ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

চামড়া খাতে ঋণের দু’হাজার ৮শ’ কোটি টাকার হদিস নেই

প্রকাশিত: ০৯:৫৭, ২০ আগস্ট ২০১৯

 চামড়া খাতে ঋণের দু’হাজার ৮শ’ কোটি টাকার হদিস নেই

রহিম শেখ ॥ টাকার অঙ্কে চামড়া কিনতে এবার ৬০১ কোটি টাকা ঋণ দিলেও, তার খুব অল্পই হাতে পেয়েছেন ট্যানারি মালিকরা। বেশির ভাগটাই গেছে আগের বকেয়া ঋণ সমন্বয়ে। চামড়া খাতে নেয়া ঋণের প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার মধ্যে দুই হাজার ৮০০ কোটি টাকা বর্তমানে খেলাপী। রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংক থেকে চামড়া খাতে বিতরণ করা ঋণের মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ ঋণের এখন হদিস নেই। মাত্র ৭০০ কোটি টাকার ঋণ নিয়মিত। এই নিয়মিত ঋণের মধ্যে মাত্র পাঁচ শতাংশ আদায় হচ্ছে। অবশিষ্ট টাকা বকেয়া থাকার পর সেগুলোও আবার খেলাপী হয়ে পড়ছে। ব্যাংকগুলো বলছে, যে প্রতিষ্ঠান শতভাগ উৎপাদনে ছিল এমন প্রতিষ্ঠানকেই এবার ঋণ দেয়া হয়েছে। এরমধ্যে অর্থ আদায়ে শর্ত সাপেক্ষে ঋণ সমন্বয় করার কথা বলছে ব্যাংকগুলো। যদিও ট্যানারি মালিকরা বলছেন, ব্যাংক থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে ঋণ না পাওয়ায় নগদ অর্থের সঙ্কটে চামড়া কিনতে পারেননি তারা। তবে চামড়া কিনতে সরকারী ও বেসরকারী ব্যাংকগুলোর ঋণের পাশাপাশি মৌসুমি ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগের পরও অর্থ সঙ্কট নয়, ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটে চামড়ায় দরপতন ঘটেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। প্রাণিসম্পদ অধিদফতর থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, এবার গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া মিলিয়ে মোট কোরবানিযোগ্য প্রাণীর সংখ্যা ছিল ১ কোটি ১৭ লাখ ৮৮ হাজার ৫৬৩টি। এর মধ্যে গরু ও মহিষের সংখ্যা ৪৫ লাখ ৮৮ হাজার। এর বাইরে কোরবানিযোগ্য ছাগল ও ভেড়ার সংখ্যা ছিল ৭২ লাখ। এছাড়া অন্যান্য প্রাণী (উট, দুম্বা) ৬ হাজার ৫৬৩টি। ২০১৮ সালে কোরবানিযোগ্য মোট প্রাণীর সংখ্যা ছিল ১ কোটি ১৫ লাখ ৫৭ হাজার, যার মধ্যে গরু ও মহিষের সংখ্যা ছিল ৪৪ লাখ ৫৭ হাজার। এদিকে প্রতিবছর কোরবানির সময় চামড়া কেনায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো অর্থায়ন করলেও এর একটি উল্লেখযোগ্য অংশই ফেরত না আসার অভিযোগ রয়েছে। বর্তমানে চামড়া খাতে দেয়া সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার ঋণের মধ্যে ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকাই খেলাপী হয়ে পড়েছে। চামড়া খাতের ব্যাংক ঋণ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংক থেকে চামড়া খাতে বিতরণ করা ঋণের মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশই খেলাপী ঋণে পরিণত হয়েছে। খেলাপীর কারণে বর্তমানে এ খাতে ঋণ দেয়ার আগে বেশকিছু শর্তজুড়ে দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। ঋণের কিস্তি বকেয়া থাকলে সংশ্লিষ্ট গ্রাহককে নতুন করে ঋণ দিচ্ছে না