ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

গোপালগঞ্জের চামড়া ব্যবসায়ীরা চরম বিপাকে

প্রকাশিত: ০৯:৩৩, ২০ আগস্ট ২০১৯

 গোপালগঞ্জের চামড়া ব্যবসায়ীরা  চরম বিপাকে

নীতিশ চন্দ্র বিশ্বাস, গোপালগঞ্জ ॥ গোপালগঞ্জে এবারে গরুর খামারিরা ভাল দাম পেলেও চামড়ার বাজার ভীষণ মন্দা। জেলার চামড়া ব্যবসায়ীরা রয়েছেন চরম বিপাকে। জেলা পর্যায়ের এসব ক্ষুদ্র-আড়তদাররা অনেকেই জিম্মি হয়ে আছেন ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছে। তাদের কাছে টাকা-পয়সা আটকে যাওয়ায় এখন অনেকেই এ ব্যবসা থেকে সরে দাঁড়ানোর চিন্তা করছেন। তারা মনে করছেন, সরকার চামড়ার বাজার শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ না করলে জেলা পর্যায়ের ক্ষুদ্র-আড়তদার বা মৌসুমি ব্যবসায়ীদের অনেকেরই এ ব্যবসা ছেড়ে দিতে হবে। জেলার বিভিন্ন মসজিদ, মাদ্রাসা ও এতিমখানাসহ ব্যক্তি পর্যায়ে খবর নিয়ে জানা গেছে, গত বছর কোরবানিতেও তারা স্থানীয় আড়তদার ও মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছে যথেষ্ট পরিমাণে চামড়া বিক্রি করেছেন এবং ভাল দামও পেয়েছেন। এবারে তাদের কাছে চামড়া কিনতে কেউ আসেনি। দু’একজন যারা এসেছেন, তারাও ভাল দাম দেননি। ফলে অনেকে চামড়া বিক্রি করতে পারেননি। চামড়ার দাম আশাতীত কম দেখে অনেকে মাটির খুঁড়ে পুঁতে দিয়েছেন; কেউ কেউ নদীতে বা রাস্তার আশপাশে ফেলে দিয়েছেন। এভাবে জেলায় এবারে বহু চামড়া নষ্ট হয়ে গেছে; যা আগে কখনও হয়নি। গোপালগঞ্জ শহরের চামড়া-আড়তদার মেসার্স শোকর এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মোঃ শোকর আলী জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন, গত বছর কোরবানির সময় তিনি কাঁচা চামড়াসহ মোট ৪৯শ’ পিস চামড়া কেনেন। অথচ এবারে কিনেছেন মাত্র ৫শ’ পিস। কারণ গত বছর ঢাকার ট্যানারিতে তিনি যে চামড়া দিয়েছেন তার তিন-চতুর্থাংশ টাকা তিনি এখনও ট্যানারি মালিকের কাছ থেকে পাননি। একদিকে তার ব্যাংক লোন রয়েছে, আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে কিছু লোন, আর নিজের যা ছিল তাই দিয়ে তিনি ব্যবসা চালিয়ে আসছিলেন। গত এক বছরে তার ৪০ লাখ টাকারও বেশি ট্যানারি মালিকের কাছে আটকা পড়ে আছে। এখন তার পথে বসে যাওয়ার অবস্থা দাঁড়িয়েছে। তিনি আরও বলেন, সরকার চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করে দিলেও তাতে তার মতো ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কোন সুবিধা হয়নি। কারণ ব্যবসার প্রায় পুরো টাকাটাই আটকা পড়েছে ট্যানারি মালিকদের কাছে। শুধু এ জেলায় নয়, সারাদেশে তার মতো বহু ক্ষুদ্র আড়তদার ট্যানারি মালিকদের কাছে জিম্মি হয়ে আছেন। যে কারণে মাঠ পর্যায়ে চামড়া সংগ্রহ একেবারেই কমে গেছে। আর এভাবে চলতে থাকলে দেশের চামড়া শিল্প অচিরেই ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই এ শিল্পটিকে ধরে রাখতে সরকারের শক্ত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রয়োজন। বাদশা