ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

অবৈধ অভিবাসন- দালাল চক্র বেছে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রকে

প্রকাশিত: ১০:৩০, ২০ আগস্ট ২০১৯

 অবৈধ অভিবাসন- দালাল চক্র বেছে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রকে

ফিরোজ মান্না ॥ অভিবাসন প্রত্যাশীদের নতুন গন্তব্য এখন ইউরোপের পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্র। ইউরোপ প্রবেশে বেশ কয়েকটি বড় ধরনের দুর্ঘটনার পর দালাল চক্র এবার অবৈধ অভিবাসনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে বেছে নিয়েছে। অভিবাসন প্রত্যাশীদের ইউরোপের স্বপ্ন বদল করে যুক্তরাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে। ইউরোপ যাবার জন্য লিবিয়ার পথ পরিবর্তন করে পাচারের নতুন পথ তৈরি করা হয়েছে তুরস্ক, মেক্সিকো হয়ে যুক্তরাষ্ট্র। উন্নত জীবনের আশায় অভিবাসন প্রত্যাশীরা সোনার হরিণের পেছনে ছুটতে গিয়ে পড়ছে বিপর্যয়ের মুখে। সম্প্রতি মেক্সিকোতে এমন ৬৫ জন যুক্তরাষ্ট্রগামী অভিবাসী আটক হয়েছে যার মধ্যে কিছু বাংলাদেশীও রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএম উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা বলছে, পথটি ভয়ঙ্কর। অনিশ্চিত যাত্রার এই পথে সম্প্রতি কিছু লোক ধরা পড়েছে। এই পথে বহু মানুষ যাওয়ার তথ্য তাদের কাছে রয়েছে বলেও সংস্থাটি দাবি করেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সম্প্রতি লিবিয়া-তিউনিসিয়া হয়ে ইতালি কিংবা মরক্কো হয়ে স্পেন যাবার পথে কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে বাংলাদেশীসহ অনেক লোক মারা গেছে। স্বাভাবিকভাবে মানব পাচার নিয়ে দেশগুলো বেশ সতর্ক হয়েছে। এখন দালাল চক্র চাইলেও সহজে এসব দেশ হয়ে সাগর পাড়ি দিয়ে মানব পাচার করতে পারছে না। এজন্য তারা নতুন রুট খুঁজে নিচ্ছে। তুরস্ক থেকে বিমানে মেক্সিকো হয়ে যুক্তরাষ্ট্র পাঠানোর নতুন এই পথকে তারা অপেক্ষাকৃত নিরাপদ মনে করছে। যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ অনুপ্রবেশের জন্য রুটটি আগেও চালু ছিল। দুই দেশের তৎপরতার কারণে এটি গত কয়েক বছর বেশ ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। পাচারকারীরা এখন আবার সেই পথই বেছে নিয়েছে। তারা এই কাজে মেক্সিকোর কিছু লোককেও যুক্ত করেছে। সম্প্রতি ৬৫ জনের একটি দলকে দালাল চক্র যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানোর সময় মোক্সিকো পুুলিশের কাছে ধরা পড়ে। এই দলে বাংলাদেশী ছাড়াও শ্রীলঙ্কা, ভারত ও মেক্সিকোর নাগরিক রয়েছে। তারা এখন মেক্সিকোর বন্দী শিবিরে। মেক্সিকোর কর্তৃপক্ষ আটককৃতদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছে। সূত্র জানিয়েছে, সম্প্রতি মেক্সিকোর ভেরাক্রুজ রাজ্যের হাইওয়েতে ৬৫ অভিবাসন প্রত্যাশীকে পড়ে থাকতে দেখে কেন্দ্রীয় পুলিশের একটি টহল দল তাদের উদ্ধার করে। তারা কয়েকদিনের না খাওয়া ছিল। পুলিশ তাদের উদ্ধার করে প্রথমে খাবার ও প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়। পরে তাদের একটি অভিবাসন কেন্দ্রে নিয়ে যায়। সেখানেই তাদের রাখা হয়েছে। মেক্সিকোর কর্তৃপক্ষ তাদের নিজ নিজ দেশে কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছে। জানা গেছে, যাদের উদ্ধার করা হয়েছে তারা ২৪ এপ্রিল কাতার থেকে তুরস্কে যায়। তারপর তুরস্ক থেকে