ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিশেষজ্ঞদের অভিমত যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাব দায়ী

ছয় মাসে এসি বিস্ফোরণে কয়েক দম্পতিসহ মৃত ১২, দগ্ধ শতাধিক

প্রকাশিত: ১০:৫৩, ২২ আগস্ট ২০১৯

ছয় মাসে এসি বিস্ফোরণে কয়েক দম্পতিসহ মৃত ১২, দগ্ধ শতাধিক

নিয়াজ আহমেদ লাবু ॥ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র (এসি) বিস্ফোরণের ঘটনা বেড়ে চলছে। বিস্ফোরণে আগুনে অনেকের শরীর ঝলসে যাচ্ছে। হাসপাতালের বেডে কষ্ট ও যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে প্রাণ হারাচ্ছে অনেকে। এসব ঘটনায় প্রাণহানির সংখ্যা বাড়ছে। ঝলসানো শরীর নিয়ে পঙ্গুত্বের অভিশাপ নিয়ে বেঁচে আছে অনেকেই। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত ৬ মাসে রাজধানীতে কয়েকটি ঘটনা বাসাবাড়ি ও দোকানে এসি বিস্ফোরণে অগ্নিদগ্ধ হয়ে কমপক্ষে ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। মৃতের তালিকায় রয়েছে কয়েক দম্পতি। শতাধিক নারী-পুরুষ মারাত্মক দগ্ধ হয়েছেন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর অলক মজুমদার জনকণ্ঠকে বলেন, রক্ষণাবেক্ষণের অভাবেই বেশিরভাগ সময় এসির বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এসিতে ময়লা জমেছে কিনা কম্প্রেসারের ভেতরে জ্যাম থাকায় গ্যাস লিকেজ হয়ে থাকে। এসব কারণে ঘরে এসি থাকলে সচেতন হতে হবে, সময়মতো সার্ভিসিং করাতে হবে। তা না হলে বিস্ফোরণের মতো ঘটনা ঘটতে পারে। তিনি জানান, ঘরে এসি থাকলে নিজেকে অবশ্যই সচেতন হতে হবে। একনাগাড়ে ৮ ঘণ্টার বেশি এসি চালানো উচিত নয়। এর চেয়ে বেশি সময় এসি চালালে কম্প্রেসারে চাপ পড়ে। এতে মেশিন ভারি হয়ে বিস্ফোরণ ঘটে আগুন ধরে যেতে পারে। এছাড়া আউটডোর ইউনিট ও আউটডোর বিল্ডিংয়ের মধ্যে যথেষ্ট ফাঁকা স্থান রাখা উচিত- যেন কম্প্রেসারে বাধাহীন বাতাস চলাচল করতে পারে। ত্রুটিপূর্ণ ইনস্টলেশন ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসি বিস্ফোরণ ঘটে। এছাড়া এসি ব্যবহারে লক্ষ্য রাখতে বৈদ্যুতিক সংযোগস্থল লিক আছে কিনা, বৈদ্যুতিক শটসার্কিটে আগুন ধরে যেতে পারে। এজন্য উন্নতমানের মোটা বৈদ্যুতিক তার, সুইচ, সার্কিট ব্রেকার ব্যবহার করতে হবে। এগুলো মাঝে মধ্যে চেক করতে হবে। তবেই এসি বিস্ফোরণ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। সূত্রমতে, বিদেশ থেকে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে নিম্নমানের যন্ত্রাংশ আমদানি করে অনুমোদনহীন বিভিন্ন কারখানায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র (এসি) তৈরি করা হয়। পরে তাতে দামী ব্র্যান্ডের নাম ও লোগো সেঁটে বাজারজাত করা হয়। যন্ত্রণাংশ নিম্নমানের হওয়াসহ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ওসব এসির কম্প্রেসার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে। এদিকে শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ বিভিন্ন সময়ে ওসব কারখানায় অভিযান চালিয়ে মাঝেমধ্যে এসি জব্দ করছে। নকল এসি পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দেখা গেছে, এসব এসিতে নামী ব্র্যান্ডের নাম ব্যবহার করা হয়েছে। আসলে ওগুলো নিম্নমানের। কাজেই বিস্ফোরণের আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। গত ১৫ মে শেরে বাংলা নগরের পশ্চিম