ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ

বাংলা বায়াফ্রা কিংবা কঙ্গো নয় ॥ ২০ আগস্ট, ১৯৭১

প্রকাশিত: ০৯:২২, ২০ আগস্ট ২০১৯

বাংলা বায়াফ্রা কিংবা কঙ্গো নয় ॥ ২০ আগস্ট, ১৯৭১

১৯৭১ সালের ২০ আগস্ট দিনটি ছিল শুক্রবার। রাত ১টায় নরসিংদী গেরিলা ইউনিটের ডিমোলিশন পার্টি তিতাস গ্যাস লাইন বারুদ লাগিয়ে উড়িয়ে দেয়। এই অপারেশন পুরোপুরি সফল হয়। বিস্ফোরণের ফলে প্রজ্বলিত অগ্নিশিখা প্রায় ১০ মাইল দূর থেকে দেখা যায় এবং ৬-৭ মাইল দূর থেকে বিস্ফোরণের বিকট শব্দ শোনা যায়। ঘোড়াশালের উত্তরে সমস্ত এলাকায় বিদ্যুত সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। নরসিংদী, ঘোড়াশাল এবং পাঁচদোনাতে অবস্থানরত পাকসেনারা এই বিস্ফোরণের বিকট শব্দে ভীষণভাবে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে এবং অনেকেই তাদের অস্ত্রশস্ত্র এবং জিনিসপত্র ফেলে ঢাকার দিকে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করে। পরে স্থানীয় লোকজনের মুখে শোনা যায় যে, পাকসেনারা ধারণা করেছিল ভারতীয় বিমান বোমা ফেলেছে। এর পরদিন আশুগঞ্জের নিকট কয়েক জায়গাতে পাইপলাইন উড়িয়ে দেয়া হয়। এই গ্যাসের পাইপলাইন মেরামত করতে বেশ ক’দিন সময় লাগে। ততদিন শিল্প-কারখানাগুলো বন্ধ থাকে। মুক্তিবাহিনীর এ্যামবুশ দল কুমিল্লার এক মাইল উত্তরে পাক বর্বরদের একটি টহলদার প্লাটুনকে এ্যামবুশ করে। মুক্তিযোদ্ধাদের অতর্কিত আক্রমণে পাকসেনারা হতচকিত হয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে পলায়ন করে। এই এ্যামবুশে ১১ জন পাকসেনা নিহত ও তিনজন আহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের একটি মেশিনগান ও কয়েকটি জি-৩ রাইফেল দখল করে। ফ্লাইট লে. মতিউর রহমান নিয়মিত কাজের আড়ালে একটি বিমান ছিনতাই করে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের পরিকল্পনা করতে থাকেন। পরিকল্পনা মোতাবেক এইদিন করাচীর মাসরুর বিমান ঘাঁটি থেকে সকাল ১১.১৫ মিনিটে পাঞ্জাবি পাইলট রাশেদ মিনহাজসহ টি-৩৩ প্রশিক্ষণ বিমান ছিনতাই করে ভারত অভিমুখে উড্ডয়ন করেন। অপর পাইলটের সঙ্গে কন্ট্রোল নিয়ে ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে সিন্ধুর বেদিনে বিমানটি বিধ্বস্ত হলে দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিমান উভয়েই শাহাদাতবরণ করেন। নরসিংদীর ইউনিট কমান্ডার ইমাম উদ্দিনের নেতৃত্বে তিতাস গ্যাস লাইন উড়িয়ে দিয়েছিলেন। মাসুদ হোসেন আলমগীর নোবেলের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা দল সারিয়াকান্দি থানার আওলাকান্দী গ্রামের পূর্ব পাশে যমুনা নদীতে একটি পাকমিলিটারি লঞ্চকে আক্রমণ করে। রকেট লঞ্চারের আঘাতে লঞ্চটি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয় এবং সকল আরোহী নিহত হয়। আর্টিলারিসহ এক ব্যাটালিয়ন পাক হানাদার ও তিন শতাধিক রাজাকার চিলমারীতে ইস্ট বেঙ্গলের মুখোমুখি হয়। ইস্ট বেঙ্গল ছিল