়াতির ঘটনার বিষয়টি স্বীকার করেন। তিনি বলেন, কোথাও কোথাও প্রয়োজনীয় দলিলাদি নিয়ে রোহিঙ্গাদের স্থানীয় লোকজন বা কারও সহায়তায় ভোটার হওয়ার প্রবণতা রয়েছে। এছাড়া তথ্য সংশোধন ও নানা ধরনের জালিয়াতির তথ্য মিলছে। এসব জালিয়াতি রোধে কমিশনের পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অসাধু চক্রের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের অবস্থান কঠোর। তাদের কারা সহায়তা করছে তা খুঁজে বের করা হবে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রামের হাটহাজারির ঘটনা তদন্তের জন্য বলা হয়েছে। ঘরে-বাইরে কারা এর সঙ্গে সম্পৃক্ত তা দেখব আমরা-দায়ীদের কোন ছাড় নয়। হাটহাজারির ঘটনায় রোহিঙ্গা নারীর নিবন্ধন ফরম থেকে তথ্যভা-ারে তার নাম অন্তর্ভুক্ত পর্যন্ত কাজ কিভাবে হয়েছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানান তিনি। বর্তমানে নির্বাচন কমিশনের তথ্যভা-ারে ১০ কোটি ৪২ লাখের বেশি ভোটারের তথ্য রয়েছে। আর ১১ লাখের মতো রোহিঙ্গার আলাদা তথ্যভা-ার রয়েছে। দালাল দেশী বিদেশী ॥ হাসানের মতো এমন আরও ৪০ দালাল কক্সবাজারে আত্মগোপন করে আছে। এ সম্পর্কে জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইকবাল আহমেদ জানিয়েছেন, ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গা বের করে পাাচারের সঙ্গে জড়িত দালাল দু’ধরনের-স্থানয়ীয় ও আন্তর্জাতিক। রোহিঙ্গাদের অনেকেরই আত্মীয় বিদেশে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত। তারা সেখানে কর্মরত প্রবাসী বাংলাদেশীদের মাধ্যমে তাদের আত্মীয়ের জন্য পাসপোর্ট পেতে চুক্তি করে। কিংবা সহকর্মী হওয়ার সুবাধে এমনিতেই সহযোগিতা করে। এদের বলা হয় বিদেশী দালাল। কিছুদিন আগে কক্সবাজার পাসপোর্ট তৈরি করতে এসে ধরা পড়ে মর্জিনা নামের এক তরুণী। এই তরুণী নিজেকে কক্সবাজারের স্থানীয় বাসিন্দা দাবি করে হামিদ নামের একজনকে বাবা সাজিয়ে অফিসে আসে। তাদের দেখে সন্দেহ হওয়ায় জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে এটা ক্যাম্প থেকে পালিয়ে আসার কাহিনী। এ বিষয়ে জানতে চাইলে এপিবিএন অধিনায়ক রাশেদুল ইসলাম খান বলেন, পাসপোর্ট তৈরির অন্যতম শর্ত স্থানীয় নাগরিক সনদ ও পুলিশ ভেরিফিকেশন। এ দুটোর একটাও কোনভাবেই রোহিঙ্গাদের পক্ষে পাওয়ার কথা নয়। তারপরও রোহিঙ্গারা সহজেই পেয়ে যাচ্ছে এসব সনদ। মর্জিনা ও মরিজান দুটো কাগজপত্র তৈরি করেই পাসপোর্ট অফিসে হাজির হন। সে কিভাবে পেল জানতে চাইলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুলিশের এক কর্তা বললেন, নকল বাবা মা এ দায়িত্ব নিয়েই ব্যবস্থা করে দিয়েছে। একটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের স্বাক্ষর ও সিল প্যাড নকল করে নাগরিকত্ব সনদ বানিয়ে দেয়। যদিও অনেক জনপ্রতিনিধি মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে এ ধরনের সনদ দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। এ সম্পর্কে ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হাবিবুর রহমান