ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

পেপারবুক তৈরির পরই আপীল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি

প্রকাশিত: ১০:৫১, ২১ আগস্ট ২০১৯

পেপারবুক তৈরির পরই আপীল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি

বিকাশ দত্ত ॥ বহুল আলোচিত বর্বরোচিত ভয়াবহ একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার পেপার বুক তৈরি হবার পরই আপীল ও ডেথ রেফারেন্স শুনানির ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। রাষ্ট্রপক্ষ শুনানির জন্য প্রস্তুত রয়েছে। এমনই আভাস দিয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ ও সংশ্লিষ্ট মামলার আইনজীবীগণ। অন্যদিকে সুপ্রীমকোর্ট প্রসাশন থেকেও বলা হয়েছে দ্রুত পেপার বুক তৈরির কাজ চলছে। সহসাই পেপার বুক তৈরির কাজ শেষ হবে। এদিকে এ্যাটর্নি জনারেল মাহবুবে আলম নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, এ মামলায় নিম্ন আদালতে যাবজ্জীবন কারাদ- ও লঘুদ-ের বিরুদ্ধে আপীল করতে বলা হয়নি। যার কারণেই রাষ্ট্রপক্ষ এ মামলায় আপীল করেনি। বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিগণ আপীল করেছে। পেপার বুক তৈরি হলেই দ্রুত শুনানির ব্যবস্থা করব। সুপ্রীমকোর্টের স্পেশাল অফিসার সাইফুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেছেন, পেপার বুক তৈরির কাজ চলছে। আশা করছি দ্রুতই শেষ হবে। এটা তৈরি করতে কিছু কাজ রয়েছে। টাইপ করতে হবে, সেগুলো গুছিয়ে ছাপানোর ব্যবস্থা করা। বিজি প্রেসে না নিজেরা করা হবে তা এখনও ঠিক হয়নি। কাজ চলমান রয়েছে। গ্রেনেড হামলা মামলার চীফ প্রসিকিউটর সৈয়দ রেজাউর রহমান জনকণ্ঠকে বলেছেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ যারা এ মামলায় পলাতক আছেন, তাদেরকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। দ্বিতীয়ত : আসামিদের আপীল শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। আমি যতদুর জানি এ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় শুনানির জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। এ মামলায় যাবজ্জীবন যাদের কারাদ- হয়েছে তাদের শাস্তি বাড়ানো হবে কিনা তা আপীল শুনানিতেই বলব। তিনি আরও বলেন, ১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার মধ্যদিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৪ সালে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার লক্ষ্যে এ গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেতাদের হত্যা করাই ছিল এ হামলার প্রধান টার্গেট। গ্রেনেড হামলা মামলায় বিচারক তার রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেন, ২১ আগস্টের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার যে ষড়যন্ত্র, তার মূল পরিকল্পনা হয়েছিল হাওয়া ভবনে। ইনডেমনিটে বিলের মাধ্যমে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র দেশে শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার দীর্ঘ ২৩ বছর ২ মাস পর জাতি, জাতির পিতা হত্যার দায় থেকে কলঙ্ক মুক্ত হয় বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ জাতির পিতাকে হত্যা করার পর জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়। কিন্তু ষড়যন্ত্র থেমে না গিয়ে বহমান থাকে। পরবর্তীতে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শনিবার আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার হীন প্রচেষ্টা চালানো হয়। ১৩ জানুয়ারি একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার আপীল ও ডেথ রেফারেন্স শুনানির জন্য গ্রহণ করে হাইকোর্ট। বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। এর আগে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় দায়ের হওয়া দুই মামলার রায়সহ প্রায় ৩৭ হাজার ৩৮৫ পাতার নথি ২০১৮ সালের ২৭ নবেম্বর হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় এসে পৌঁছায়। ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকার এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নূরউদ্দিন মামলা দুটিতে রায় ঘোষণা করেন। সে হিসেবে রায় ঘোষণার ৪৮ দিন পর নথি হাইকোর্টে পাঠানো হলো। ১০ অক্টোরব একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদ-ের আদেশ প্রদান করে। একইসঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদ-ের আদেশ দেয়া হয়েছে। অবশিষ্ট ১১ আসামির বিরুদ্ধে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ- হয়। এ মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, বিএনপি নেতা সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা হারিজ চৌধুরীসহ ৪৯ জন আসামি রয়েছে। মোট ৫২ আসামির মধ্যে তিন আসামি জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, জঙ্গী নেতা মুফতি হান্নান ও তার সহযোগী শরীফ সাহেদুল আলম বিপুল অন্য মামলায় মৃত্যুদ- কার্যকর হওয়ায় তাদেরকে মামলা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। তারেক রহমানসহ এখনও ১৬ আসামি পলাতক রয়েছেন। এর আগে পৃথক পৃথক মামলায় তারেক রহমান ও লুৎফুজ্জামান বাবরের দ- হয়েছে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় তারেক রহমানকে ১০ বছরের সশ্রম কারাদ- দেয়া হয়। অর্থপাচারের মামলায় নি¤œ আদালতের খালাসের রায় বাতিল করে তারেক রহমানকে সাত বছরের কারাদ- ও ২০ কোটি জরিমানা বহাল রাখে হাইকোর্ট। এ ছাড়া সাবেক স্বরাষ্ট্র প্র্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরকে ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালান মামলায় মৃত্যুদ- দিয়েছিল বিচারিক আদালত। বিএনপি-জামায়াতের জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের এক সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটে। ওই নৃশংস হামলায় ২৪ জন নিহত ও নেতাকর্মী-আইনজীবী-সাংবাদিকসহ পাঁচ শতাধিক লোক আহত হন। নিহতদের মধ্যে ছিলেন তৎকালীন মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের পতœী আইভি রহমান। তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের প্রথম সারির অন্য নেতা এই গ্রেনেড হামলা থেকে বেঁচে যান। দীর্ঘ ১৪ বছর ২ মাস ১৯ দিনের মাথায় ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর গ্রেনেড হামলা মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। গ্রেনেড হামলা মামলায় আদালত ১৯ আসামিকে মৃত্যুদ- প্রদান করে। তারা হলেন, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, বিএনপি-জামায়াত জোটের সাবেক উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্ট, তার ভাই মাওলানা তাইজউদ্দিন (পলাতক), হুজির সাবেক আমির মাওলানা শেখ আবদুস সালাম, কাশ্মীরী জঙ্গী আব্দুল মাজেদ ভাট, আবদুল মালেক ওরফে গোলাম মোহাম্মদ ওরফে জিএম, মাওলানা শওকত ওসমান, মহিবুল্লাহ ওরফে অভি, মাওলানা আবু সাঈদ ওরফে ডাঃ জাফর, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, মোঃ জাহাঙ্গীর আলম, হাফেজ মাওলানা আবু তাহের, হোসাইন আহম্মেদ তামিম, মঈনউদ্দিন শেখ ওরফে মুফতি মঈন ওরফে আবু জান্দাল, মোঃ রফিকুল ইসলাম ওরফে সবুজ ওরফে সবুজ ওরফে খালিদ সাইফুল্লাহ ওরফে শামিম ওরফে রাশেদ, মোঃ উজ্জল, এনএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) আবদুর রহিম, হানিফ পরিবহনের মালিক হানিফ। এই আসামিদের দ-বিধি ৩০২, ১২০ খ, ৩৪ ধারায় হত্যার দায়ে মৃত্যুদ-ের পাশাপাশি এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। দ-বিধির ৩০৭ ধারায় অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে গুরুতর জখম করার দায়ে যাবজ্জীবন কারাদ- ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদ- দেয়া হয়েছে। বিস্ফোরক আইনের ৩ ও ৬ ধারায় হত্যার দায়ে মৃত্যুদ-ের পাশাপাশি এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। বিস্ফোরক আইনের ৪ ও ৬ ধারায় অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে গুরুতর জখম করার দায়ে ২০ বছরের কারাদ- ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদ- দেয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে এই ১৯ আসামির ক্ষেত্রে কেবল মৃত্যুদ-ের শাস্তিই কার্যকর হবে। মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তাদের দ- কার্যকর করতে বলা হয়েছে রায়ে। অপর ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়া হয়েছে। যাদের যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়া হয়েছে তারা হলেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান (পলাতক), খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরী (পলাতক), বিএনপি নেতা ও সাবেক এমপি কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ (পলাতক), হুজি সদস্য হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া, শাহাদাৎ উল্লাহ ওরফে জুয়েল, মাওলানা আবদুর রউফ ওরফে আবু হোমাইরা ওরফে পীর সাহেব, মাওলানা সাব্বির আহমেদ আহম্মেদ ওরফে আব্দুল হান্নান সাব্বির, আরিফ হাসান ওরফে সুমন ওরফে আব্দুর রাজ্জাক, আবু বকর ওরফে হাফেজ সেলিম মাওলাদার, মোঃ আরিফুল ইসলাম আরিফ, হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া মহিবুল মুত্তাকিন ওরফে মুত্তাকিন (পলাতক), আনিসুল মুরছালিন ওরফে মুরছালিন (পলাতক), মোঃ খলিল (পলাতক), জাহাঙ্গীর আলম বদর (পলাতক), মোঃ ইকবাল, লিটন ওরফে মাওলানা লিটন (পলাতক), মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আব্দুল হাই (পলাতক), রাতুল আহমেদ ওরফে রাতুল বাবু (পলাতক)। তাদেরকে দ-বিধি ৩০২, ১২০ খ, ৩৪ ধারায় যাবজ্জীবন কারাদ-, ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদ- দেয়া হয়েছে। দ-বিধি ৩০৭, ১২০ খ, ৩৪ ধারায় যাবজ্জীবন কারাদ-, ৫০ হাজার টাকা জনিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদ- দেয়া হয়েছে। বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের ৩ ও ৬ ধারায় যাবজ্জীবন কারাদ-, ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদ- দেয়া হয়েছে। বিস্ফোরক আইনের ৪ ও ৬ ধারায় ২০ বছরের কারাদ- ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদ- দেয়া হয়েছে। সব সাজা একযোগে কার্যকর হবে বলে এই ১৯ আসামির ক্ষেত্রে কেবল যাবজ্জীবন কারাদ- কার্যকর হবে। এছাড়া পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোঃ আশরাফুল হুদা ও শহুদুল হক, খালেদা জিয়ার ভাগ্নে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার (অব) সাইফুল ইসলাম ডিউক, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব) সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার (পলাতক), মেজর জেনারেল (অব) এটিএম আমিন (পলাতক), ডিএমপির সাবেক উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) খান সাঈদ হাসান (পলাতক), আরেক সাবেক উপ-কমিশনার (পূর্ব) ওবায়দুর রহমান খান (পলাতক), সাবেক আইজিপি খোদা বক্স চৌধুরী, সিআইডির সাবেক বিশেষ সুপার মোঃ রুহুল আমিন, সাবেক এএসপি আবদুর রশিদ, সাবেক এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমানকে দুই বছর করে কারাদ- ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ছয় মাস করে সশ্রম কারাদ- দেয়া হয়েছে। আরেকটি ধারায় খোদা বক্স চৌধুরী, রুহুল আমিন, আবদুর রশিদ ও মুন্সি আতিকুর রহমানকে তিন বছর করে কারাদ- ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ছয় মাস করে কারাদ- দিয়েছে আদালত।
×