ব্যাংক। ফলে ঋণ আবেদনের সংখ্যাও কমে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, কাঁচা চামড়া কেনার জন্য বর্তমানে ৭১টি প্রতিষ্ঠান ঋণ পাচ্ছে। চামড়া খাতে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ছাড়াও বেসরকারী উত্তরা, ন্যাশনাল, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক কিছু ঋণ দিয়ে থাকে। চামড়া কিনতে এ বছর রাষ্ট্রায়াত্ত ৪ ব্যাংক ৪২টি প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়েছে ৬০১ কোটি টাকা। বেসরকারী ব্যাংকগুলোও দিয়েছে ৪০০ কোটি টাকার মতো। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, সোনালী ব্যাংক গত ৬ বছরে চামড়া শিল্পে ঋণ বিতরণ করেছে প্রায় ৮১৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ফান্ডেড ও নন ফান্ডেড মিলে প্রায় ৮০ কোটি টাকার ঋণ গেছে নিয়মিত চামড়া শিল্পে। বাকি ৭৩৩ কোটি টাকা গেছে কোরবানির চামড়া ক্রয়ে। এসব ঋণ ১০ প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে খেলাপী হয়ে গেছে প্রায় ৫৮৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ভুলুয়া ট্যানারি, আমিন ট্যানারি, কালাম ব্রাদার্স ট্যানারি এবং মোহাম্মদিয়া লেদারের কিছু টাকা বকেয়া থাকলেও লেনদেন নিয়মিত রয়েছে। কিন্তু বাকি ৬ প্রতিষ্ঠান টাকা ফেরত দিচ্ছে না। তাদের দেয়া ঋণ পুরোটাই এখন কু-ঋণে পরিণত হয়েছে। এর মধ্যে ভারসেজ সুজের কাছে ৭ কোটি ২০ লাখ টাকা, গ্রেট ইস্টার্ন ট্যানারির কাছে ১ কোটি টাকা, এক্সিলেন্ট ফুটওয়্যারের কাছে ১০ কোটি টাকা, দেশমা সু ইন্ডাস্ট্রিজের কাছে সাড়ে ২৩ কোটি, এসএনজেট ফুটওয়্যারের কাছে সাড়ে ১৪ কোটি টাকা এবং আনান ফুটওয়্যারের কাছে সাড়ে ৭ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। ভুলুয়া ট্যানারির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল কুদ্দুস বলেন, ‘আমার যদি ২০ কোটি টাকা লোন হয়, আমি সুপার এ্যাডজাস্ট করছি ১০ কোটি টাকা। যেটা আমাদের লোন দেয় কোরবানির সময়, সেটাকে বলে সুপার। কিন্তু বাকি ১০ কোটি টাকা সরকার আমাকে আর দেয়নি। শুধু ওই ১০ কোটি টাকাই দিয়েছে।’ ব্যাংকগুলোও স্বীকার করেছে, এটাই নিয়ম। আগের ঋণ শোধ না করলে, সমন্বয় করা ছাড়া কোন উপায় নেই। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা যখন ৭০ কোটি টাকা দিলাম, এরমধ্যে একটা ট্যানারি ফ্যাক্টরি শতভাগ শোধ করে ফেলেছে। ফলে সে তার ২৫ কোটি টাকার পুরোাটাই নিতে পেরেছে। আর বাকি দু’টো ফ্যাক্টরির- তাদের আন্ডারওয়ে প্রসেসের কারণে কিছু টাকা বাকি আছে। ফলে ওই পরিমাণ টাকা তারা কম পেয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, জনতা ব্যাংক এ পর্যন্ত চামড়া শিল্পে ১ হাজার ৩৮২ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। ৩২টি প্রতিষ্ঠানকে এসব ঋণ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে বকেয়া রয়েছে প্রায় ৮১৬ কোটি টাকা। ২০টি প্রতিষ্ঠান এ ঋণ নিয়েছে। এছাড়া, আরও প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ নিয়েছে চামড়াজাত প্রতিষ্ঠান ক্রিসেন্ট গ্রুপ। গ্রুপটির