জানিয়েছেন, আমাদের নিজস্ব ইন্টিলিজেন্স এ নিয়ে কাজ করছে। এ বিষয়ে আমাদের একটা নির্দেশনা রয়েছে। রোহিঙ্গারা যাতে পাসপোর্ট পেতে না পারে সেজন্য সরকার কঠোর অবস্থানে। বলতে পারেন জিরো টলারেন্স। এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশের সহ-অধিনায়ক আলমগীর হোসাইন শিমুল বাংলাদেশী পাসপোর্টে রোহিঙ্গাদের বিদেশগমন ঠেকাতে আরও কঠোর নজরদারির মতামত উল্লেখ করে বলেছেন- এ পর্যন্ত যে চার শতাধিক রোহিঙ্গা আটক করা হয়েছে সবাই একবাক্যে স্বীকার করেছে- তারা বিভিন্ন রেটের প্যাকেজের দরদাম করেই পাসপোর্ট সংগ্রহ করেছেন। কেউ এক লাখে, কেউ দেড় থেকে দুই লাখ টাকায়ও পাসপোর্ট সংগ্রহ করেছেন। এ ক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধির প্রত্যয়নপত্র ও জাতীয় পরিচয়পত্র অফিসের কাগজপত্রই প্রধান শর্ত। এ দুটো ছাড়া কিছুতেই পাসপোর্ট তৈরি সম্ভব নয়। পুলিশের প্রতিবেদন দরকার হলেও জরুরী পাসপোর্টের ক্ষেত্রে তার প্রয়োজন হয়না। পাসপোর্ট ডেলিভারির পর সেটা সমন্বয় করা হয়। তবে এক্ষেত্রে ঢাকা এয়ারপোর্টে আজ পর্যন্ত কত পাসপোর্টের ভেরিফিকেশন রিপোর্ট নেগেটিভ হয়েছে তার কোন পরিসংখ্যান নেই। ইমিগ্রেশন প্রধান শাহরিয়ারও এ সম্পর্কে কোন ধরনের তথ্য দিতে পারেননি। কি বলছে কক্সবাজার পুলিশ ? এ সব অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইকবাল আহমেদ বলেন, বিশাল এলাকাজুড়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্প। দশ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা নিয়ে গঠিত এই এলাকার নিরাপত্তায় নিয়োজিত রয়েছে হাজার খানেক পুলিশ ফোর্স। তার সঙ্গে রয়েছে শ’ খানেক গোয়েন্দা সদস্য। নিরাপত্তার মূল দায়িত্বটা পালন করে জেলা পুলিশ। পালাবদল করে সর্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়। তারপরও আমি মনে করি, সীমিত জনবল দিয়ে বিশাল চ্যালেঞ্জ মোক বেলা করা হচ্ছে। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে- তারপরও কিভাবে ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে রোহিঙ্গারা। বাস্তবতা হচ্ছে- পৃথিবীর সর্ববৃহৎ এই উদ্বাস্তু ক্যাম্পের চারপাশে নেই কোন বেষ্টনী দেয়াল। শুধু দুটো সড়ক দিয়ে বৈধ যাতায়াতের সুযোগ থাকলেও অনেক ফাঁক ফোকর রয়েছে। ক্যাম্পের পেছন দিয়ে গ্রামের ভেতর দিয়ে রামু হয়ে সাতকানিয়ায় পৌঁছতে পারলেই তো আর ধরার সুযোগ থাকেনা। পুলিশ যে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছে তার বড় প্রমাণ হচ্ছে এ পর্যন্ত পালানোর সময় ৫৩ হাজার ধরে ক্যাম্পে প্রবেশ করানো । ছয়টা চেকপোস্ট এই সর্বক্ষণিক এই দায়িত্ব পালন করছে। বর্তমানে কক্সবাজার পুলিশকে সহায়তা করার জন্য আলাদা আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন গঠন করার বিষয়টি চূড়ান্ত পর্যায়ে। এ ছাড়া আরও একটি আমর্ড পুলিশ সেল গঠনের বিষয় প্রক্রিয়াধীন। এ দুটো ব্যাটালিয়ন জেলা গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় রেখে কাজ করলে রোহিঙ্গাদের হাতে পাসপোর্ট যাওয়াটা অনেকটাই দুুরূহ হয়ে