ইকুয়েডর-কলম্বিয়া-পানামা-গুয়াতেমালা হয়ে মেক্সিকো পৌঁছে। মেক্সিকোয় পৌঁছানোর পর কেয়াটসাকোরকোস নদী পার হয়ে নৌকায় মেক্সিকোর উত্তর দিকের সীমান্তে পৌঁছেন। ওখান থেকে যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার সীমান্ত কয়েক শ’ মাইল দূরে। নৌপথে উত্তর সীমান্তে যেতে তাদের অনেকদিন সময় লেগে যায়। ফলে তাদের সঙ্গে থাকা খাবার, টাকা কোনটাই ছিল না। কয়েকদিন না খেয়ে তারা দুর্বল হয়ে পড়ে। দালাল চক্র এ অবস্থায় তাদের ফেলে চলে যায়। পরে মেক্সিকো পুলিশ তাদের উদ্ধার করেছে। ন্যাশনাল লেভেল শেয়ারিং ফর এডাপশন অব কমপ্রিহেনসিভ ল’ এগেইনস্ট ট্রাফিকিং ও রিফিউজি এ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ও ইউল্যাব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. জালাল উদ্দীন সিকদার তার গবেষণায় উল্লেখ করেছেন, আমেরিকা যাওয়ার নতুন রুটটি আগে থেকেই রয়েছে। এই রুট দুবাই, ব্রাজিল ও পানামা হয়ে সমুদ্রপথে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করেন অভিবাসন প্রত্যাশীরা। এই পথে বহু মানুষকে লোভে ফেলে দালাল চক্র বিভিন্ন সময় নিয়ে গেছে। তারা কেউ স্বপ্নের যুক্তরাষ্ট্রে যেতে পেরেছেন। আবার যাদের ভাগ্য খারাপ তাদের অনেকের বিভিন্ন দেশে জেলে স্থান হয়েছে। আবার কাউকে নিঃস্ব হয়ে দেশে ফিরতে হয়েছে। মানব পাচারের এই বাণিজ্য বন্ধ না হলে ভবিষ্যতে বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। তিনি বলেন, ইউরোপের বাজারে প্রতিবছর অবৈধ অভিবাসনের জন্য ৩ থেকে ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার চলে যাচ্ছে। মালয়েশিয়ার বাজারে যাচ্ছে ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই বিপুল টাকা পাচার হচ্ছে। ১০ টায়ারে বিদেশে দালাল চক্র মানব পাচার করে। প্রথমত গ্রাম থেকে লোক সংগ্রহ করা। লোক সংগ্রহ হলে তাদের সেন্টার পয়েন্ট ঢাকাতে নিয়ে আসা। এখান থেকে বিভিন্ন দেশের দালাল চক্রের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে বিভিন্ন জনকে বিভিন্ন দেশে পাঠানো হয়। তারপর তাদের একটি দেশে নিয়ে আটকে রাখা হয়। সংশ্লিষ্ট দেশে তারা কিছুদিন বন্দী জীবন যাপন করেন। দালালরা তাদের কাছ থেকে আরও টাকা দাবি করে। প্রথমে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা দিয়ে প্রলোভনে পড়ে দালালের হাত ধরে পাড়ি জমায় লিবিয়া, ইরাক, তিউনিসিয়াসহ কয়েকটি দেশে। বাড়তি টাকার জন্য বাবা, মা কিংবা আত্মীয়-স্বজনদের কাছে ফোন করে আরও বড় অঙ্কের টাকা আদায় করে নেয়। যারা বাড়তি টাকা দেন তাদের নৌকায় তোলা হয়। সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ নিয়ে যায়। সেখানেও দালাল চক্র রয়েছে। তারা তাদের রিসিভ করে। এভাবে একটা চেন কাজ করে। নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়েও যে তারা চাকরি পায় তা কিন্তু নয়। সেখানেও তারা নির্যাতনের শিকার হন। সেখানেও বাড়তি টাকা দিতে হয়। তা না হলে দাস হিসেবে থাকতে হয় তাদের। সাগরপথে উন্নত জীবনের আশায় যারা ইউরোপ পাড়ি দেন তাদের কারও ভাগ্য ভাল হলে নির্দিষ্ট জায়গায় যেতে পারেন। তবে অনেকেরই বিধি বাম। সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে প্রায় প্র্রতিদিন গড়ে ৬ জন করে মানুষ মারা যাচ্ছে। অবৈধপথে মানব পাচারের বিষয়টি সবচেয়ে বেশি ঘটছে মালয়েশিয়াতে। প্রতিদিন কয়েক শ’ মানুষ সাগরপথে পাড়ি জমাচ্ছেন।
×