এক হাজার ৪১০ কোটি টাকার ঋণ খেলাপী দেখানো হয়েছে। গতবছর ব্যাংকটি ঋণ দিয়েছিল ৩০৮ কোটি টাকা। এবার ভাল দেখে ১০ প্রতিষ্ঠানকে ২০০ কোটি ঋণ দিয়েছে জনতা ব্যাংক। এছাড়া ঋণ নবায়ন করা হয়েছে আরও এক হাজার ১০০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে এক হাজার ৩০০ কোটি টাকার ঋণ সমন্বয় করা হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, অগ্রণী ব্যাংক এ পর্যন্ত চামড়া শিল্পে ঋণ বিতরণ করেছে ৬৭৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। ব্যাংকটি ২০১৩ সালে ৮ প্রতিষ্ঠানকে ৯০ কোটি ৮৯ লাখ, ২০১৪ সালে ৪ প্রতিষ্ঠানকে ১২৭ কোটি ৫০ লাখ ও ২০১৫ সালে ৩ প্রতিষ্ঠানকে ১৩০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। ২০১৬ সালে ব্যাংকটি এ খাতে ৬০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছিল। এসব ঋণের বেশিরভাগই অনাদায়ী। আদায় পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় ২০১৭ সালে এ খাতে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেও শেষ পর্যন্ত কোন ঋণ দেয়নি ব্যাংকটি। তবে ২০১৮ সালে ১০৫ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছিল। এবার অগ্রণী ব্যাংক ঋণ দিয়েছে ১৩০ কোটি টাকা। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শামস উল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, ঋণগ্রহিতা প্রতিষ্ঠানটিকে শতভাগ উৎপাদনে থাকার শর্ত অনুযায়ী এবার ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, রূপালী ব্যাংক এ পর্যন্ত চামড়া শিল্পে ঋণ বিতরণ করেছে ৭০০ কোটি টাকার মতো। এবার নতুন করে ঋণ দেয়া হয়েছে ১৫৫ কোটি টাকা। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ট্যানার্স এ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি এ শিল্পের জন্য নেতিবাচক হওয়ায় উদ্যোক্তারা ভাল নেই। যেসব পণ্য তৈরি হচ্ছে সেগুলো বিক্রি করা যাচ্ছে না। আবার রফতানি হলেও ক্রেতারা বিক্রি করতে না পারায় তারা টাকা দিচ্ছেন না। ফলে উদ্যোক্তারা ব্যাংকে খেলাপী হচ্ছেন। ব্যাংকগুলোও চাহিদা অনুযায়ী ঋণ দিচ্ছে না। তিনি বলেন, আগের বছর ঋণের যে পরিমাণ অর্থ পরিশোধ হয়, ঠিক ততটুকুই তারা দিয়ে থাকে। আর ঋণের পরিমাণও গত কয়েকবছর ধরেই একই অঙ্কে ঘুরপাক খাচ্ছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় ঋণের পরিমাণ আরও বাড়ানো উচিত বলে মনে করেন তিনি। শহীন আহমেদ বলেন, সাভারে চামড়া শিল্পনগরী পরিপূর্ণ না করে কারখানা হাজারীবাগ থেকে স্থানান্তরের কারণে অনেকেই লোকসানে পড়েছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মেয়াজ্জেম জনকণ্ঠকে বলেন, সরকারী চার ব্যাংক এবার চামড়া শিল্পে ৬০১ কোটি টাকার ঋণ দিয়েছে। এরসঙ্গে বেসরকারী ব্যাংকগুলোর ঋণও রয়েছে। এছাড়া চামড়া কিনতে মৌসুমি ব্যবসায়ীরাও নগদ অর্থ বিনিয়োগ করেন। এত টাকার জোগানের পরও অর্থ সঙ্কট থাকার কোন কারণ থাকতে পারে না। অর্থ সঙ্কট নয়, ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটে এবার চামড়ায় দরপতন ঘটেছে বলে মনে করেন সিপিডির এই গবেষক।
×