কম্বাইন্ড ফোর্স। মূল কমান্ডে ছিলেন ‘জেড’ ফোর্সের অধিনায়ক মেজর জিয়াউর রহমান। কখনও বা মনে হয়েছে পাক হানাদার ইস্ট বেঙ্গলের ডিফেন্সে ফাটল ধরাতে সমর্থ হবে। কিন্তু না, বাংলার বীর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট দাঁতে দাঁত কামড়ে পজিশন আগলে রেখে প্রথম দুদিন তাদের আক্রমণ রেসিস্ট করেছে। দুদিন ধরে মুক্তিযোদ্ধারা জঙ্গল ও বনের ফাঁক দিয়ে সংগ্রহ করে হানাদার বাহিনীর ডিফেন্সের ফাঁকফোকর। মুক্ত হয়ে কুড়িগ্রামের চিলমারী। পাঁচদিন পাঁচরাত রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর শত প্রাণশক্তিতে ভরপুর ইস্ট বেঙ্গলের বীর জোয়ানরা এগিয়ে চলল পলাতক পাক হানাদারদের পরবর্তী ডিফেন্স লাইন চিলমারী রেলওয়েতে আঘাত হানার জন্য। পশ্চাতে পড়ে থাকল রক্তস্নাত চিলমারী। আনন্দে উদ্বেলিত জনগণ চিলমারী রণক্ষেত্রে এসে দেখতে পেল বাংকারে বাংকারে পড়ে আছে শতাধিক হানাদার ও রাজাকারের লাশ। পাক হানাদারদের ডিফেন্স লাইন রক্তে ভেসে যাচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধারা নিহত হানাদারদের চিলমারীতে কবর দেয়ার ব্যবস্থা করে। পাকিস্তানীদের ২টি লঞ্চ ধরা পড়ে ও ২টি স্পিডবোট ধ্বংস হয়। ধ্বংস হয় কয়েকটি সাঁজোয়া যান এই যুদ্ধে ইস্ট বেঙ্গলের ৩ জন সামান্য আহত হয়। মুক্তিযোদ্ধা পান্ডব চন্দ্র দাসের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা সুনামগঞ্জে পাকবাহিনীর মুসলিমপুর অবস্থান আক্রমণ করে। এক ঘণ্টারও অধিক সময় যুদ্ধের পর পাকসেনাদের চাপে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ কৌশল পরিবর্তন করে এবং জিরানপুর গ্রামে এসে অবস্থান নেয়। মুক্তিবাহিনী খুলনায় পাকবাহিনীর শ্যামনগর অবস্থানের উপর তিনটি কলামে যথাক্রমে ক্যাপ্টেন হুদা, লে. বেগ এবং নায়েব সুবেদার আবদুল গফুর ও হাবিলদার সোবহানের নেতৃত্বে তীব্র আক্রমণ চালায়। তুমুল যুদ্ধের পর পাকসেনারা তাদের অবস্থান ত্যাগ করে এবং শ্যামনগর মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে আসে। এ সংঘর্ষে মুক্তিবাহিনী ৪ জন পাকসেনার লাশ উদ্ধার করে ও ৪ জনকে আহত অবস্থায় বন্দী করে। অপরদিকে বীর মুক্তিযোদ্ধা সুবেদার ইলিয়াসসহ ৮ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং ৬ জন মুক্তিযোদ্ধাকে পাকসেনারা ধরে নিয়ে যায়। শিবগঞ্জের হাজারবিঘী গ্রামটি পাগলা নদীর পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত। এ গ্রামের বেশ কিছু ছেলে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেছিল। গ্রামটি মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে থাকায় মুক্তিযোদ্ধা গেরিলা দল যে কোন সময় সেই গ্রামের মধ্য দিয়ে যাতায়াত করত। তাই হাজারবিঘী গ্রামটি পাকসেনার আক্রোশের শিকার হয়। সেদিন ছিল শুক্রবার। পাকসেনারা হাজারবিঘী অপারেশনে প্রেরিত দলটি পুকুরিয়া ফেরিঘাট দিয়ে পার হয়। তারা দুটি উপদলে বিভক্ত হয়ে একটি দল গ্রামের উত্তর প্রান্ত