মোল্লা নামে আরেক ক্ষুদ্র আড়তদার জানিয়েছেন, গোপালগঞ্জে ক্ষুদ্র আড়তদার ও মৌসুমি ব্যবসায়ীসহ ছোট বড় প্রায় ৩০ জন চামড়া ব্যবসায়ী রয়েছেন। তিনি ব্যবসা করেন নাটোরের বড় আড়তদারদের সঙ্গে। সেখানে তাদের তেমন পাওনা পড়ে থাকে না। তবে চামড়ার বাজার ভাল না থাকার কারণে এবারে তিনি মাত্র ৬শ’ পিস চামড়া কিনেছেন। প্রতিপিস দেড় শ’ থেকে সাড়ে ৭শ’ টাকা দামেও তিনি চামড়া কিনেছেন। লবণসহ প্রসেস করতে প্রতিপিস চামড়ায় আরও খরচ হয় কমপক্ষে ২শ’ টাকা। সুতরাং ট্যানারি মালিকরা যদি এসব ক্ষুদ্র আড়তদারদের টাকা-পয়সা আটকে রাখে, সেক্ষেত্রে চামড়া শিল্প ক্রমেই ধ্বংসের দিকেই যাবে। তিনি আরও বলেন, এসব চামড়া একসময় ওয়েভ-ব্লু করে বিদেশে পাঠানো হতো। তখন এ ব্যবসা অত্যন্ত লাভজনক ছিল। কিন্তু এরশাদের সময় ওয়েভ-ব্লু বন্ধ করে দেয়ার পর থেকে দেশের চামড়া শিল্প ক্রমেই ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে। তাই সরকারীভাবে আবারও যদি ওয়েভ-ব্লু চালু করা সম্ভব হয় এবং বিদেশে রফতানি করা যায়, তাহলে চামড়া শিল্পটি আবারও ঘুরে দাঁড়াবে। এছাড়াও টুঙ্গিপাড়ার রতন ও রুঙ্গু, কোটালিপাড়ার নিখিল ও বিধান, কাশিয়ানীর আজিজুল, রামদিয়ার ওহিদ এবং সদরের মাঝিগাতীর পরিতোষ ও পরিমলসহ কয়েকজন চামড়া-ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা কেউ সরাসরি ঢাকায় ট্যানারি মালিকদের সঙ্গে, কেউ বড় আড়তদারদের সঙ্গে, কেউবা স্থানীয় ক্ষুদ্র আড়তদারদের সঙ্গে ব্যবসা করেন। কিন্তু সব চামড়াই শেষপর্যন্ত চলে যায় ট্যানারি মালিকদের কাছে। তাই ট্যানারি মালিকরা যদি সঠিকভাবে চামড়া নেয় এবং সময় মতো টাকা পরিশোধ করে, তাহলে জেলাপর্যায়ের কোন আড়তদার বা মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কোন সমস্যা হয় না। বরং তারাও ভাল দাম দিয়ে মাঠপর্যায় থেকে কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করতে পারেন। তারা আরও জানান, গতবছরও জেলায় ৩০ হাজারের বেশি কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করা গেছে। এবারের কোরবানিতেও জেলায় শুধুমাত্র খামারিদের কাছেই ৩৩ হাজার গরু প্রস্তুত ছিল। খামারি ছাড়াও ব্যক্তিগতভাবে দু’চারটে গরু পুষে কোরবানির হাটে বিক্রি করেছেন অনেকে। যে পরিমাণে গরু বেচাকেনা হয়েছে, সে অনুযায়ী মাঠপর্যায় থেকে কাঁচা চামড়া সংগ্রহ হয়নি ওই একই কারণে। এজন্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিভিন্ন সমজিদ, মাদ্রাসা ও এতিমখানার গরিব দুস্থ শিক্ষার্থীরা; যারা এই চামড়া বিক্রির টাকা থেকে ভাল একটি সহযোগিতা পেয়ে থাকে। এ কারণে জেলার ক্ষুদ্র চামড়া আড়তদার বা মৌসুমী ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে মসজিদ, মাদ্রাসা ও এতিমখানাসহ কাঁচা চামড়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই চান দ্রুত এ সমস্যার সমাধান হোক এবং চামড়ার বাজার আবারও চাঙ্গা হোক এবং ফিরে আসুক দেশের চামড়া শিল্পের সোনালি ঐতিহ্য।
×