পড়বে। কক্সবাজারের কারা কারা পাসপোর্ট তৈরিতে জড়িত জানতে চাইলে ইকবাল আহমেদ বলেন, আমি শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি, কক্সবাজার জেলা পাসপোর্ট অফিস থেকে কোন রোহিঙ্গা পাসপোর্ট তৈরি করতে পারছেনা। যেগুলো ধরা পড়ছে-সবই জামালপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া টাঙ্গাইল কুমিল্লাসহ অন্য এলাকায়। কক্সবাজার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের আশপাশে রয়েছে পুলিশের সর্বক্ষণিক নজরদারি। কোন রোহিঙ্গা সেখানে ঘোরাফেরা করলেই তাকে যাচাই- বাছাই করা হয় নানা কায়দায়। কিন্তু অন্য জেলায় হয়তো এভাবে নজরদারি করা সম্ভব হয়ে ওঠেনা। কি লাগে পাসপোর্টে ? পাসপোর্ট তৈরি করার প্রক্রিয়া খুবই সহজ। শুধু নাগরিক সনদ বা জাতীয় পরিচয়পত্র ও পুলিশ রিপোর্ট-থাকলেই এ দেশে যে কেউ পাসপোর্ট তৈরি করতে পারে। এই কাজটি যারা বৈধভাবে করতে যান- তাদের হয়রানির শিকার হতে হয় চরম। কিন্তু যারা এদেশের নাগরিক না হয়েও অবৈধ পথে পাসপোর্ট পেতে চান, তারা শুধু টাকার জোরেই অনায়াসে পেয়ে যান এই পাসপোর্ট। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গত চার বছরে চার শতাধিক রোহিঙ্গা আটক করা হয়েছে বাংলাদেশী পাসপোটসহ। তাদের সবার বিরুদ্ধে মামলাও দায়ের করা হয়েছে বিমানবন্দর থানায়। তাদের সবাইকে ধরেছে এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তারা সবাই স্বীকার করেন- খুব সহজ প্রক্রিয়ায় তারা পাসপোর্ট পেয়েছেন। প্রথমে পৌর কমিশনার বা ইউপি চেয়ারম্যানের কাছ থেকে একটা নাগরিক সনদ সংগ্রহ করেন। বয়স যদি আঠারোর নিচে হয় তাহলে ভোটার আইডির পরিবর্তে জন্মসনদ হলেই চলে। দুটি সনদই টাকার মাধ্যমে গণপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে পাওয়া যায়। দালালের সঙ্গে চুক্তিই থাকে সেভাবে। জন্মসনদের জন্য ৩০ হাজার, ভোটার বা জাতীয় পরিচয়পত্রের জন্য ৪০ হাজার, ও পুলিশ ভেরিফিকেশনের জন্য নেয়া হয় ৫০ হাজার। পাসপোর্ট অফিস বাবদ আরও ৩০ হাজার। এভাবে দেড় থেকে দুই লাখ টাকার প্যাকেজে মিলছে পাসপোর্ট। ক্ষেত্র বিশেষে এই পরিমাণ আরও বেশি বলে জানিয়েছে ধরা পড়া দুই রোহিঙ্গা। ্এ বিষয়ে এপিবিএন সূত্রে জানা যায়, ভোটার কার্ড বা পরিচয়পত্র পেতে লাগে ইউপি চেয়ারম্যান বা ওয়ার্ড কাউন্সিলরের প্রত্যয়নপত্র। যা টাকার বিনিময়ে বা নকল করে সংগ্রহ করা হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ২০/৩০ হাজার টাকার বিনিময়ে দালালরাই সংগ্রহ করে দেয়। সম্প্রতি হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বাংলাদেশী পাসপোর্টে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার সময় ৪ রোহিঙ্গা যুবক-যুবতীকে আটক করে এপিবিএন। তাদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বিমানবন্দর থানায় মামলা দিয়ে হস্তান্তর করা হয়। ওই মামলা তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ দেখতে তারা চারজনই জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহের আগে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের গুণবতী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলী হোসেনের কাছ থেকে নাগরিক সনদ সংগ্রহ করে। এ ঘটনায় সরাসরি সম্পৃক্ততা থাকায় পুলিশ আলী হোসেনকে গ্রেফতার করার পর বেশ কিছুদিন জেল খাটে। আলী হোসেনের মতো এমন শত শত চেয়ারম্যান ও গণপ্রতিনিধি দেশজুড়ে রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট পেতে সহায়তা করছে বলে পুলিশের তদন্তে ওঠে এসেছে। এ সম্পর্কে সাবেক আইজিপি নুরুল আনোয়ার জনকণ্ঠকে বলেন- কারা পাসপোর্ট তৈরিতে সহায়তা করে তা মোটামুটি সবাই জানে। স্পিড মানি দিলে এদেশে সবই সম্ভব হয়-শুধু পাসপোর্ট কেন বিচার পর্যন্ত পাওয়া যায়। পাসপোর্ট তৈরির দায়িত্ব পাসপোর্ট অফিসের। ওই অফিস যদি মনে করে কোন রোহিঙ্গাকে পাসপোর্ট দেবনা তাহলে সেটাই যথেষ্ট। রোহিঙ্গারা পাসপোর্টের আবেদন করবে সাক্ষাতকার দেবে আর পাসপোর্ট অফিস ধরতে পারবে না এমনটি মনে করার কোন কারণ নেই। আর ইউপি সনদ পাওয়াটা বাংলাদেশে সবচেয়ে সহজলভ্য কাজ। কাজেই এখন আগে সিদ্ধান্ত নিতে হবে- রোহিঙ্গারা পাসপোর্ট পাবে কি পাবে না সেটা আগে ঠিক করা। পাসপোর্ট ঠৈকানোর উপায় কি ? বাংলাদেশে বর্তমানে পাসপোর্ট তৈরির প্রক্রিয়ায় অনেক ফাঁক ফোকর রয়ে গেছে। যেমন বয়স আঠারোর নিচে হলে কাউকে আর জাতীয় পরিচয়পত্র বা ভোটার আইডির দরকার হয়না। এ ক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধিদের নাগরিক প্রত্যয়নপত্রই যথেষ্ট। দ্বিতীয়ত পুলিশ ভেরিফিকেশনও জরুরী পাসপোর্ট তৈরির সময় নগদ লাগেনা। এ ক্ষেত্রে পাসপোর্ট ডেলিভারির পর পুলিশ রিপোর্ট চাওয়া হয়। তখন যদি নেগেটিভ রিপোর্ট আসে তখন দেখা গেছে ইতোমধ্যেই ওই ব্যক্তি দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। এ ধরনের অসংখ্য অভিযোগ পাওয়া গেলেও ইমিগ্রেশন পুলিশের কাছে কোন ধরনের সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই বলে জানা গেছে। এ অবস্থায় কিভাবে রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট থেকে বিরত রাখা সম্ভব তা নিয়ে কাজ করছে পুলিশ। জানতে চাইলে এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশের অধিনায়ক রাশেদুল ইসলাম খান বলেন, উন্নত বিশ্বে নাগরিকের জন্মের পর পরই একটা নিবন্ধন নাম্বার থাকে। যা সারাজীবন তার ব্যক্তিগত যেমন তার চাকরি ব্যবসা ও পাসপোর্ট তৈরির ক্ষেত্রে কাজ লাগে। কিন্তু আমাদের দেশে একই ব্যক্তির একাধিক জন্মসনদ ও ভোটার আইডি থাকার অনেক নজির রয়েছে। কোন ব্যক্তি ভোটার হওয়ার পর পাসপোর্টে সেটাই উল্লেখ করা হয়। তখন তার জন্মনিবন্ধন লাগেনা। আবার যিনি ভোটার নন তখন তিনি জন্মনিবন্ধন দিয়ে পাসপোর্ট তৈরি করেন এবং ভোটার হওয়ার পর তিনি আবার নতুন নাম্বার দিয়ে পাসপোর্ট তৈরি করেন। এই ডুয়েল মোড -এখানেই একটা বড় ফাঁক ফোকর রয়ে গেছে। এদেশেও যদি নাগরিকের জন্মের পর পরই জাতীয়ভাবে নিবন্ধন করে ফেলা হয় এবং সারাজীবন ওই একটা নাম্বারই সর্বক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় তাহলে আর যাই হোক রোহিঙ্গাদের অনায়াসে পাসপোর্ট পাওয়ার ঘটনা ঘটত না।
×