দিয়ে ও অপর দলটি দক্ষিণ প্রান্ত দিয়ে গ্রামের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। তখন বেলা প্রায় ২টা। জামে মসজিদে জুমার ফরজ নামাজ শেষ। কিছু মুসল্লি মসজিদ থেকে বেরিয়ে গেছে। কিছু মুসল্লি সুন্নাত ও নফল নামাজ পড়ছে। এমন মুহূর্তে পাক হানাদার বাহিনী মসজিদটি ঘিরে ফেলে। নামাজ শেষে মুসল্লিরা এক এক করে বের হতে থাকে। মুসল্লিদের ধরে জমায়েত করে পুকুরিয়া ফেরিঘাটে নিয়ে যায়। তাদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে করে লাঠি ও বেত দিয়ে পেটাতে থাকে। পাক আর্মি কর্তৃক মসজিদ থেকে মানুষকে ধরে নিয়ে নির্মম নির্যাতনের খবর গ্রামে ছড়িয়ে পড়লে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। মেয়েরা নিজের ইজ্জত বাঁচানোর জন্য বাড়ি ছেড়ে নিরাপদে আশ্রয়ে চলে যায়। মুক্তিযুদ্ধের এই সময়ে পাবনায় ভয়াবহ বন্যায় চারদিক ডুবে যায়। পাবনা শহরের রাস্তাঘাটে নৌকা চলাচল করেছিল। দুর্বিষহ অবস্থায় পাকসেনা এবং তাদের দোসরদের নির্মম অত্যাচারে মানুষ দিশেহারা হয়ে যায়। একদিকে খাদ্য সঙ্কট এবং অন্যদিকে হানাদার বাহিনীর নির্যাতনে মানুষ চরম বিপাকে পড়ে। শুক্রবার দুপুর সাড়ে বারোটা। গ্রামের মানুষ স্থানীয় মসজিদে জুমার নামাজ পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন এমন সময় গোটা গ্রাম জুড়ে হৈচৈ, দোড়াদৌড়ি আর কান্নার শব্দ ভেসে আসে। মাঝে মাঝে গুলির শব্দ। মানুষজন বিশেষ করে উত্তর দিকের বিলের মধ্যে পালাতে পারলেও পালাতে পারল না গ্রামের হিন্দুপাড়ার বাসিন্দা এবং তাদের কাছে আশ্রয় নেয়া শহর থেকে আসা হিন্দু পািরবারগুলো। হানাদার সৈন্যরা পুরুষদের ধরে এক জায়গায় জড়ো করে, নারীদের ওপর নির্যাতন, লুটপাট অগ্নিসংযোগ করে। শহর থেকে যাওয়া অজ্ঞাতনামা বহু মানুষকে গ্রাম সংলগ্ন ইছামতি নদীর পাড়ে দাঁড় করিয়ে হত্যা করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। এছাড়া ওই গ্রামের ২৮ জনকে কালী মন্দিরের বিগ্রহের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে হত্যা করা হয়। পাবনা জেলার আটঘরিয়া উপজেলার লক্ষ্মীপুর গ্রামে পাকিস্তান সেনাবাহিনী অতর্কিত হানা দিয়ে ব্যাপক লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ ও নির্যাতন করে বহু নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে আটঘরিয়ার দেবোত্তর, বংশিপাড়া, গড়রী, আটঘরিয়া বাজার এবং একদন্তের বেলদহ এলাকার মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষকে হত্যা করা হয় এই লক্ষ্মীপুর গ্রামে। এছাড়া এইদিন লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, দেশখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী ওস্তাদ এমএ গফুরকে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করার অভিযোগে হত্যা করা হয়। এই শিল্পীকে যখন নির্যাতন করা হচ্ছিল তখন তার সামনে থাকা রেডিও থেকে তারই গাওয়া গান পরিবেশিত হচ্ছিল। এই মরমী