আগারগাঁওয়ের দুই নম্বর রোডের একটি বাসায় টেলিভিশন বিস্ফোরণের আগুনে দগ্ধ হন দম্পতি মোক্তার হোসেন (৩৮) ও তার স্ত্রী সালমা আক্তার (২৬)। এক সপ্তাহের ব্যবধানে ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এই দম্পতির মৃত্যু হয়। ঘটনার তিনদিন পর ১৮ মে ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মোক্তার হোসেন ও ২৫ মে তার স্ত্রী সালমা আক্তার মারা যায়। মোক্তার ও সালমার বাড়ি সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার চরশশমপুর গ্রামে। মোক্তার ঢাকায় ওষুধের ফার্মেসি চালাতেন। গত ১৮ মার্চ উত্তরায় এসি বিস্ফোরণের দগ্ধ হন আলমগীর ভূঁইয়া ও বিলকিস ফারজানা দম্পতি। বিস্ফোরণের এক সপ্তাহের ব্যবধানে ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এই দম্পতির মৃত্যু ঘটে। এরমধ্যে ২৫ মার্চ দুপুর একটার দিকে ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বিলকিস ফারজানা ও আগের দিন ২৪ মার্চ দুপুরে তার স্বামী আলমগীর ভূঁইয়ার মৃত্যু হয়। বার্ন ইউনিটের আবাসিক চিকিৎসক ডাঃ পার্থ শংকর পাল জানান, ফারজানা ও আলমগীরের শরীরের ৯৫ শতাংশ দগ্ধ হয়েছিল। দু’জনই বার্ন ইউনিটের আইসিইউতে ভর্তি ছিলেন। ২৩ জুলাই শনিরআখড়ায় গোয়ালবাড়ির মোড়ে বার্গার নামের একটি ফাস্টফুড দোকানে এসি বিস্ফোরণে দগ্ধ কর্মচারী সাইফুল ইসলাম (২১) মারা যায়। ঘটনার তিনদিন পর ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, গত ২৩ জুলাই সকালে পুরান ঢাকার শনিরআখড়ায় ওই ফাস্টফুডের দোকানটি খোলেন সাইফুল ও ইমরান (২০) নামে দুই কর্মচারী। ঢুকেই দোকানে তারা পোড়া গন্ধ পায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিকট শব্দ হয়ে এসির বিস্ফোরণ ঘটে। এতে উভয়েই দগ্ধ হয়। মারাত্মক দগ্ধ অবস্থায় তাদের ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। বার্ন ইউনিটে আবাসিক চিকিৎসক ডাঃ পার্থ শংকর পাল জানান, দগ্ধ সাইফুলের শরীরের ৭০ শতাংশ ও ইমরানের ৩০ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। তাদের শ্বাসনালী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১০ জুন সকালে একই এলাকায় আরএস টাওয়ারের দোতালা ও তিনতলায় এসি বিস্ফোরণে ফরিদ আহমেদ নামে এক পথচারী নিহত হয়েছেন। ঘটনাস্থলের বর্ণনা দিয়ে কদমতলী থানার ওসি জামাল উদ্দিন মীর জানান, বিস্ফোরণে ভবনের দেয়াল ধসে পড়েছে। একটি ব্যাংকের জানালা-দরজার কাঁচ চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে। এ সময় ওই ভবনের পাশ দিয়ে যাওয়া পথচারী ফরিদ আহমেদ নিহত হন। এ ঘটনায় আরও ১০/১২ জন আহত হয়েছেন। তাদের ঢাকা মেডিক্যাল চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। গত ৩০ জুন সকালে গ্রীনরোডের একটি ভবনে সংস্কার কাজ চলার সময় বিস্ফোরণের পর আগুন ধরে মোঃ রাসেল (৩২) নামে এক শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। ওই বিস্ফোরণে চার শ্রমিক দগ্ধ হয়েছেন। অন্য দগ্ধরা হচ্ছে- ফয়েজ (২০), রাকিব (২০) ও সুমন (১৮)। এরা ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি রয়েছে। কর্তব্যরত চিকিৎসকরা জানান, নিহত রাসেলের শরীরের ৬২ শতাংশ দগ্ধ হয়েছিল। আহত ফয়েজের ৪০ শতাংশ, রাকিবের ৩৭ শতাংশ ও সুজনের ২৫ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। এদের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
×