ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

গতি আর বেপরোয়া মনোভাবে ৯০ ভাগ সড়ক দুর্ঘটনা

প্রকাশিত: ১১:০৩, ২১ আগস্ট ২০১৯

গতি আর বেপরোয়া মনোভাবে ৯০ ভাগ সড়ক দুর্ঘটনা

রাজন ভট্টাচার্য ॥ প্রতি বছরের মতো এবারের ঈদ শেষে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা বেশি। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, প্রায় ৬০ ভাগের বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে কর্মস্থলে ফেরার সময়। দুর্ঘটনার ভয়াবহতাও বাড়ছে। প্রশ্ন হলো ঈদ শেষে ফিরতি যাত্রায় মৃত্যুর বিভীষিকা কেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাত্রাতিরিক্ত গতি, চালকদের বেপরোয়া মানসিকতা, নিম্নমানের টায়ার আর সড়ক মহাসড়কে প্রয়োজনীয় তদারকির অভাবেই এত বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। ঈদকে কেন্দ্র করে ২০৩ দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা ২২৪ জন। নৌ-সড়ক ও রেলপথ মিলিয়ে এবারের দুর্ঘটনার সংখ্যা ২৪৪। সব মিলিয়ে চালকের বেপরোয়া মনোভাব ও গতির কারণে ৯০ ভাগ দুর্ঘটনা ঘটছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উন্নত বিশ্বে পালাক্রমে চালকেরা গাড়ি চালাচ্ছে কিনা তা পর্যবেক্ষণের জন্য পুলিশ বাসে উঠে যায়। বেপরোয়া চলা গাড়িগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবেও নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এভাবে প্রতিটি বিষয় যেমন গাড়ির ফিটনেস, চালকদের বেতনকাঠামো, সব ধরনের সংস্থার নিয়মিত নজরদারির কারণে দুর্ঘটনা কমে এসেছে। গতি আর বেপরোয়া মনোভাব মূল সমস্যা ॥ ঈদ শেষে কর্মস্থলে ফেরার পথে এত বেশি দুর্ঘটনা কেন। এ নিয়ে সরকারের কোন বিভাগ থেকেই মাথা ব্যথা নেই। এর কারণ অনুসন্ধানে কোন উদ্যোগও নেয়া হয়নি। তবে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট (এআরআই) গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এর কারণ অনুসন্ধানে গবেষণা করেছে। এআরআইয়ের তথ্যে দেখা গেছে, গত ঈদ-উল-ফিতরে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে ১৭২টি। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ১৫৪ জন। এর মধ্যে ঈদের আগের সাতদিনে ৫০টি দুর্ঘটনা ঘটে। আর ঈদের দিন থেকে পরের আটদিনে দুর্ঘটনার সংখ্যা ১২২টি। ঈদের আগে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ৭২ জনের। পরের আটদিনে নিহতের সংখ্যা ১৪৪ জন। এবারের ঈদ-উল-আজহার চিত্রও এমনই। ঈদের ফিরতি যাত্রা শুরুর পর গত বৃহস্পতিবার এক দিনেই সড়কে ২৫ জনের প্রাণ ঝরেছে। গত শনিবার ময়মনসিংহে সড়ক দুর্ঘটনায় একই পরিবারের চারজনের মৃত্যু হয়। ভয়ঙ্কর এই দুর্ঘটনা যারা প্রত্যক্ষ করেছেন তাদের কেউই এখন স্বাভাবিকভাবে ঘুমাতে পারছেন না। বিআরটিএ পর্যবেক্ষণ ॥ বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সূত্র বলছে, একই সড়কে ছোট, বড়, কম গতির ও বেশি গতির যানবাহন চলে। ফাঁকা সড়কে বেশি গতির যানবাহনগুলো কম গতির যানবাহনকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় অনেক সময় দুর্ঘটনা ঘটছে। দূরপাল্লার বাস ঘণ্টায় ১০০ থেকে ১২০ কিলোমিটার গতিতে চলে। বাড়তি গতিতে ৫৩ ভাগ দুর্ঘটনা ॥ ১৯৯৮ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনার কারণ নিয়ে এআরআই একটি গবেষণা করেছে। এই গবেষণার তথ্য বলছে, দেশে ৫৩ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর জন্য । আর চালকদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে ৩৭ শতাংশ। পরিবেশ-পরিস্থিতিসহ অন্য কারণে দুর্ঘটনার পরিমাণ ১০ শতাংশ। অর্থাৎ চালকের বেপরোয়া মনোভাব ও গতির কারণে ৯০ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটছে। এআরআইয়ের গবেষক কাজী সাইফুন নেওয়াজ বলেন, সড়কে বেপরোয়া গতিই বেশি প্রাণহানির জন্য দায়ী। আর ঈদের পরে বেশি দুর্ঘটনার পেছনে চালকের ক্লান্তি একটা বড় বিষয়। ফেনীতে গত বৃহস্পতিবার গাছের সঙ্গে বাসের ধাক্কায় সাতজনের প্রাণহানির পেছনে চালকের ক্লান্তি কাজ করতে পারে। চালক ঘুমিয়ে না পড়লে এমনটা খুব একটা হয় না। চালক বদলের বালাই নেই ॥ পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, ‘টানা পাঁচ ঘণ্টা চালানোর পর চালক বদল করার কথা নিয়মে থাকলেও এদেশে একই চালক রাত-দিন টানা গাড়ি চালাতে থাকে। ফলে ঈদ পরবর্তী সময়ে অবসাদগ্রস্ত চালক গাড়ি চালাতে গেলে দুর্ঘটনা হবেই। তাছাড়া যানবাহনের ত্রুটিও রয়েছে। সারাদেশে ১৪৬ সড়ক দুর্ঘটনায় ১৯৭ জন নিহত ॥ রোড সেফটি ফাউন্ডেশন বলছে, ঈদ-উল-আজহার আগে-পরে ৬ আগস্ট থেকে ১৭ আগস্ট পর্যন্ত ১২ দিনে সারাদেশে সড়ক, নৌ ও রেলপথে মোট দুর্ঘটনা ঘটেছে ১৭৬টি। নিহত ২২৩ জন। আহত ৬৭০ জন। এর মধ্যে সড়ক পথে দুর্ঘটনা ঘটেছে ১৪৬টি। নিহত ১৯৭ জন (পুরষ-১৫৯, নারী-৩৮)। আহত ৬২৭ জন। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেশি ঘটেছে। ৫৩টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত ৬৯ জন। দুই সমস্যা সমাধান হলে ৮৫ ভাগ দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব ॥ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, এ বছর ১২ দিনে মোট সংঘটিত ২০৩ সড়ক দুর্ঘটনার ৬৭টি ঘটেছে মোটরসাইকেলের সঙ্গে অন্যান্য যানবাহনের সংঘর্ষে, যা মোট দুর্ঘটনার ৩৩ শতাংশ। যেখানে মোট নিহতের ৩৪ দশমিক ৩৭ শতাংশ এবং মোট আহতের ৮ দশমিক ৪২ শতাংশ। অন্যদিকে পথচারীকে গাড়ি চাপা দেয়ার ঘটনা ৫২ দশমিক ২১ শতাংশ ঘটেছে। আগামী ঈদে এ দুটি ঘটনা এড়ানো সম্ভব হলে সড়ক দুর্ঘটনার প্রায় ৮৫ দশমিক ২১ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে বলে আমরা মনে করি।
×