শিল্পীকে বেয়ানোট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নৃশংশভাবে হত্যা করে পাশের ইছামতি নদীতে লাশ ভাসিয়ে দেয়া হয়। সে সময় বাজার থেকে অজ্ঞাত আরও একজনকে ধরে একইভাবে হত্যা করা হয়। আটঘরিয়ার পাশর্^বর্তী হাদল ও ডেমড়া এলাকায় ভয়াবহ গণহত্যা সংগঠিত হয়। এসব গ্রামসমূহে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসররা হানা দিয়ে শত শত লোককে একসঙ্গে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে এবং দিনব্যাপী ওইসব গ্রামের নারী যুবতী এমনকি শিশুদেরও নরপিশাচরা ধর্ষণ করে। ডেমরা হত্যাকা-তে প্রায় সাড়ে আটশত লোককে একসঙ্গে দাঁড় করিয়ে হত্যা করা হয়। ক্যাপ্টেন নূরুল হুদা ১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে শ্যামনগর আক্রমণের জন্যে অগ্রসর হয়। লে. বেগ, সুবেদার ইলিয়াস, নায়েব সুবেদার গফুর, হাবিলদার সোবহান আবদুল হক প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধাগণও ছিলেন। উকসা হেডকোয়ার্টার থেকে রওনা হয়ে রাত দুটায় মুক্তিযোদ্ধাদলটি শ্যামনগর শত্রুব্যূহের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। শ্যামনগর ওয়াপদা কলোনিতে অবস্থানরত পাকসেনাদের একটি প্লাটুন ছিল। পাকসেনাদের প্রতিরক্ষা ব্যূহটি অত্যন্ত সুদৃঢ়। মুক্তিযোদ্ধাদের বাহিনীকে তিনটি কলামে ভাগ করা হয় এবং একটি কলামে ক্যাপ্টেন নূরুল হুদা, সড়কের অপর পাশে একটি কলামের সঙ্গে রইলেন লে. বেগ। নায়েব সুবেদার আবদুল গফুর ও হাবিদার সোবহান রইলেন অপর অলামে। মুক্তিসেনাদের অস্ত্র ছিলো ৮টি এলএমজি, এসএমজি ১২টি, ২ ‘মর্টার ৩টি এবং অবশিষ্ট এসএলআর ও রাইফেল। রাত দুটোর পরই নায়েব সুবেদার গফুর ২’ মর্টার নিয়ে প্রথম পাক অবস্থানের উপর আঘাত হানতে শুরু করেন। এদিকে পাকসোনাদের প্রচ- বাধা অতিক্রম করে ক্যাপ্টেন নূরুল হুদা ও লে. বিগ কিছুতেই সামনের দিকে অগ্রসর হতে পারছিল না। রাত ৪টার দিকে কালীগঞ্জ থেকে পাকসেনাদের আর একটি প্লাটুন নির্বিবাদে শ্যামনগর চলে আসে। উভয়পক্ষে প্রচ- সংঘর্ষ চলতে থাকে। দুপক্ষেরই মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি হয়। সকাল ৯টায় শ্যামনগর মুক্তিসেনাদের নিয়ন্ত্রণের আসে। সংঘর্ষে ৪ জন পাকসেনা নিহত এবং ৪ জন আহত অবস্থায় মুক্তিসেনাদের হাতে বন্দী হয়। এই সংঘর্ষের পর শ্যামনগর থানা মুক্তিসেনাদের নিয়ন্ত্রণে এলেও সুবেদার ইলিয়াসসহ ৮ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং ৬ জনকে পাকসোনারা ধরে নিয়ে যায়। সকালে ২৫ জন রাজাকার আত্মসমর্পণ করে। শ্যামনগর থানায় স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়। স্বাধীন বাংলা থেকে প্রকাশিত ‘জয়বাংলা’ পত্রিকার ২১ আগস্ট ১৯৭১-এর সংখ্যা এ সম্পর্কিত সংবাদ পরিবেশ করা হয়েছিল। রাওয়ালপিন্ডিতে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের সদর দফতর থেকে এক প্রেসনোটে বলা হয় বেআইনী আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান প্রখ্যাত আইনজীবী একে ব্রোহীকে বিশেষ সামরিক আদালতে তাঁর পক্ষ সমর্থনের জন্য মনোনীত করেছেন। প্রেসনোটে উল্লেখ করা হয়, আওয়ামী লীগ প্রধান ১১ আগস্ট বিশেষ সামরিক আদালতে প্রথম উপস্থিত হবার জন্য আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে তিনজন আইনজীবীর নামের তালিকা প্রদান করেন। ১১ আগস্ট পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার অভিযোগে শেখ মুজিবুর রহমানের রুদ্ধদ্বার কক্ষে বিচার শুরু হয়েছে। মামলার সমস্ত শুনানি গোপন রাখা হবে। সামরিক আইন প্রশাষক লে. জেনারেল টিক্কা খান ১৩ জন জাতীয় পরিষদ সদস্যকে সামরিক আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়। তারা হচ্ছেনÑ নূরজাহান মোর্শেদ, মিজানুর রহমান চৌধুরী, এম ওয়ালিউল্লাহ, কাজী জহিরুল কাইয়ূম, খোন্দকার মোশতাক আহমদ, খোরশেদ আলম, নূরুল ইসলাম চৌধুরী, মোহাম্মদ ইদ্রিস, মোস্তাফিজুর রহমান, খালেদ মোহাম্মদ আলী, খাজা আহমদ, নূরুল হক এবং মোহাম্মদ হানিফ। ... দৈনিক সংবাদ পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে মুক্তি বাহিনী বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা মহানগরী ও ঢাকা জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে ৩৬ ঘণ্টার সান্ধ্য আইন জারি করে পাক হানাদার বাহিনীর তথাকথিত স্বাধীনতা দিবস উদযাপন কার্যত ব্যর্থ করে দিয়েছেন। মুক্তি বাহিনী এক আদেশ জারি করে ১৪ আগস্ট সকাল ৬টা থেকে ১৫ আগস্ট দুপুর ১২টা পর্যন্ত বৈদ্যেরবাজার থেকে কাইকারটেক রোড, সোনারগাঁও থেকে সি.এ্যান্ডবি রোড ও বৈদ্যেরবাজার থেকে আনন্দবাজার এলাকায় সান্ধ্য আইন ঘোষণা করে। স্থানীয় অসামরিক জনসাধারণের পূর্ণ সহযোগিতায় কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি এবং পাক হানাদারদের তথাকথিত স্বাধীনতা উৎসব পালনও এসব এলাকায় আদৌ হয়নি।... লেবানন থেকে আল হাওয়াইদ পত্রিকায় পূর্ণ ধ্বংসের যুদ্ধ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, একজন পাকিস্তানী অফিসার একটি গ্রামে যান এবং সেখানকার দরিদ্র ও অনাহারী গ্রামবাসীকে তারা পাশে জড়ো হতে বলেন। তিনি বলেন, ‘আমার কিছু সৈনিক আহত হয়েছে। তাই আমার রক্তের দরকার এবং আমার কিছু স্বেচ্ছাসেবী প্রয়োজন।’ কোন প্রতিউত্তর গ্রহণের পূর্বেই সেনারা ভিড়ের মধ্য থেকে কিছু যুবককে ধরে নিয়ে এসে মাটিতে শুইয়ে দেয় এবং তাদের শিরা ফুটো করে দেয়। তাদের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত রক্ত বের হতে থাকে। পূর্ব পাকিস্তানে ঘটে যাওয়া অসংখ্য ঘটনার মধ্যে এটি ছিল কেবল একটি। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে পূর্ব পাকিস্তানের বিরোধী ‘মানুষের উপর’ পশ্চিম পাকিস্তানের এই অত্যাচার নিয়মিতভাবেই চলতে থাকে। লাখ লাখ লোকের ভারত অভিবাসন কোন আশ্চর্যের কিছু ছিল না। লোকজন প্রাণভয়ে ও ক্ষুধার তাড়নায় তাড়িত হয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×